Donald Trump

যত বেশি জানে তত কম মানে

উগ্র হিন্দুত্ববাদী বা উগ্র ইসলামি মৌলবাদীদের মতোই ট্রাম্পের সমর্থক উগ্রপন্থী হোয়াইট খ্রিস্টান ন্যাশনালিস্টরা বিজ্ঞান বা কলা, কোনওটাতেই বিশ্বাস করেন না। হীরক রাজাও করতেন না।

Advertisement

পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৭ মার্চ ২০২৫ ০৭:৪৭
Share:

এরা যত বেশি জানে, তত কম মানে— হীরক রাজ্যের সেই ভয়ঙ্করকথাগুলোই এই মুহূর্তে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষিত সরকারি নীতি। সম্প্রতি সে দেশের ডিপার্টমেন্ট অব এডুকেশন তাঁর কলমের এক খোঁচায় ইতিহাসহয়ে গিয়েছে।

Advertisement

কী পরিণতি হতে পারে এই ঘটনার? এর ফলে ফেডারাল (কেন্দ্রীয়) সরকার শিক্ষায় আর কোনও অর্থ বরাদ্দ করবে না। ফেডারাল এডুকেশন ডিপার্টমেন্টের কয়েক লক্ষ মানুষের চাকরি যাবে, নিউ ইয়র্ক থেকে ক্যালিফোর্নিয়া, বস্টন থেকে হিউস্টন। সরকারি শিক্ষা বিভাগের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষক-শিক্ষিকা, অশিক্ষক-কর্মচারী, লাইব্রেরিয়ান প্রত্যেকে রাতারাতি কর্মহীন হয়ে পড়বেন। কোনও সরকারি গ্রান্ট বা স্কলারশিপ আর দেওয়া হবে না। বিদেশের ছাত্রছাত্রীদের সে দেশের কলেজ বা ইউনিভার্সিটিতে পড়ার স্বপ্ন শেষ হয়ে যাবে।

আরও আছে। আমেরিকার খ্যাতনামা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অব হেলথ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। অতি উন্নত মানের বৈজ্ঞানিক স্বাস্থ্য গবেষণা বন্ধ হবে। হেলথ সেক্রেটারি রবার্ট কেনেডি জুনিয়র বলেছেন, ভ্যাকসিনের কোনও প্রয়োজন আর নেই। তিনি বলেছেন, ভ্যাকসিন রোগ প্রতিষেধকের কাজ করে, এ কথা সত্য নয়। অর্থাৎ আমেরিকায় পোলিয়ো, মেনিনজাইটিস, জলাতঙ্ক, মাম্পস, বসন্ত, প্লেগ, শিঙ্গলস, কোভিড জাতীয় মারাত্মক প্রাণঘাতী রোগের প্রতিষেধক দেওয়ার তিনি বিরোধী। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অব হেলথ বন্ধ হয়ে গেলে এই সমস্ত রোগ এবং ভবিষ্যতে বিবর্তিত হওয়া আরও অসংখ্য সম্ভাব্য রোগের কারণ ও প্রতিষেধক আবিষ্কার করার যে গবেষণা গত পৌনে শতকধরে আমেরিকার মতো দেশে চলছে, সব বন্ধ করে দেওয়া হবে।

Advertisement

এ বার আসি আর্টস-এর কথায়। ন্যাশনাল এনডাওমেন্ট ফর দ্য আর্টস বন্ধ করে দেওয়া হবে। ঠিক উগ্র হিন্দুত্ববাদী বা উগ্র ইসলামি মৌলবাদীদের মতোই ট্রাম্পের সমর্থক উগ্রপন্থী হোয়াইট খ্রিস্টান ন্যাশনালিস্টরা বিজ্ঞান বা কলা, কোনওটাতেই বিশ্বাস করেন না। হীরক রাজাও করতেন না। শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীরা চিরকালই স্বৈরাচারী রাজাদের খতমের তালিকায় উপরের দিকে থেকেছেন। হিটলার মুসোলিনির সময় থেকেই উগ্রপন্থী ফ্যাসিস্ট ও নাৎসিরা প্রথমেই বুদ্ধিজীবী আর্টিস্ট সাহিত্যিক কবি চলচ্চিত্র নির্মাতাদের খতম করে দিয়েছে। একাত্তরেও বাংলাদেশে আমরা চোখের সামনে তা ঘটতে দেখেছি। দেখেছি চিলিতে পিনোশের ঘাতকদের হাতে গায়ক কবিদের শেষ হয়ে যেতে। গুয়াতেমালা, এল সালভাদর, ইন্দোনেশিয়া থেকে শুরু করে দক্ষিণ আফ্রিকা, ফিলিপিনস সর্বত্রই একই ঘটনা।

ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন— দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর সুপারপাওয়ার আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশ্রেষ্ঠ এক রিসার্চ ফাউন্ডেশন— বন্ধ হতে চলেছে। বিখ্যাত সব সরকারি মিউজ়িয়ম— স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউশন, হলোকস্ট মিউজ়িয়ম, আফ্রিকান আমেরিকান ইতিহাসের মিউজ়িয়ম, কচুকাটা করে শেষ করে দেওয়া নেটিভ আমেরিকানদের জন্যে তৈরি করে দেওয়া জাতীয় সংগ্রহশালা— সব বন্ধ। আমাদের নিউ ইয়র্ক শহরের মেট্রোপলিটান মিউজ়িয়ম অব আর্টস, মিউজ়িয়ম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রিও বন্ধের তালিকায়। স্বৈরাচারের সবচেয়ে বড় শত্রু বোধ হয় ইতিহাস। ইলন মাস্ক তো প্রকারান্তরে বলেই দিয়েছেন, হলোকস্টের ইতিহাস মনগড়া, অতিরঞ্জিত। যুক্তির দিন, শিক্ষার দিন, তর্কের দিন, প্রশ্নের দিন শেষ। এখন প্রশ্নহীন আনুগত্যের দিন। আমেরিকাতেও, ভারতেও, বাংলাদেশেও।

যে সব বাঙালি, ভারতীয়, বাংলাদেশি, আরব দেশের লোক, এবং শ্রমিক ইউনিয়নগুলো ভোট দিয়েছে, তাঁদের অনেকেই জানতেন, এগুলি হতে চলেছে। কিন্তু তাঁরা উদাসীন। তাঁরাও ফ্যাসিস্ট ট্রাম্পের মতোই জনশিক্ষায় বিশ্বাস করেন না, আর্টস তুলে দিতে চান, এবং বিজ্ঞানে গভীর অবিশ্বাস পোষণ করেন। পপুলিস্ট ট্রাম্প এবং তাঁর দলবল এই কথাটা জানেন। পপুলিজ়মের গোড়ার কথাই হল মগজধোলাই। আর, প্রাইভেট মিডিয়ার নতুন যুগে মগজধোলাই এখন এক কুটিরশিল্প।

আজ আমেরিকায় যা হচ্ছে, তা হিটলার মুসোলিনির ফ্যাসিবাদ, নাৎসিবাদেরই এক নয়া জমানা। এখন হিটলারের মতো বিরোধীদের রাস্তায় দাঁড় করিয়ে মাথায় গুলি করা হবে না, অথবা গ্যাস চেম্বারে মাস-কিলিং হবে না। কিন্তু অর্থনৈতিক নিষ্পেষণে, অভিবাসীদের উপর অত্যাচারে, এবং পরিবেশ-জলবায়ুর কৃত্রিম ভাবে ঘটানো বিপর্যয়ে, ভয়ঙ্কর রোগে, দুর্ভিক্ষে কোটি কোটি মানুষেরমৃত্যু হবে। সারা পৃথিবীর সমগ্র জেলবন্দির এক-চতুর্থাংশ আজ আমেরিকার জেলে। বিশ্বাস না হয়, গুগল বলে দেবে।

আমরা এক নতুন অন্ধকার যুগে প্রবেশ করলাম। এক জীবনেই শিক্ষালোকিত, উজ্জ্বল, আধুনিক আমেরিকা থেকে অশিক্ষা-উদ্দীপিত, বন্দুকবাজ, ভয়ঙ্কর আমেরিকা। এক জীবনেই চমস্কি থেকে ট্রাম্প, আইনস্টাইন থেকে ইলন মাস্ক। এক জীবনেই রবীন্দ্রনাথ থেকে আ‘মোদী’ত ভারত।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement