ঐতিহ্য অক্ষুণ্ণ। তবে সেটা গৌরবের নয়, সে পরম্পরা বাংলার শিক্ষাব্যবস্থায় চলমান অবহেলা ও বঞ্চনার। সুতরাং যাঁরা সরকারি ও সরকার-পোষিত সমস্ত স্কুলের বাচ্চাদের জন্য নীল-সাদা রঙের পোশাক-বিষয়ক নির্দেশে কিছু স্কুলের গৌরবময় ঐতিহ্য বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা করছেন, তাঁরা আশ্বস্ত থাকতে পারেন— পোশাকের সমতা শিক্ষার বৈষম্য দূর করবে না। বরং, সমাজের বিরাট অংশের ছাত্রছাত্রীদের জন্য পরম্পরাক্রমে চলে আসা সুযোগবঞ্চনা থেকে অসমতা যে আরও বাড়বে— এ-কথা হলফ করে বলা যায়।
কেন? শিক্ষার অধিকার আইন হয়েছে। স্কুলে মাইনে নেই। বিনামূল্যে বই দেওয়া হচ্ছে, পোশাক দেওয়া হচ্ছে, খাবার দেওয়া হচ্ছে। তার পরেও বঞ্চনা বাড়ে কী করে? বাড়ার কারণটা নতুন কিছু নয়। যেমন, শিক্ষার অধিকার আইনের আওতা তো কেবল অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। তবুও, নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল। অনেক নতুন স্কুল খুলল, অনেক বাচ্চা স্কুলের নাগাল পেল। কিন্তু, শিক্ষক? কিছু অস্বচ্ছতার অভিযোগ, মামলা-মকদ্দমা, আন্দোলন ইত্যাদির মধ্যে কিছু নিয়োগ যদিও বা হল, প্রতি স্কুলের বাস্তব প্রয়োজন মেনে শিক্ষকের ব্যবস্থা হয়ে উঠল না। প্রাথমিক এমনকি উচ্চ প্রাথমিক স্তরেও এমন স্কুল দেখা যায় যেগুলো চলছে দু’জন মাত্র শিক্ষক নিয়ে, আবার এমন স্কুলও আছে যেখানে বাড়তি শিক্ষকের সংখ্যাটা দৃষ্টিকটু। প্রথম বর্গের স্কুলগুলো সাধারণত শহর থেকে দূরে, যেখানে দরিদ্র ও বঞ্চিতদের সংখ্যাধিক্য, আর দ্বিতীয় বর্গের স্কুলগুলো শহর-গঞ্জের সহজ নাগালের মধ্যে।
শিক্ষা দফতর থেকে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া সহজ নয়, অনেক সময়ই আমাদের অনেক ঘুরপথে তথ্যসংগ্রহ করতে হয়। তেমন ভাবেই ভারত সরকারের ২০১৮ সালের একটা দলিল (এডুকেশনাল স্ট্যাটিস্টিক্স অ্যাট আ গ্লান্স) থেকে দেখতে পাচ্ছি প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিক স্তরে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত (যথাক্রমে ২৩ ও ২৭) মোটামুটি ভদ্রস্থ। কিন্তু, যে-কথাটা আমরা দুই দশক ধরে বলে আসছি, সমস্যাটা গড় হিসাবের নয়, সেটা আঞ্চলিক বৈষম্যের— কোথাও শিক্ষক অদৃশ্যপ্রায়, কোথাও তাঁদের সংখ্যা প্রায় ছাত্রসংখ্যার কাছাকাছি!
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে সমস্যাটা আরও প্রকট। গড়ের দিক দিয়েও হিসাবগুলো উদ্বেগজনক (ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত যথাক্রমে ৩৯ ও ৫৭)। আমাদের থেকে খারাপ অবস্থা কেবল বিহার, উত্তরপ্রদেশ ও ঝাড়খণ্ডে। মনে রাখা ভাল, এ ঐতিহ্য অনেক দিনের, এই সহস্রাব্দের শুরুতে শিক্ষকের অভাব যে সব রাজ্যে সবচেয়ে প্রকট ছিল, সেগুলো পশ্চিমবঙ্গ-সহ এই তিন রাজ্য। যা-ই হোক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষকের সংখ্যায় স্কুলে স্কুলে বিরাট তারতম্য। যেমন, দক্ষিণ ২৪ পরগনার উত্তর কুসুমপুর হাই স্কুলে ছাত্রসংখ্যা ৪৭০০, আর শিক্ষকের সংখ্যা ৩৯! উত্তর ২৪ পরগনার হিঙ্গলগঞ্জে কনকনগর সৃষ্টিধর ইনস্টিটিউশনে ছাত্রসংখ্যা ১২৯৬, শিক্ষক আছেন ১৪। এগুলো নমুনামাত্র। দেখতে চাইলে, রাজ্যের যে-কোনও প্রান্তে শিক্ষকের এই উৎকট অভাব দেখতে পাওয়া যায়। শিক্ষক থাকলেই যে লেখাপড়ার মান খুব উন্নত হয়ে যাবে, তেমন নিশ্চয়তা দেওয়া কঠিন, সমাজব্যবস্থার গভীর অসুখগুলো শিক্ষকদের সংক্রমিত: এ-কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। কিন্তু শিক্ষক না থাকলে স্কুলশিক্ষা বলে যে কিছু হয় না, সেটা বলে দিতে লাগে না। যাদের সঙ্গতি আছে, তারা শিক্ষকের অভাব পূরণ করে শিক্ষাবাজার থেকে ‘পরিষেবা’ কিনে নিয়ে। যে হেতু বহু লোকেরই সেই সঙ্গতি নেই, তাদের ভাগ্য তাদের জুতে দেয় বঞ্চনার ঐতিহ্যের জোয়ালে। একটু খোঁজ নিলেই দেখতে পাওয়া যায়, ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাগত ভবিষ্যৎ তাদের আগ্রহ বা আকাঙ্ক্ষার চেয়ে অনেক বেশি নির্ভরশীল তারা কোন অঞ্চলের বাসিন্দা, তার উপর। রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে এমন অনেক ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে আমাদের দেখা হয়, যারা বিজ্ঞানে যারপরনাই আগ্রহী, কিন্তু পড়তে পারে না, কারণ তাদের স্কুলে বিজ্ঞান পড়ার সুযোগ নেই। ওয়েস্ট বেঙ্গল কাউন্সিল ফর হায়ার এডুকেশনের ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া কিছু জেলার তথ্য থেকে দেখা যে ছবিটা উঠে আসছে, সেটাকে ভয়াবহ বললে কম বলা হয়: কোচবিহার, মালদহ, পুরুলিয়ার মতো জেলায় প্রতি পাঁচটি স্কুলের একটিতেও বিজ্ঞান শাখায় পড়ার সুযোগ নেই।
ব্লকগুলোর ভিতরে বৈষম্য আরও তীব্র। এক শিক্ষকের কাছ থেকে পাওয়া হিসাব বলছে, উত্তর ২৪ পরগনার হিঙ্গলগঞ্জে ২২টি স্কুলের মধ্যে মাত্র একটিতেই বিজ্ঞান পড়ার সুযোগ আছে। কিছু দিন আগেও তিনটি স্কুলে এই সুযোগ ছিল, কিন্তু সম্প্রতি উৎসশ্রী পোর্টালের সুবিধা গ্রহণ করে বেশ কিছু শিক্ষক নিজেদের পছন্দমতো স্কুলে চলে যাওয়ায় দুটো স্কুলে বিজ্ঞান শাখা বন্ধ করে দিতে হয়েছে। আবার বিজ্ঞান শাখা থাকলেই যে সকলে বিজ্ঞান পড়তে পারবে তা নয়, ব্যবস্থার কল্যাণে লেখাপড়ার সঙ্গে প্রাইভেট টিউশনির যোগটা অবিচ্ছেদ্য হয়ে উঠেছে, আর প্রাইভেট টিউশনি ছাড়া বিজ্ঞান পড়ার কথা তো অকল্পনীয়। কয়েক বছর আগে প্রতীচী ট্রাস্ট প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে অশোকেন্দু সেনগুপ্ত দেখেছিলেন, কেরলে বিজ্ঞান পড়া ছেলেমেয়ের অনুপাত ছিল ৪৪ শতাংশ, আর এ-রাজ্যে মাত্র ১৩ শতাংশ! বর্তমানে অবস্থাটা খারাপ বই ভাল হয়নি।
শিক্ষক সংক্রান্ত সমস্যাটা শিক্ষাক্ষেত্রে বৃহত্তর অবহেলার একটি অংশমাত্র। যতই কেউ খোঁজ নেবেন, দেখতে পাবেন পরতে পরতে বঞ্চনার ঐতিহ্য সুরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা। যেমন মিড-ডে মিল। ২০০৩-০৪ সালে প্রাথমিক স্তরে এই প্রকল্প চালুর সময় ছাত্রপিছু তেল-মশলা, জ্বালানি, আনাজপাতি, ডিম ইত্যাদির জন্য ছিল এক টাকা, গত দুই দশকে বাড়তে বাড়তে এখন ৪.৭২ টাকা। গত চার বছরে বেড়েছে মাত্র ৫৯ পয়সা। দুই দশক আগের বরাদ্দটা যতখানি বিসদৃশ রকমের কম ছিল, আজকেও তাই, বিশেষত গত কয়েক বছরে জিনিসের দাম যে তীব্রতায় বেড়েছে সে কথাটা মাথায় রাখলে। ২০১৮-র ‘শিক্ষা আলোচনা’ সংগঠন বাজারের দামের সঙ্গে মিলিয়ে এই খরচের বাস্তব হিসাব কষেছিল ৭.১২ টাকা, এই চার বছরে যে হারে তেল, ডাল, গ্যাস, ডিম ও আনাজের দাম বেড়েছে তাতে হিসাবটা অনেকটাই বেড়ে যাওয়ার কথা। মোট কথা, যতটা দরকার দেওয়া হচ্ছে প্রায় তার অর্ধেক।
একই সমস্যা স্কুল চালানো নিয়ে। কম্পোজ়িট স্কুল গ্রান্ট নামে একটা তহবিল স্কুলগুলোকে দেওয়া হয় দৈনন্দিন খরচ মেটাবার জন্য। ২০১৮ সালে ‘শিক্ষা আলোচনা’-র বাস্তব চাহিদা ভিত্তিক হিসেব ছিল, প্রাথমিক স্কুলগুলোকে যথাযথ ভাবে চালাতে গেলে এই গ্রান্টের টাকা প্রায় পাঁচগুণ বাড়ানো দরকার। প্রয়োজনের তুলনায় কম হলেও, সরকার এই তহবিলে বরাদ্দ কিছুটা বাড়িয়েও দেয়। কিন্তু, ঐতিহ্য ভুলে যাওয়া সহজ নয়, অতি সম্প্রতি এই বরাদ্দ ২০১৮-র তুলনাতেও অনেকটা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, ওয়াকিবহাল মহলের আশঙ্কা, এটা আরও কমবে। একই রকম সমস্যার মুখে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলগুলোও।
শিক্ষার সুষম প্রসার যে আমাদের রাষ্ট্রীয় কর্মসূচির মধ্যে নেই, তা নগ্ন ভাবে দেখা দিল কোভিড পরিস্থিতিতে। প্রায় দুই বছর স্কুলগুলো বন্ধ রাখা হল, কিন্তু ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার কী হবে তা নিয়ে কোনও কার্যকর পদক্ষেপ হল না। ফলে এক দিকে লক্ষ লক্ষ শিশু শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হল, আর অন্য দিকে তুলনামূলক ভাবে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকা কিছু ছেলেমেয়ে শিক্ষাবাজার থেকে মূল্য দিয়ে নিজেদের ভবিষ্যৎ ক্রয় করে নিল। এটা তো আকস্মিক নয়। বিভাজনের যে চলমান ঐতিহ্য আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রটিকে সঙ্কুচিত রেখেছে কোভিডকালেও তা এক ভিন্নতর রূপ ও মাত্রা পেল।
ঐতিহ্য শব্দটির অর্থ, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিধান বলছে, ‘ইতিহ, অর্থাৎ পরম্পরাগত উপদেশ (প্রবাদ)।…’ রবীন্দ্রনাথ থেকে নিয়ে অমর্ত্য সেন পর্যন্ত, ভারতীয় মননের দিশারি-পরম্পরা যে উপদেশটি দিয়ে এসেছেন তা হল, শিক্ষার সমানাধিকার। কিন্তু, সমানতা জিনিসটা নানা লোকের কাছে নানা রকম। সরকারের কাছে সহজ হচ্ছে পোশাকের আড়ালে বৈষম্যের কুৎসিত চেহারাটাকে ঢেকে দেওয়া। আর যাঁরা ঐতিহ্য নিয়ে চিন্তিত, তাঁদের কাছে সমতার অর্থ হল যা চলে আসছে তাকেই, বিনা প্রশ্নে, বিনা যুক্তি-যোগে, চালিয়ে নিয়ে যাওয়া। মারে ঐতিহ্য, রাখে কে?