হাসপাতাল থেকে ফেরা রোগীর কুশলসংবাদ নিতে এসেছেন পরিবারের এক তরুণ সদস্য। রান্নাঘরে চা-জলখাবার তৈরি করতে করতে বসার ঘরের সংলাপ কানে আসছে। ‘ডাক্তার কী বললেন’ ‘সাবধানে থাকবেন কিন্তু’ ইত্যাদি শিষ্টালাপ পেরিয়ে কথা যথারীতি ঢুকে গিয়েছে রাজনীতির মাঠে। চায়ের কাপ হাতে তুলে দিতেই অতিথির প্রশ্ন, “মোদীকে আপনার কেমন লাগে?” মোটেই ভাল লাগে না, বলতেই পাল্টা প্রশ্ন, “তা হলে কি মমতা যা করছেন, সব মেনে নিতে হবে?”
কী মুশকিল! মোদী আর মমতা, দু’জনেই বিস্তর ভুলভাল কাজ করছেন, সেগুলোর কোনওটা মানার মতো নয়। সে কথা বলতেই ঠকাং করে ডিশের উপর নামল। মানে, ব্যস, ঢের হয়েছে। মমতা বনাম মোদী, এই হল খেলা। বাইরে শট মেরে লাভ কী? ভাই-সমান তরুণটি যেন নিমেষে খাদের ও-পারে চলে গেল। অতঃপর সেতু বাঁধার পালা—“আর একটু টম্যাটো সস নেবে?”
মনে পড়ল, ক’দিন আগে এক আন্তর্জাতিক সাংবাদিক সম্মেলনে এক তরুণীর কথাগুলো। ঘরভর্তি লোককে লিবার্টি পেরাল্টা প্রশ্ন করেছিল, “বাবার সঙ্গে বেড়াল ছাড়া আর কিছু নিয়ে কথা বলতে পারি না। বাকি জীবন কি কেবল বেড়াল নিয়েই কথা বলব?” ফিলিপিন্সের মেয়ে লিবার্টি, কাজ করে হাওয়াই পাবলিক রেডিয়োয়। হনোলুলুতে এসেছেন ফিলিপিন্সের নোবেলজয়ী সাংবাদিক মারিয়া রেসা, এসেছিল বক্তৃতা শুনতে। প্রশ্নোত্তর পর্বে উঠে বলল, “আমার বাবা রডরিগো দুতার্তে-কে ভালবাসে।” বলেই কান্না। নিমেষে সাড়ে চারশো সাংবাদিকের সভা নিস্তব্ধ। মাইক হাতে নীরব মারিয়াও। একটু আগেই মারিয়া খবর দিয়েছেন, দুতার্তে সরকার তাঁর সংবাদসংস্থা ‘র্যাপলার’-এর অনুমোদন ফের খারিজ করেছে। এই সেই দুতার্তে, যাঁর আমলে ড্রাগনিয়ন্ত্রণের অছিলায় অগণিত নাগরিকের উপর লাগাতার হামলা হয়েছে। সেই গণহত্যার খবর প্রকাশ করায় মারিয়ার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দায়ের করেছে দুতার্তে সরকার, জেলেও পাঠিয়েছে। নিষ্ঠুর ও হিংস্র ট্রোলিং চালিয়েছেবেনামি অ্যাকাউন্ট থেকে। সব অভিযোগই মিথ্যে। কিন্তু, মারিয়ার কথায়, “যে দেশে আইনের শাসন ঝুঁকতে ঝুঁকতে ভাঙতে বসেছে, সেখানে সবই সম্ভব, তাই না?”
তা তো বটেই। না হলে গণধর্ষণের খবর করতে-যাওয়া সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পান কী করে হয়ে যান ‘সন্ত্রাসবাদী,’ বিজেপি-অনুগতদের ‘ফেক নিউজ়’ ধরিয়ে-দেওয়া মহম্মদ জ়ুবের কী করেই বা ‘হিন্দুবিদ্বেষী’ পরিচয় নিয়ে জেলে যান। কাশ্মীরে তো স্বাধীন সাংবাদিকের ‘দেশদ্রোহী’ ছাপ এড়ানোই প্রায় অসম্ভব। এক হাতে জামিনের আপিল লেখা, অন্য হাতে খবর লেখা, এই আজ সাংবাদিকের বিধিলিপি। নোবেল শান্তি পুরস্কার তো নস্যি। গত বছরের অপর নোবেলজয়ী সাংবাদিক, রাশিয়ার দিমিত্রি মোরাতভ, তাঁর কাগজ নোভায়া গেজ়েটা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হতেই। বেচে দিয়েছেন নোবেল পদক। মারিয়া এখনও ‘র্যাপলার’ চালাচ্ছেন— “আমরা মানিয়ে নেব, টিকে যাব, আরও ভাল করব। ক্ষমতাকে প্রশ্ন করব, যেমন বরাবর করেছি,” উদ্বোধনী বক্তৃতায় বললেন তিনি।
কিন্তু সরকার আর সাংবাদিকের মধ্যে যে অসংখ্য মানুষ, তাঁরা? অনাস্থার বদ-হাওয়া বাইরে থেকে ঢুকে এলোমেলা করে দিচ্ছে তাঁদের ঘর। পশ্চিমবঙ্গে এ হয়তো অচেনা নয়— কংগ্রেস-সিপিএম, বিজেপি-তৃণমূল দ্বন্দ্বে বহু সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে। তবু আজ সঙ্কট একটু আলাদা। আগে তর্ক হত দারিদ্র নিরসনের উপায় নিয়ে— মুক্ত বাজার, না দিশি শিল্পের সুরক্ষা? আজ প্রশ্ন— ভারতে গরিব আছে, না কি নেই? এক পক্ষ দারিদ্র, কর্মহীনতা, বা পুলিশি নিগ্রহের যে তথ্যকে সামনে রেখে আন্দোলন করছে, অন্য পক্ষের মতে সে সব হিসাব ভুল, সংখ্যাবিদরা ষড়যন্ত্রকারী, প্রতিবাদীদের টিকি বাঁধা কোনও এক খুঁটিতে। প্রতিটি তথ্যের বডি-সার্চ চলছে— দাঙ্গার এ ছবি কবে তোলা, কোথায়? কোন ফর্মুলায় কর্মহীনতার হিসাব কষা হয়েছে? টুইটার-হোয়াটসঅ্যাপে এক-একটা খবর প্রচার হয়, আর শুরু হয় নির্মোক-নৃত্য— তথ্যের খোসা ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে সত্যের বীজে পৌঁছনোর মরিয়া চেষ্টা। এই সুযোগে ছায়া ধরার ব্যবসায়ীরা মাঠে নেমে পড়েছে— ঝাঁকে ঝাঁকে এনজিও রাশি রাশি ওয়ার্কশপে ছাত্রছাত্রী, সাংবাদিক, সমাজকর্মীদের ‘ফেক নিউজ়’ ধরার কৌশল শেখাচ্ছে, রাষ্ট্রপুঞ্জ-সহ বড় বড় অনুদান সংস্থা ডলারের ব্যাগ নিয়েতৈরি। এই ছায়াযুদ্ধে কত লক্ষ ডলার খরচ হচ্ছে, খোদায় মালুম।
অথচ আগে ভাবা হত, সত্য আলোর মতোই প্রকাশস্বভাব। সামনে আনলেই তাকে চেনা যায়, বোঝা যায় সত্যবাদী কে। এখন নানা সমীক্ষায় ধরা পড়ছে, নির্ভরযোগ্য কাগজ-চ্যানেলও মানুষের আস্থা পাচ্ছে না। সাংবাদিক যতই খোঁজখবর করে খবর দিন, নেতাদের আঁতে ঘা লাগলে এতই কুৎসার কাদা ছোড়া শুরু হয় যে, পাঠকের বিশ্বাস টাল খেয়ে যাচ্ছে। হয়তো জ়ুবের সত্যের প্রহরী, বা হতে পারে স্রেফ হিন্দু-বিদ্বেষী। কাশ্মীরের জেলবন্দি সাংবাদিকরা পেশার প্রতি দায়বদ্ধ, না কি হয়তো পাকিস্তানের প্রতি? প্রেসিডেন্ট দুতার্তের শাসনকালে যে কুড়ি হাজার মানুষ নিহত হয়েছে, হতেই পারে তারা সকলে ড্রাগ নিত। কিছু একটা ধরে নিয়ে নিজের ‘তথ্য-জগৎ’ তৈরি করছে প্রত্যেকে।
আমাদের অজানতে সমাজমাধ্যমই সেই জগৎ গড়ে দেয় অনেকখানি। যে আমার বন্ধুর বন্ধু, সে ফেসবুকে আমার বন্ধু হয়, তার সূত্রে যোগ হয় আরও বন্ধু। যারা বাস করে পাশাপাশি, তাদের বন্ধুবলয় যত দূরে যায়, তত তাদের জগৎ আলাদা হতে থাকে। কী খবর তারা দেখছে, তার নির্বাচনেও কাজ করে অদৃশ্য হাত। গবেষকদের অভিযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানিগুলো নিজেদের লাভের স্বার্থে তৈরি করে এমন এক ‘তথ্য-তন্ত্র,’ যেখানে বিদ্বেষে চোবানো, বিদ্রুপে ভাজা, মুচমুচে মিথ্যাগুলো অনেক ফেরি হয়, নিরামিষ তথ্যগুলো পড়েই থাকে। “সমাজমাধ্যম যেন শয়তানের মেগাফোন, মানুষের জঘন্যতম দিক তা বাইরে নিয়ে আসে,” বললেন মারিয়া। অথচ, সমাজমাধ্যম আর বাস্তব— দুটোকে আলাদা জগৎ ভাবলে মস্ত ভুল হয়, সতর্ক করলেন তিনি। ফেসবুক, টুইটারের হিংসা বাইরেও আগুন জ্বালায়। নেট-দুনিয়াতে ছাড় পেয়ে যায় যে দুষ্কৃতীরা, তারা অধরা থাকে বাইরেও। সে তো আমরাও দেখছি। দিল্লিতে আগুন-ঝরানো টুইট থেকে দাঙ্গায় গরিবের ঘর জ্বলল, তবু অনলাইন হিংসা আটকানো গেল না। অথচ, ফেসবুকে নেতাদের নিয়ে কেউ রঙ্গব্যঙ্গ করলে কলকাতার পুলিশ এমন দৌড়ে গিয়ে ধরে, যেন সে দাঙ্গা বাধিয়েছে।
সেই সঙ্গে, সমাজমাধ্যমে তৈরি দূরত্ব এখন সংসারে, সমাজেও দূরে ঠেলছে আমাদের। যে যার নিজের পছন্দের তথ্যজগতের চার পাশে সাউন্ড-প্রুফ দেওয়াল তুলে দিচ্ছে। মাছভাতের পাতে, সঙ্গমের শয্যাতেও নীরবতার দেওয়াল থাকে তেমনই নিরেট। টম্যাটো সস, কিংবা পোষা বেড়াল, ছোট ছোট সেতু কোনও মতে ধরে রাখে সম্পর্ককে। উন্মত্ত দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতার বাইরে যে কর্মময়, প্রাণময় নাগরিক পরিমণ্ডল, তাকে যেন ভুলতে বসেছি। এমনকি সেখানে আমরা তত স্বচ্ছন্দ নই আর, কারণ সামনা-সামনি লোকজন দেখলে কে কার কথায় ‘লাইক’ দেয়, তা ধরা যায় না। আর তা না বুঝলে কথা শুরু করাই যায় না। এ ওর দিকে চেয়ে কেবলই আন্দাজ করতে হয়, ইনি কোন দিকে? শিয়রে মৃত্যু নিয়ে, ঝাপসা চোখে নার্সের দিকে তাকিয়েও ঠাহর করার চেষ্টা চলে— মোদী, না কি মমতা?