কোনও মতে পাস করার মতো ছাত্রছাত্রীও এখন অনলাইনে যৌথ প্রচেষ্টায় ৮০-৯০ জোগাড় করে ফেলছেন।
যেহেতু এই অধমের পেশা পড়া এবং পড়ানো, তাই শিক্ষার নিত্যকর্ম নিয়ে কিছুটা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বর্তমান। কোভিডের সময়ে বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে পড়াশোনা নিয়ে ভীষণ চিন্তিত ছিলাম। একটা প্রজন্মের শিক্ষার ভবিষ্যৎ নিয়ে যত অক্ষর আমরা রচনা করেছি, তা পাশাপাশি সাজালে চাঁদের বুড়ির কাছে পৌঁছে যেত উপসংহার। পৃথিবীর সব তোতাপাখির পেটে খসখস শব্দ হত।
তার মধ্যে সবথেকে গভীর প্রশ্ন ছিল, পরীক্ষা হবে কী ভাবে? বিশেষত, অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়া বেশ গোলমেলে কাজ। টুকলি রোখার নজরদারির জন্যে আধুনিক প্রযুক্তির কিছু বিধান থাকলেও তা অন্য অনেকের মতই ব্যবহার করেনি এই রাজ্যের বিভিন্ন স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়।
কিন্তু কোভিড-শেষে যখন সশরীরে ক্লাস শুরু হল, তখন আবার বিভিন্ন জায়গায় অনলাইন পরীক্ষার জন্যে ছাত্র আন্দোলন! বেশিরভাগ শিক্ষকই চান, পড়ুয়ারা ভাল ফল করুক। কিন্তু সবাইকে সরকারি ভাবে টোকার অধিকার দিলে আখেরে যে গোটা রাজ্যে শিক্ষাব্যবস্থার সর্বনাশ, এই বিষয়টা অস্বীকার করার উপায় নেই। এমন কথা শোনাই যায় যে পারমাণবিক বোমা ফেলেও একটা জাতিকে ততটা ধ্বংস করা যায় না, যতটা করা যায় তার শিক্ষাব্যবস্থাকে সচেতন ভাবে গুলিয়ে দিয়ে।
সত্তরের দশকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর স্তরের বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিতে শীর্ষস্থানের অধিকারী এক মাস্টারমশাইয়ের ছোটবেলার স্কুলের গল্প শুনেছিলাম। প্রাথমিক স্তরে কোনও একটি পরীক্ষায় তিনি বিশেষ লিখে উঠতে পারেননি। ফেল করেন। কিন্তু সকলেই জানে ছেলে ভাল। ফলে মাস্টারমশাই তাঁর পিতৃদেবকে ইস্কুলে ডেকে বলেছিলেন, ‘‘আপনার পুত্র দয়া করিয়া পাস।’’
সেই অপমান ছোট্ট ছেলেটির জীবন থেকে মুছে যায়নি। সময়ের নিয়মেই অধ্যাপনা থেকে অবসর নিয়েছেন। তার আগে নিজের সারা জীবন মন দিয়ে পড়িয়েছেন কলকাতার এক বিশিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। প্রচুর বকাবকি করেছেন ফাঁকি-মারা ধেড়ে খোকাদের। তার সাক্ষী আমিও। সৌভাগ্যবশত বুদ্ধি কম হলেও মুখস্থ-টুখস্থ করে সামলে নিয়েছি পরীক্ষা। ‘দয়া’ ছাড়াই পাস করেছি। বাকিরাও পাস, এবং তাদের মধ্যে প্রতি বছর এক-দু’জন ‘দয়া করে’।
নিজে যে একবার ‘দয়া’য় পাস করেছিলেন, ভুলতে পারেননি হিরের টুকরো ছাত্র এবং পরবর্তীকালের মাস্টারমশাই। ফেল কখনও করিয়েছেন বলে তাঁর কিংবা তাঁর ছাত্রদেরও মনে পড়ে না। সেই রকম মাস্টারমশাইয়ের ছাত্র হিসেবে উদারবাদী ভাবনায় অনেকেই ফেল করানোর বিরোধী। ছাত্রছাত্রী কোনও বিষয়ে ভাল ফল না করলে তাকে সময় দেওয়া উচিত পড়াশোনা করার। বারে বারে সুযোগ দিলে যদি সে শেষমেশ পাস করতে পারে, তাতে দোষের কী? মানুষ ‘কী জানে না’, সেটা খোঁজার চেষ্টা করা পরীক্ষাব্যবস্থার দায় নয়। তার উদ্দেশ্য মানুষ কতটা জানে, সেটুকু খুঁজে বার করার। তাকে প্রস্তুত করা, যাতে সে পরবর্তী সময়ে অর্জিত শিক্ষাকে কাজে লাগাতে পারে।
পরীক্ষা নিয়ে আরও একটি কথা বলা জরুরি। যে কোনও পরীক্ষার নিজস্ব কিছু ভুল থাকে। অর্থাৎ কোনও পরীক্ষাপদ্ধতিই মেধানির্ধারণে পরম সত্যের সন্ধান দেয় না। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র থেকে শুরু করে তার উত্তরের মূল্যায়ন— প্রতিটি বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে সঠিক হওয়া অসম্ভব। সেখানে নম্বর দেওয়া থেকে নম্বর যোগ করা— সবেতেই ভুলের কিছু শতাংশ লুকিয়ে থাকে। তাই প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলির ক্ষেত্রে এখন আর খাতায় ‘উত্তর’ লিখতে হয় না। বেশিটাই ‘টিক’, যাতে অন্তত মূল্যায়ন নৈর্ব্যক্তিক হয়। অঙ্ক বা বিজ্ঞানের পরীক্ষায় হয়ত এ ভাবে সমস্যার আংশিক সমাধান সম্ভব। কিন্তু মুশকিল সমাজবিজ্ঞানের মতো বিষয়ে। যেখানে ভাবনা ব্যক্ত করতে বেশ খানিকটা বলতে বা লিখতে হয়। অর্থাৎ যে কোনও পরীক্ষাপদ্ধতি, সে যতই বিজ্ঞানভিত্তিক হোক, মূল্যায়নের কিছু না কিছু সীমাবদ্ধতা থাকবেই। দুর্নীতির প্রসঙ্গে ঢুকছি না। সেটা হলে সোনায় সোহাগা!
পরীক্ষার সমালোচনায় এত কথা লেখার পরেও বলতে হয় যে, মোটের উপর নিয়মানুবর্তী পরীক্ষাপদ্ধতি বিশ্বের একটি সর্বসম্মত ধারা। ফলে হঠাৎ করে সেটা একেবারে তুলে দেওয়া বা অকারণে তার বিপুল পদ্ধতিগত পরিবর্তন সমাধানের পথ নয়।
পশ্চিমবঙ্গে আপাতত কোভিডের প্রকোপ কম। সেখানে কিছু পড়ুয়ার আন্দোলন অনলাইন পরীক্ষা চালু রাখা নিয়ে। এতে মুশকিল কোথায়? মুশকিল হল অধিকাংশ লোক মনে করেন, অতিমারী পরিস্থিতিতে অনলাইন পরীক্ষায় এমন হয়েছে যে, প্রশ্ন পাওয়ার পর অন্যকে দিয়ে সমাধান করিয়ে নিয়ে নিজের হাতে লিখে তা জমা দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, যে নিজে লিখেছে আর যে টুকেছে, তাদের মধ্যে কোনও পার্থক্য উত্তরপত্র দেখে বোঝা অসম্ভব!
সরকার বা যে কোনও সংস্থা অবশ্য অনলাইনেও প্রযুক্তির সাহায্যে পরিদর্শকের ব্যবস্থা রাখতে পারত। তাতে পুরো সমস্যা না-মিটলেও পরীক্ষার্থীরা কিছুটা সতর্ক থাকতে বাধ্য হতেন। ভিডিও ক্যামেরায় তাঁদের উপর নজর রাখা যেত। কিন্তু এমন কিছু ভাবা হচ্ছে না।
একই ধারায় সুষ্ঠু পরীক্ষাব্যবস্থা চাইছেন না ‘অনলাইনবাদী’ আন্দোলনরত পড়ুয়ারা। তাঁদের মূল দাবির একটা অনুসিদ্ধান্ত হল— বই দেখে বা অন্যের সাহায্য নিয়ে পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। তুলনা আসছে আমেরিকার। সেখানে নাকি বই খুলে পরীক্ষা হয়! কেউ ভাবছেন না যে, সেই পরীক্ষার প্রশ্নপত্র এমন ভাবে তৈরি করা হয় যে, পরীক্ষার্থীরা নিজে ভাবতে বাধ্য। অর্থাৎ মুখস্থ করে বা বই দেখে লাভ নেই। ছাত্রছাত্রীরা প্রশ্ন তুলছেন, সম্পূর্ণ পাঠ্যবিষয় ভাল ভাবে না পড়িয়ে পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। এটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য এবং এর একমাত্র সমাধান পরীক্ষার দিন পিছিয়ে নতুন করে ক্লাস শুরু করা। কিন্তু পড়ানো হয়নি বলে অনলাইনে পরীক্ষা দেওয়ার দাবি মোটেই স্বাভাবিক অনুসিদ্ধান্ত নয়।
সবাই টুকে পাস করলে অসুবিধে মূলত যাঁরা ভাল ভাবে পড়াশোনা করতে চাইছেন, তাঁদের। একটা বড় অংশের পড়ুয়া শিক্ষালাভে উৎসাহী নন। বরং তাঁদের পাখির চোখ কোনওক্রমে পাস করে একটা ডিগ্রির কাগজ হাতে পাওয়া। তাতে কী মোক্ষলাভ জানা নেই। কিন্তু সেটা চাই! এটাই দাবি। আর এই দাবির মুখে অল্প কয়েকজন মেধাবী ছাত্রছাত্রী ভাল ফল করলেও তাঁদের আলাদা করা অসম্ভব। কারণ, কোনও মতে পাস করার মতো ছাত্রছাত্রীও এখন অনলাইনে যৌথ প্রচেষ্টায় ৮০-৯০ জোগাড় করে ফেলছেন। অর্থাৎ, পরবর্তীকালে ‘কোভিড ডিগ্রিধারী’ হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া হবে মেধাবী পড়ুয়াদেরও।
পশ্চিমবঙ্গে এই মুহূর্তে শিক্ষাসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে প্রচুর গোলমাল, বিশেষত রাজ্য সরকারের আওতায়-থাকা প্রতিষ্ঠানগুলির। তার মধ্যে সরকারি ক্ষেত্রে যাদবপুর বা প্রেসিডেন্সি বা বেসরকারি ক্ষেত্রে সেন্ট জেভিয়ার্সের মতো কিছু প্রতিষ্ঠান হয়ত এখনও স্বমহিমায়। কিন্তু কত শত কলেজ এ রাজ্যে আছে? বা কত হাজার স্কুল? এর পিছনে যে অন্তত কয়েক’শ কোটি টাকা বিভিন্ন খাতে খরচ হয় সে নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। সেই পুরো বিষয়টিকে গুলিয়ে দেওয়ার যে চেষ্টা হচ্ছে, তা থেকে আশু মুক্তির পথ খোঁজা প্রয়োজন।
পশ্চিমবঙ্গে সত্তরের দশকে শিক্ষায় বিপুল গোলমাল হয়েছিল। একাধিক বছর নষ্ট হয়েছিল অনেক পড়ুয়ার। সেখান থেকে একটা সুষ্ঠু ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্যে শুরুর দিকের বামফ্রন্ট সরকার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ক্ষমতাবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষায় নিম্নগামী প্রবণতাও তাদের আমলেই ঘটেছে। ইংরেজি তুলে দেওয়া থেকে নামী সরকারি স্কুলে লটারি— সবই। শিক্ষায় রাজনীতির দখলদারিও বামফ্রন্ট আমলে ভাল ভাবে শুরু হয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি তৃণমূল সরকারের প্রবণতা তার চেয়ে বহুগুণ বেশি। ঘটনাচক্রে, তৃণমূলের বিরোধী বাম বা বিজেপির ছাত্র সংগঠনগুলির অবস্থানও পরিষ্কার নয়। যাদবপুরের মতো প্রতিষ্ঠানেও বাম বা অতিবাম ছাত্রনেতারা কী চাইছেন সেটা বোঝা শক্ত। কারণ, সেখানেও কিছুদিন আগে পড়ুয়ারা অনলাইনে পরীক্ষা চেয়ে হইচই করেছিলেন।
শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে যে ঘটনাপ্রবাহ চলছে, এমন এক পরিস্থিতিতে তৃণমূল-সমর্থিত কিছু ছাত্রছাত্রীর স্লোগানকে সম্বল করে রাজ্য সরকার যদি পরীক্ষাপদ্ধতি গুলিয়ে দেওয়া মেনে নেয়, তার ফল আগামী বহু বছর ধরে ভোগ করতে হবে।
(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।