কেন রবীন্দ্রনাথকে তুমি বুকে জড়িয়ে বসে আছো/ জানলার ধারে/ আমি কি কেউ না?’ এ ভাবেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় শুরু করেছিলেন তাঁর ‘তিনি ও আমি’ কবিতাটি, যা এক দরিদ্র কবির বয়ান, যে সর্বত্র উপহাসের পাত্র। এমনকি তার ভালবাসার মেয়েটিও তাকে উপেক্ষা করে রবীন্দ্রনাথে নিমগ্ন। শুধু তো কবি নয়, এ হল বাংলার বহু গীতিকারের মনের কথা। তাঁদের গান লোকে ভুলতে পারেনি, কিন্তু ভুলে গিয়েছে তাঁদের অনেককে। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার বা পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম যদি বা একটু পরিচিত হয়, শৈলেন রায়, অজয় ভট্টাচার্য, সজনীকান্ত দাস, মোহিনী চৌধুরী, সুবোধ পুরকায়স্থ, শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্যামল গুপ্ত: বাংলার সঙ্গীত জগতে এঁদের অসামান্য অবদান কতটুকু সংরক্ষিত হয়েছে?
তবে বাইশে শ্রাবণ এলেই মনে হয় গীতিকার প্রণব রায়ের (ছবি) কথা। এই দিনটি তাঁরও প্রয়াণ দিবস (১৯৭৫)। তিনিই লিখেছিলেন প্রবাদপ্রতিম গান, ‘আমি বনফুল গো’। প্রমথেশ বড়ুয়ার ছবিতে (শেষ উত্তর, ১৯৪২) নায়িকা কানন দেবীর অভিনয়ে ও কণ্ঠে সেই গান যেন বাংলার মেয়ের চিরকালীন রোম্যান্টিক মনটি উন্মুক্ত করল, ‘পথিক ভ্রমর শুধায় মোরে, সোনার মেয়ে নাম কি তোর? বলি ফুলের দেশের কন্যা আমি, চম্পাবতী নামটি মোর’। যেন মেয়েটির মন থেকেই উঠে আসছে, বসিয়ে-দেওয়া বুলি নয়। এই তো সফল গীতিকারের পরিচয়।
ঠিক সে ভাবেই, প্রণবের কথায় গায়ক-নায়ক রবীন মজুমদার গাইলেন ‘এই কি গো শেষ দান, বিরহ দিয়ে গেলে’। কথাগুলি যেন আহত, আক্ষেপ-বিদ্ধ যুবকের হৃদয় থেকে বেরিয়ে এসেছে, ‘কেন হয়েছিল শুরু হবে যদি অবসান?’ প্রেমের জনপ্রিয় গান অনেক লেখা হয়েছে, বিরহের এত মর্মস্পর্শী গান বাংলায় খুব কম। তাই আজও গানটিতে ফিরে ফিরে যান বাংলার সঙ্গীতশিল্পীরা, ‘যে পথে গিয়াছ তুমি, আজ সেই পথে হায়, আমার ভুবন হতে বসন্ত চলে যায়’। প্রেম-বিরহের সমমান্যতায় সিনেমা জগতে সাড়া ফেললেন প্রণব রায়। রচিত হল, ‘মধুর আমার মায়ের হাসি চাঁদের মুখে ঝরে/ মাকে মনে পড়ে আমার মাকে মনে পড়ে,’ যা মাতৃত্বের এক বিশ্বরূপের বন্দনা।
প্রেমেন্দ্র মিত্রর নিরীক্ষায়, “প্রণব রায়ের পরিচয় শুধু গীতিকার হিসেবে নয়, তার মুখ্য পরিচয় সে সাহিত্যিক; এবং সাহিত্যের মেজো সেজো নয়, ছিল সে বড়দের একজন” (রোমাঞ্চ, প্রণব রায় স্মৃতিসংখ্যা, ১৯৭৬)। সাহিত্যজীবনের একেবারে গোড়াতেই সে স্বীকৃতি প্রণব পেয়েছিলেন। তাঁর গীতিকার জীবনের সূত্রপাত ১৯৩৪ সালের পুজোয়, দু’টি রেকর্ড দিয়ে। তাঁর লেখা চারটি গান গাইলেন দুই শিল্পী, কমলা ঝরিয়া এবং মানিকমালা। এইচএমভি-র রেকর্ড-ক্যাটালগে লেখা হল, “আমরা এবার এক তরুণ সঙ্গীত রচয়িতাকে পেয়েছি যিনি এসেছেন নব নক্ষত্র উদয়ের বিস্ময় নিয়ে। ইনি প্রণব রায়। এঁর লেখা গান যে কোনও শ্রেষ্ঠ গীতরচয়িতার গানের পাশে সসম্মানে সমান আসন দাবি করতে পারে।” সারা জীবনে দু’হাজারের বেশি গান লিখেছেন। বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরী বংশের ছেলে, বিজ্ঞানের স্নাতক প্রণব নানা বৃত্তি উপেক্ষা করে গান লেখাকেই পেশা করেছিলেন: “আমার পকেটে একটা কলম ও এক টুকরো কাগজ থাকলে আমি ভাবতাম আমার সঙ্গে হাজারটা টাকা আছে।”
তাঁর এই নির্বাচনের পিছনে হয়তো কাজ করেছিল সে যুগের গান-কবিতার দুই উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল। শৈশবে তিনি রবীন্দ্রনাথকে গান শুনিয়েছিলেন, নজরুলের কাছে গান শিখেছিলেন। নজরুলেরই প্রেরণায় গান লেখার জগতে তাঁর প্রবেশ, পেশা হিসেবে তা বেছে নেওয়া। “তিনি আমার মতো একজন নবীনতম কবিকে কত স্নেহ, কত প্রশ্রয় দিতেন; কত উৎসাহ দিয়ে তিনি আমাকে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন,” স্মৃতিকথায় লিখেছেন প্রণব (দেশ সঙ্গীত সংখ্যা, ১৯৮৪)।
স্বদেশি চেতনাতেও প্রণব নজরুল-অনুগামী। লেখকজীবনের গোড়ায়, ১৯৩৩-৩৪’এ প্রণবের কারাদণ্ড জোটে ‘কমরেড’ কবিতার জন্য, ‘নিখিল ব্যথার সমব্যথী তোরা, কমরেড অগণন,/ একের সহায় অসংখ্য আছে; ওরা আর কতজন?’ সম্পাদনা করতেন নাগরিক পত্রিকা। তাঁর সম্পাদকীয়, “আমাদের ঘরের চারিপাশে পর্ব্বতপ্রমাণ পাপ জমিয়া উঠিয়াছে। লালসার বাজপাখী খর নখরাঘাতে আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনকে ক্ষতবিক্ষত করিয়া তুলিল। ‘নাগরিক’ গ্লানি ও জঞ্জালকে দেশপ্রেমের প্লাষ্টার দিয়া ঢাকিয়া রাখিতে চাহে নাই ...।” এক হাতে বাঁশি, অন্য হাতে তরোয়াল, এই উত্তরাধিকার বাংলার গীতিকাররা বহন করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়-আর্কাইভে সংরক্ষণের অবহেলায় প্রণবের কত গান আজ বিস্মৃত!
কত প্রতিভাবান, সফল গীতিকার হারিয়ে যাচ্ছেন, বাঙালির সংস্কৃতির ইতিহাসে ফাঁক তৈরি হচ্ছে। বাংলা আধুনিক গানের বিপুল রত্নকোষ নিয়ে চর্চা হচ্ছে না।