রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থাকে কেবল দোহন করতে চাই, আর কিছু নয়
Education system

পাশ কাটিয়ে, চেপে গিয়ে

শিক্ষায় যাঁদের জন্মগত শ্রেণিগত অধিকার, তাঁদের সুপ্ত প্রতিক্রিয়া, এতে বয়ে গেল। আমাদের ছেলেমেয়েরা তো ওই সব স্কুলে পড়ে না।

Advertisement

সুকান্ত চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০৮ অগস্ট ২০২২ ০৫:২১
Share:

চলমান: বিক্ষোভ প্রদর্শনের ধারাবাহিকতা, টেট পরীক্ষায় অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রার্থীদের প্রতিবাদ, ২৯ এপ্রিল, ধর্মতলা

সোনা টাকা বাড়ি ব্যবসার জমজমাট সিরিয়াল চলছে। ফাঁকে-ফাঁকে বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীদের প্রসঙ্গও উঠছে। কেবল একটা বিষয় আলোচনায় নেই: ঘটনার পটভূমি শিক্ষাক্ষেত্র। অতীত ও ভবিষ্যৎ মিলিয়ে, শিক্ষকের অভাবে বা অযোগ্য শিক্ষকের হাতে কয়েক কোটি ছেলেমেয়ের লেখাপড়া বিপর্যস্ত। বহু দিনের ঘটমান সেই বিপর্যয় আজ উৎকট রূপ ধারণ করেছে।

Advertisement

শিক্ষায় যাঁদের জন্মগত শ্রেণিগত অধিকার, তাঁদের সুপ্ত প্রতিক্রিয়া, এতে বয়ে গেল। আমাদের ছেলেমেয়েরা তো ওই সব স্কুলে পড়ে না। বিপদ এই, নগর পুড়লে দেবালয় বাঁচে না। বাংলার গোটা শিক্ষাব্যবস্থা কাঠগড়ায়। বাকি দেশবাসীরা কেউ বিহ্বল, কেউ পুলকিত।

কিছু সংশয়, কিছু বিরোধ সত্ত্বেও বাংলার শিক্ষা ভারতে স্বীকৃতি পেয়ে এসেছে। এই স্বীকৃতি প্রায়ই মুক্তমনে নয়; আড়ালে থাকে ঈর্ষা, বিদ্বেষ, গাত্রদাহ। আজ সেগুলি অবাধ বিহারের সুযোগ পেল। কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে যে নীতিগর্ভ চিঠি লিখেছেন, তার সুর ইংরেজিতে যাকে বলে ‘গ্লোটিং’। মন্ত্রিমশায়ের অনুচরদের এ বার সঙ্গত ধরার পালা। রাজনৈতিক বাহিনী, বিশেষত সমাজমাধ্যমের কুৎসাকুশলীর দল, আসর মাত করবে। আমলাকুল দ্বিগুণ উৎসাহে বাংলার প্রতিষ্ঠানগুলিকে বঞ্চিত করবে, প্যাঁচে ফেলবে। প্রধান শিকার হবে মফস্‌সলের অনামী অবহেলিত সমাজ নয়, শিক্ষাভিমানী উচ্চাভিলাষী শ্রেণি, যারা দেশভর দৃশ্যমান, যাদের কোণঠাসা করলে বাকিদের লাভ। বিশেষ নিশানায় থাকবে জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষা আর রাজ্যের অগ্রগণ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলি। ভারত জুড়ে গবেষণাকেন্দ্রে বাংলার ছাত্রদের কদর ছিল এবং আছে; সেটা প্রশ্নের মুখে পড়বে। নিয়োগ বৃত্তি অনুদান প্রভৃতি বিঘ্নিত হবে।

Advertisement

বাংলার শিক্ষা নিয়ে তরল বড়াই আজ পাগলেও করবে না। কিন্তু লেখাপড়ার একটা নাছোড় জেদ আমাদের মজ্জাগত। কেন্দ্র-রাজ্য উভয় সরকারের অবহেলা আর অভিসন্ধির সঙ্গে যুঝে যে শিক্ষকেরা এখনও যাদবপুর আর কলকাতাকে সব রাজ্যচালিত ও প্রায় সব কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রভাগে রেখেছেন, আর কি তাঁরা এই অসম যুদ্ধ চালাতে পারবেন? মূল্যায়নের বৃহত্তম অঙ্গ যে ধোঁয়াটে ‘পারসেপশন’, সেটার কী হবে? কোথায় দাঁড়াবেন সেই নিরলস স্কুলশিক্ষকদের সংগঠন যাঁরা পরিপার্শ্বের গণ্ডি ছাপিয়ে শিক্ষার প্রসারে আরও ব্যাপক উদ্যোগ করেছেন, অতিমারিকে পর্যন্ত কাজের নতুন সুযোগ বলে গ্রহণ করেছেন? সবচেয়ে বড় কথা, এই রত্নগর্ভা রাজ্যের মেধাবী ছেলেমেয়েরা নতুন কোন বাধার মুখে পড়বে?

এই মেধা, এই নিষ্ঠার প্রতি যারা বিশ্বাসঘাতকতা করে, তাদের পাপ অমার্জনীয়। নিষ্ফল শাপশাপান্তে লাভ নেই। বাংলার শিক্ষা রসাতল থেকে উদ্ধার করতে আমাদের সকলের আর না ভাবলেই নয়, নইলে আমাদের দায়ভাগ দুর্নীতিপরায়ণদের থেকে কম হবে না। প্রমাণ হবে, শিক্ষায় আমাদেরও নজর কেবল প্রাপ্তিলাভে, শিক্ষাব্যবস্থাকে আমরাও কেবল দোহন করতে চাই, আর কিছু নয়।

স্ববিরোধী মনে হলেও একটা কথা বলতে চাই। আজ ক্ষুদ্রতম উন্নতির আশা করা দুষ্কর। সে জন্যই কিন্তু উন্নতি ঘটাতে গেলে করতে হবে বৃহৎ ভাবে, অকাট্য ভাবে, অনাচারের শিকড় উপড়ে। ক’টা মামুলি রদবদল, আদালতের হুকুমের আক্ষরিক পালন, দু’-এক জন মহারথীর নাটকীয় পতন যথেষ্ট নয়। দুষ্কর্মার বাহিনী আড়ালে দিন গুনবে, অবস্থা থিতিয়ে এলে দ্বিগুণ রোখে ফিরে আসবে, ক’দিন ব্যবসা বন্ধের লোকসান পুষিয়ে নেবে।

পরিবর্তনটা হতেই হবে রাজনৈতিক। রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে কিন্তু সংশয় থেকেই যাচ্ছে। কিছু চাকরিপ্রার্থীর সঙ্গে আলোচনা চলছে, কেউ রাস্তায় পুলিশের লাঠি খাচ্ছে। এ শুধু ব্যাড অপটিক্স নয়, শাসকের নিরপেক্ষতা প্রশ্নের মুখে ফেলে। চেপে যাওয়া, পাশ কাটিয়ে যাওয়ার প্রবণতা এখনও বিদ্যমান। এ দিকে আমলাকুল আজ এতটাই নিষ্প্রভ যে, নেতাদের বিমতে তাঁরা চরম অন্যায়ও রুখতে যাবেন, এমন আশা অলীক। যে একদা শিক্ষকেরা প্রশাসনিক দায়িত্বে আছেন, তাঁদের একাংশের কীর্তিতে গোটা শিক্ষকসমাজের মুখ পুড়েছে; সেই লজ্জা ঘোচাতে বাকিরা এগিয়ে আসবেন কি? অনুমান হয়, নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচাবার জন্য রাজনীতিকেরা যদি প্রতিকারসাধনে বাধ্য হন, প্রশাসকরা তবেই পিছু-পিছু ওই পথে হাঁটবেন, নইলে নয়।

প্রতিকারের উপায় কিন্তু একান্ত প্রশাসনিক। তার সূচনা হতে হবে স্কুলশিক্ষা দিয়ে। প্রত্যক্ষ অনাচার সেখানেই ঘটেছে; সবচেয়ে বেশি ছেলেমেয়ের ক্ষতি হচ্ছে সবচেয়ে চরম, সবচেয়ে সরাসরি।

পশ্চিমবঙ্গের স্কুলে কত শিক্ষকপদ খালি? তিন বছর আগে ঘাটতি ছিল ৮৪,০০০-এর বেশি। অতিমারির সময় ক’টা নতুন নিয়োগ হয়েছে? তবে জুলাইয়ের শেষে সরকার আদালতে জানিয়েছে, প্রাথমিক বাদে প্রায় ২১,৭০০ পদ শূন্য, প্রাথমিকে আরও ৩,৯০০ মতো। কর্মশিক্ষা ও শারীরশিক্ষার পদ কি এর মধ্যে ধরা? এর বাইরেও এক প্রস্ত ‘অতিরিক্ত’ পদের কথা শোনা যাচ্ছে। প্রাথমিকে পদের সংখ্যা নিয়েও ধন্দ আছে। হয় অনীহার ফলে নয় ইচ্ছাকৃত কৌশলে চিত্রটা অস্পষ্ট, মোট বনাম বিজ্ঞপিত শূন্যপদ, পূর্ণ শিক্ষক বনাম পার্শ্বশিক্ষক, ‘আদি’ বনাম ‘অতিরিক্ত’ পদ ইত্যাদি তারতম্যের ফলে। জট ছাড়ানো সহজ নয়। তবে সব শিক্ষককে মাইনে দেয় সরকার, হিসাব থাকে কম্পিউটারে। নতুন পদেরও একটা আর্থিক বরাদ্দ থাকে। অর্থের হিসাবের এই সূত্রগুলি থেকে পদের সঠিক সংখ্যায় পৌঁছতে পারা উচিত। আদি অকৃত্রিম মেধাতালিকাও সম্ভবত উদ্ধারযোগ্য, অন্তত সার্ভারের মুছে-দেওয়া ফাইলের গহ্বর থেকে। দুর্নীতির স্পষ্ট প্রমাণ না পেলে তাতে অন্তর্ভুক্ত সকলকে নিয়োগ করা হোক। কত কম নয়, কত বেশি প্রার্থী সুবিচার পান সেটাই বিচার্য। যাঁদের বয়স পেরিয়ে গেছে, অবশ্যই ছাড় দিতে হবে।

জটিলতা অশেষ, তার দায়ভাগ দুই দশক ধরে একাধিক সরকারের। প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ নিয়ে মস্ত জট পাকিয়েছিল, যেমন সর্বশিক্ষা মিশনের পূর্বতন শিক্ষকদের নিয়ে। সেই জট ছাড়াবার রাস্তা অনেকটাই পরিষ্কার, তবু নিষ্পত্তি হয়নি।

বিধ্বস্ত প্রশাসন এত করবে কী করে? উত্তর হতেই হবে, যে করে হোক। সরকারের উপর রাজ্যবাসীর বিশ্বাস প্রবল ভাবে ধাক্কা খেয়েছে। সেই অনাস্থা চলতে থাকলে শুধু শিক্ষা নয়, পুরো শাসনব্যবস্থা বিপন্ন হবে, নাগরিক সমাজ অনাথ বোধ করবে। শাসকরাই বা তখন থাকবেন কোথায়?

তাই জোড়াতালি নয়, ‘ম্যানেজ করা’ নয়, নিজেদের উদ্ধার করতেই সরকারের বড় কিছু একটা করা দরকার; আমাদেরও দরকার তাদের বাধ্য করতে। সবচেয়ে তাগিদ অবশ্যই রাজ্যের সেই ৮৪ শতাংশ পড়ুয়ার পিতামাতা অভিভাবকদের, যারা সরকারপোষিত স্কুলে পড়ে। এই সুযোগে তাঁরা যেন বলেন, কেবল শিক্ষক নিয়োগ নয়, শিক্ষার একটা সার্বিক সুষ্ঠু বন্দোবস্ত চাই। সে-দিন শুনলাম এমন স্কুলের কথা, যেখানে ১৩ জন শিক্ষক ১১ জন পড়ুয়া; আবার এমনও পড়লাম, ৭০০ শিশু সামলাচ্ছেন এক জন পূর্ণসময়ের শিক্ষক। ২০১৯ সালে রাজ্যে প্রায় ২,৬৫০ প্রাথমিক স্কুলে মাত্র এক জন শিক্ষক ছিলেন। তার পর নিয়োগের যা খতিয়ান, তাতে সংখ্যাটা কমেছে না বেড়েছে? উচ্চ প্রাথমিকে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত সারা দেশে ১৯, এ রাজ্যে ২৮। উঁচু ক্লাসে অঙ্ক আর বিজ্ঞান শিক্ষকের ভয়াবহ আকাল, কোথাও কোথাও বিজ্ঞানে ভর্তি বন্ধ। শূন্যপদ ভরলেও সমস্যা মিটবে না, কারণ পদের সংখ্যা অপ্রতুল ও বিন্যাস অসম। সুষ্ঠু নিয়োগের সঙ্গে পদের সংখ্যা বাড়াতেই হবে, অর্থের জোগান যে করে হোক নিশ্চিত করতে হবে; নিদেনপক্ষে বাড়তি পদগুলি নথিভুক্ত করে নির্দিষ্ট সময়সূচি ধরে পূরণ করতে হবে। শিক্ষক বদলির মানবিক তাগিদে গ্রামের স্কুল শিক্ষকশূন্য হতে দেওয়া চলবে না।

শিক্ষায় নিয়োগের আকাল ও অনাচার দেশ জুড়ে সর্বস্তরে। সর্বত্র হাজার হাজার মানুষ জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে অতিথি-শিক্ষক বা গবেষণা-সহায়ক হয়ে; দেশের মানবসম্পদ হেলায় নষ্ট হচ্ছে। স্কুলস্তরে অন্তত ছ’টি রাজ্যে শূন্য পদের অনুপাত বাংলার চেয়ে বেশি (সিকিমে ৫৭.৫ শতাংশ)। তাতে কি আমাদের দোষ কমে, না মন ভাল হয়? মসৃণ হয় আমাদের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ?

পাগলের মতো শোনালেও বলি, আজকের গ্লানি আর বিপর্যয় আমাদের একটা সুযোগ এনে দিয়েছে। এটাই শেষ সুযোগ। চৈতন্য ফিরিয়ে তার সদ্ব্যবহার করলে একটা সুস্থ শিক্ষাব্যবস্থা ফিরে পাওয়া সম্ভব। নইলে শুধু ওই ৮৪ শতাংশ ছেলেমেয়ের নয়, বাকি ১৬ শতাংশেরও নয়, রাজ্যের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।

ইমেরিটাস অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ,যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement