ঐতিহ্যধারা: অর্মত্য নেল তার ‘প্রতীচী’ বাড়িতে বসে বিশ্বভারতীর ছাত্র ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলছেন। শান্তিনিকেতন। ৫ জুলাই। —পিটিআই।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ সত্যি-সত্যি ঘটেছিল কি না, এ বিতর্কে পুরাতত্ত্ববিদরা একমত নন। তবে কুরুক্ষেত্রের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে পরবর্তী কালে, এতে অনেক ইতিহাসবিদ সায় দেবেন। ভারতবর্ষে ছোট বা বড় আকারে কুরুক্ষেত্র ফিরে এসেছে বার বার।
ইদানীং কালে শান্তিনিকেতনে অশান্তি এবং ‘ইন্ডিয়া’ বনাম এনডিএ জোট সংগ্রামের মধ্যে অবশ্যই একটা ছোট-বড় ভেদ আছে, সহজেই বোঝা যায়। কিন্তু যা অত সহজে ধরা দেয় না, তা হল উভয়ের প্রকৃতিগত সাদৃশ্য। এ দুইয়ের মধ্যে যে গভীর যোগসূত্র আছে, তাকে ধরতে পারলে সাম্প্রতিক ইতিহাসের ধারা স্পষ্টতর হয়ে উঠবে। প্রকৃতপক্ষে এখন একটাই যুদ্ধ চলছে, ধর্ম ও অধর্মের লড়াই। ধর্ম কোনটি ও অধর্ম কোনটি, তা নিয়ে নির্বাচনী বিতর্ক চলছে ও চলবে। কিন্তু মনে মনে প্রত্যেক ভারতীয় জানেন, কোনটি মানবমৈত্রী-পন্থী ও কোনটি পরহিংসা-প্রসূত। যারা হিংসুক ও হিংস্র, তারাও হিংসা অনুভব করে বলেই ‘আমরা ও ওরা’ ভেদবুদ্ধি চালিত আদর্শ সচেতন ভাবে গ্রহণ করে। শুধু সুচিন্তিত আদর্শ নয়, দেখতে পাচ্ছি গভীরতর হৃদয়াবেগের সংঘাতও। এক পক্ষে সহাবস্থানের শুভবুদ্ধি, অন্য পক্ষে ‘ওদের’ উপর পীড়নেচ্ছা।
শান্তিনিকেতনের সংঘাত আপাতদৃষ্টিতে অমর্ত্য সেন ও বিশ্বভারতীর মধ্যে জমি নিয়ে লড়াই, যে জমিতে রবীন্দ্রনাথের প্রাথমিক শিক্ষাদর্শে অনুপ্রাণিত প্রতীচী ট্রাস্ট অবস্থিত। গভীর ভাবে দেখলে বোঝা যায়, ওই জমির একাংশ যা নিজের বলে দাবি তুলে বিশ্বভারতী তার অফিসারদের পাঠিয়ে দখল নিতে চায়, তা কিন্তু সারা দেশের অধিকার নিয়ে একটি বৃহত্তর আধুনিক কুরুক্ষেত্রের অন্তর্গত।
সঙ্ঘ পরিবারের আদর্শে ‘ভারত’ গড়তে প্রবৃত্ত হয়েছে বিজেপি। তাদের এনডিএ জোট নব্য ভারত গড়তে অনেক দূর অগ্রসর হয়েও গেছে। এমন এক মুহূর্তে ‘দেশ বাঁচাও’ ডাক দিয়ে গজিয়ে উঠেছে নতুন বিরোধী জোট, যার নাম ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভলপমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স (ইন্ডিয়া)। আশ্চর্য, নামটি অর্মত্য সেনের ‘আইডেন্টিটি পলিটিক্স’ আলোচনার ‘মাল্টিপল আইডেন্টিটি’ তত্ত্ব স্মরণ করিয়ে দেয়। এক জন মানুষের নানা আলাদা সত্তাপরিচয় থাকে, কারও পক্ষে এক ও অদ্বিতীয় আত্মপরিচয় ঘোষণা করা স্বাভাবিক নয়, নিরাপদও নয়। এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে স্থান পেয়েছে নানা গোষ্ঠী, গড়ে তুলেছে এক বিচিত্র সভ্যতা, যার মন্ত্র ‘মিলাবে মিলিবে’।
কিশোর রবীন্দ্রনাথের চোখের সামনে ভারতবর্ষের ইতিহাসের ধারা এক বড় বাঁক নিয়েছিল। ইংরেজি শিক্ষার সঙ্গে এসেছিল মানসিকতার জগতে দুই বিশাল পরিবর্তন, যুক্তিগ্রাহ্যতা (রিজ়ন) ও ন্যায়পরায়ণতা (জাস্টিস)। এই দুই ধারাতেই পরবর্তী কালে স্নাত হয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা সংস্কারের উদ্দেশ্যে তৈরি সংগঠন, প্রতীচী ট্রাস্ট। অমর্ত্য সেনের এই প্রচেষ্টা কত দূর সফল হবে তা ভবিষ্যৎ বলবে, কিন্তু অমর্ত্যর পিতা আশুতোষ সেনের কেনা জমিটি সদুদ্দেশ্যেই ব্যবহৃত হচ্ছে বললে তা রাবীন্দ্রিক ভাষায় যুক্তি ও ন্যায়ের পরিপন্থী হয় না। সুতরাং, বিশ্বভারতী কর্তৃক প্রতীচীর বাড়ি ও জমি নিয়ে গোল বাধানো— যে বিশ্বভারতীর আচার্য স্বয়ং নরেন্দ্র মোদী।
অর্থাৎ, প্রতীচী ট্রাস্টের পিছনে আছেন ভারতের সর্বোচ্চ জনগ্রাহ্য স্তরের এক বুদ্ধিজীবী। রবীন্দ্র-কথিত কালান্তরের যুক্তিবহ ও ন্যায়নিষ্ঠ মানসিকতার প্রবক্তাদের মধ্যে এক জন শেষ মনীষী নিশ্চয় অমর্ত্য সেন। সেই হিসাবে অন্যায় ও অযৌক্তিক হিন্দুত্ব প্রচারের পথে তিনি এক বড় বাধা। ফলে সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধতা করার পিছনে আছে ‘ভারত’ শব্দের অর্থ নিয়ে এক বিপুলতর সংঘাত।
বিশ্বভারতীর বক্তব্য, জমি রক্ষা প্রশাসনের অন্যতম কর্তব্য। এ বক্তব্য সঙ্গত। কিন্তু এর আগেকার প্রশাসন জমি রক্ষার্থে ফেনস বা দেওয়াল তুলেছে, প্রাইভেট লিজ়-সমূহ বাতিল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। শান্তিনিকেতনের পল্লিতে পল্লিতে অনেক লিজ় আছে যার দাম কম নয়। কিন্তু আজ প্রতীচীকে কেন এত বিশেষ ভাবে আক্রমণের নিশানা করা হল, তা বুঝতে হলে রাজনীতির পটভূমি খেয়ালে রাখতেই হবে।
সেই পটভূমি নিয়ে ভাবতে গিয়ে বিজেপি ও ইন্ডিয়া জোটের ভাবনাও এসে পড়ে। বিজেপি বলতে চায়, ‘ভারত’ শব্দটি দেশীয় ও প্রাচীনতর। ‘ইন্ডিয়া’ শব্দটি বিদেশি ও আধুনিক। কথাটি সম্পূর্ণ সত্য নয়। ‘ইন্ডিয়া’ নামের প্রাক্-ইতিহাস আছে। তার তাৎপর্য এখনও বলবৎ আছে। ভারতবর্ষ নামটি পৌরাণিক নাম, পঞ্চম শতকে চালু হয়। তার আগে অশোক তাঁর শিলালিপিতে এই ভূখণ্ডকে ‘জম্বুদীপ’ নামে অভিহিত করেছেন। তারও আগে ইরানে এ দেশের নাম ছিল হিন্দু (<সিন্ধু)। সেই থেকে এসেছিল ইনডোই (ইউনানি), ইন্ডিয়া (রুমি), হিন্দ্ (আরবি) ইন্-তু (চৈনিক)। চতুর্বর্ণ সমাজ পঞ্চদশ শতকে নিজেদের সামগ্রিক নাম হিসাবে ‘হিন্দু’ নাম গ্রহণ করল। নামটি মুসলমানদের দেওয়া নাম।
বাস্তবিক, বিজেপির ভারত ও নতুন জোটের ভারত, এই দুই দেশের মধ্যে যে লড়াই বেধেছে তার উৎপত্তি বুঝতে গেলে সেই প্রাচীন কাল না হলেও, উনিশ শতকে কংগ্রেসের উদয় পর্যন্ত (১৮৮৫) পিছিয়ে যেতে হবে, বা তারও আগে সিপাহি যুদ্ধের সময় পর্যন্ত (১৮৫৭)। ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস-এর নামকরণ বিচার করলে দেখি, এর লক্ষ্য ছিল ‘ইন্ডিয়ান নেশন’-এর প্রতিভূ রূপে স্বীকৃতি লাভ। সে ন্যাশনালিজ়ম ছিল ইংরেজি-শিক্ষিত উপকূলবর্তী ব্রিটিশ বন্দরগুলির মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্বাজাত্যবোধ। অপরপক্ষে, সিপাহি যোদ্ধাদের ন্যাশনালিজ়ম তত্ত্বের সঙ্গে পরিচয় ছিল না, তারা লড়ছিল ‘দীন অওর ধরম’-এর জন্য। তাদের যুদ্ধ দুই সম্প্রদায়ের যুগ্ম লড়াই। তারা নিজেদের বলত ‘হিন্দুজ় অ্যান্ড মুসলমানস অব ইন্ডিয়া’ (হুনুদ্ ওয়া মুসলিমিন-ই-হিন্দুস্থান)। যুদ্ধে হিন্দু-মুসলমান জোট হেরে গেল। তাদের জায়গায় এল ‘ইন্ডিয়ান নেশন’। ক্রমে পঞ্জাবে ও বাংলার মধ্যবর্তী ভূখণ্ডে ঘটল ‘হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্থান’ নামক জনগোষ্ঠীর মানসিকতার পরিবর্তন। এ ক্ষেত্রে দু’টি তারিখ গুরুত্বপূর্ণ: ১৯৩৭ ও ১৯৯২। প্রথম তারিখে উপকূলপুষ্ট ইংরেজি-শিক্ষিত কংগ্রেস উত্তরপ্রদেশে বিপুল ভাবে জয়ী হল, উত্তর ভারতের হিন্দি-শিক্ষিত সমাজ ভারতীয় পলিটিক্স-এ নিচু তলায় জায়গা পেল। আর দ্বিতীয় তারিখে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মাধ্যমে হিন্দিভাষী সেই ‘সাব-এলিট’ ইংরেজিভাষী ‘এলিট’কে স্থানচ্যুত করতে শেষ পর্যন্ত সক্ষম হল। ক্রমে তৈরি হল তাদের নেতা নরেন্দ্র মোদী কিংবা আদিত্যনাথ যোগীর নিষ্করুণ প্রাধান্য। গোড়া থেকেই ‘ওদের’ অনিষ্ট-কামী ‘এদের’ এই হিন্দুত্ব খুব বিশিষ্ট, কেননা ভারতের ইতিহাসে এই রকম সংগঠিত গণহিংসার নমুনা আর নেই।
এরই ঢেউ পৌঁছেছে শান্তিনিকেতনেও। দেবেন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন ট্রাস্টের শিলালিপির নির্দেশ লঙ্ঘন করে পলিটিক্স মন্দিরে আলোচ্য বিষয় রূপে নির্দিষ্ট হয়েছে, মহর্ষি ও গুরুদেব নির্দিষ্ট উৎসব অনুষ্ঠানগুলি স্থগিত আছে। এক দিকে জোর তলব, অন্য দিকে নৈরাজ্য, দু’টিই বিদ্বেষ-প্রসূত। গোলওয়ালকরের হিংসা আশ্রমে প্রবিষ্ট হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের দেখিয়ে যাওয়া আশ্রমধর্ম পালন ছাড়া এই হিংসার নিবৃত্তি হবে না। আশ্রমধর্ম ও ভারতধর্ম কী, তা গুরুদেব ও তাঁর নামকরণধন্য অমর্ত্য কথায় ও কাজে স্পষ্ট করে দিয়েছেন। তাঁদের ভারতবর্ষ যুক্তিগ্রহণ ও ন্যায়-পালনের পক্ষপাতী, নতুন সমাজ গড়বার সঙ্কল্পে ব্রতী। ‘হিন্দুত্ব’ শব্দটি আগে রবীন্দ্রনাথও ব্যবহার করেছিলেন, কিন্তু তা গোলওয়ালকরের হিন্দুত্ব নয়। গুরুদেব আশ্রম থেকে যে ‘ভারততীর্থ’ বাণী উচ্চারণ করে গিয়েছিলেন তা হল, ‘দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে।’ এই মন্ত্রের শিষ্য অমর্ত্য দেখিয়েছেন, ভারতীয় সভ্যতার অন্দরে সংস্কার ছাপিয়ে যুক্তির উপস্থিতি কতখানি। দেখিয়েছেন কেমন করে রাষ্ট্র ও বাজার মানুষের অধিকার কেড়ে নেয়। এ সব ন্যায় ও যুক্তির কথা সঙ্ঘ পরিবারে চালু নয়। এ সব কথা তাদের কানে কর্কশ লাগে।
বাবরি মসজিদ ভাঙার দৃশ্য বিবিসি-তে দেখার পর বিচলিত হয়ে অমর্ত্য কুমার সেনকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম: ধর্মের নামে এই হিংসা চিরকাল থাকবে কি? ভরসা পেয়েছিলাম যখন মাথা নেড়ে নিরুচ্চারে তিনি বলেছিলেন “না।” মনে পড়ে গিয়েছিল দেশকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ-রচিত একটি গানের বাণী: “ক্ষণে ক্ষণে তুই হারায়ে আপনা/ সুপ্তিনিশীথ করিস যাপনা/ বারে বারে তোরে ফিরে পেতে হবে/ বিশ্বের অধিকার।” ত্রিশ বছর পরে আজ মনে প্রশ্ন জাগছে, ভারতের বর্তমান অমানিশা কবে ভোর হবে। ভাবছি, বিশ্বের অধিকার আমরা কবে কী করে ফিরে পাব।