(বি)স্মৃতি: বাংলা বিহার সংযুক্তির বিরুদ্ধে সভা, সভাপতি মেঘনাদ সাহা। ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬
বাংলা বাঁচাতে বাঙালির লড়াই একেবারেই নতুন কিছু না। দেশভাগের ছয় বছরের মধ্যেই, তৎকালীন বিহারের বাঙালি অধ্যুষিত মানভূম এবং পূর্ণিয়ার অংশবিশেষের পশ্চিমবঙ্গে অন্তর্ভুক্তির দাবিতে বৈদ্যনাথ ভৌমিক ২২ দিন অনশন করেন। তাঁর অনশনের কারণেই আজকের পুরুলিয়া জেলা পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত। সেটা ১৯৫৩ সাল। এর এক বছর আগে পূর্ব বাংলায় ঘটেছিল একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনা, সারা পৃথিবী যার কথা মনে রেখেছে, কিন্তু বৈদ্যনাথ ভৌমিকের নামে কোনও উইকিপিডিয়ার পাতাও আজ নেই। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি তাঁকে ভুলে মেরে দিয়েছে।
বাঙালি যে ভুলে যায়, সেটা নতুন কিছু না। কিন্তু মারাত্মক হল এর পরের অংশ। রাজনৈতিক ভাষ্য থেকে যা বিলকুল উবে গিয়েছে, তা হল, এর পরেই বিহারের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী বাংলাভাষী পুরুলিয়ার পশ্চিমবঙ্গে অন্তর্ভুক্তির চূড়ান্ত বিরোধিতা করেন। বিহার রাজ্যটিই এর মোটে বছর চল্লিশেক আগে (১৯১২ সালে) তৈরি, কিন্তু তিনি দাবি করেন, এ সব অঞ্চল ১২০ বছর ধরে বিহারের অংশ! দেশভাগের পর তখন সংসদীয় রাজনীতিতে বাংলার গুরুত্ব কমতির দিকে, হিন্দি বলয়েরই জয়জয়কার। ক্ষোভ প্রশমনের জন্য তৎকালীন সর্বশক্তিমান হাইকম্যান্ড এক অভূতপূর্ব উদ্যোগ করে। বৈদ্যনাথ ভৌমিকের অনশনের তিন বছরের মধ্যেই প্রায় পাকা করে ফেলা হয় বিহারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গকে জুড়ে এক নতুন রাজ্য তৈরির প্রস্তাব। বাংলা-বিহার জুড়ে যে নতুন রাজ্য হওয়ার কথা, তার নাম দেওয়া হয় পূর্বপ্রদেশ। বাংলাকে গোবলয়ের অংশ করে ফেলার কেন্দ্রীয় প্রচেষ্টা একেবারেই নতুন না।
সেটা ১৯৫৬ সাল। সুভাষচন্দ্র বসু নিখোঁজ হয়েছেন এগারো বছর আগে। তখনও ফিরে আসার গুজব ছড়িয়ে পড়ত তাঁর প্রতিটি জন্মদিনের আগেই। শোনা যেত বাঙালি জাতির পুনরুত্থানের কথা। দ্বিধাবিভক্ত এক জাতির স্বপ্নের মাধ্যম হিসেবে আর কী-ই বা আছে তখন। বেছে বেছে তাঁর জন্মদিনেই পশ্চিমবঙ্গকে ভারতের মানচিত্র থেকে মুছে দেওয়ার প্রস্তাব সরকারি ভাবে পেশ করা হয়। ২৩ জানুয়ারি ১৯৫৬, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায় এবং বিহারের মুখ্যমন্ত্রী কৃষ্ণ সিংহ যৌথ বিবৃতিতে সংযুক্তির প্রস্তাবকে সমর্থন করেন। বাকি থাকে শুধু আইনসভায় পাশ করানোর সামান্য কাজ।
এ পর্যন্ত যে ভাবে এগোচ্ছিল সেটা অবশ্য নতুন কিছু না। ইতিপূর্বেই দেশভাগ ঘটিয়ে বাঙালির জীবনে আনা হয়েছিল চূড়ান্ত বিপর্যয়, তার এক দশকও হয়নি তখন। ভারতের অন্যতম বৃহৎ অর্থনৈতিক কেন্দ্রের জায়গা থেকে কলকাতা পিছলে যেতে শুরু করেছে। সঙ্গে লক্ষ লক্ষ মানুষের ঘরবাড়ি ছেড়ে আসার ট্র্যাজেডি। সেটা আবার পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের একটি কারণও বটে। যাঁরা দেশভাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তাঁরা কখনও ন্যূনতম দায়টুকুও নেননি। হিন্দুত্ববাদীরা তো উদ্বাস্তুদের দিকে কখনও ফিরেও তাকাননি। আর কেন্দ্রীয় সরকার, যারা পশ্চিম ভারতে সাহায্যের উদার হাত বাড়িয়েছিল, বাংলার উদ্বাস্তুদের সাহায্যে কানাকড়িও কখনও ঠেকায়নি। দেশভাগের সিদ্ধান্ত ছিল কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের, দায় পুরোটাই পশ্চিমবঙ্গের।
বিহারের সঙ্গে সংযুক্তি ছিল এই রন্ধনশালার পরবর্তী আইটেম। বিহারে তখন চার কোটি লোকের বাস। পশ্চিমবঙ্গে আড়াই কোটি। এই সংযুক্তির ফলে পূর্বপ্রদেশে বাঙালিরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হত। সংযুক্তির প্রস্তাব আনামাত্রই বিহারে শোনা যাচ্ছিল এক অন্য ধরনের আতঙ্কের কথাও। শিক্ষিত বাঙালিরা সব চাকরি দখল করে নেবে, এই আতঙ্ক। শুধু পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি নয়, তার উপর আবার পূর্ববঙ্গীয়ের ভিড়। সব মিলিয়ে, এখন ঘুরে দেখলে মনে হয়, এ ক্ষেত্রেও তৈরি করার চেষ্টা হচ্ছিল এমন এক রাজ্য, যেখানে বাঙালি একই সঙ্গে সংখ্যালঘু ও দখলদার, যাদের ভয়ে ভূমিপুত্ররা ভীত। এবং এই দখলদাররা আবার অনেকেই বে-আইনি ‘বাংলাদেশি’, পরে যাদের চিহ্নিত করে বহিষ্কার করে দেওয়া হবে রাষ্ট্র থেকে এবং মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলি দাঁড়িয়ে করতালি দেবে।
এ সব অবশ্য কিছুই ঘটেনি। এই রন্ধনকৌশল পশ্চিমবঙ্গে প্রয়োগ করা যায়নি। দেশভাগ মেনে নিলেও, না নিয়ে তেমন কোনও উপায়ও ছিল না অবশ্য, এ ক্ষেত্রে বাঙালি রুখে দাঁড়ায়। সরকারি ঘোষণার পর যা ঘটে যায়, তা সেই দোর্দণ্ডপ্রতাপ কংগ্রেসি যুগে ছিল অকল্পনীয়। শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, বুদ্ধিজীবীরা, সবাই রাস্তায় নেমে পড়ে। অজস্র সভাসমিতি হতে থাকে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট সংযুক্তিকরণের বিরুদ্ধে প্রস্তাব গ্রহণ করে। ‘পশ্চিমবঙ্গ ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠন কমিটি’ আগেই তৈরি করা হয়েছিল, এ বার আয়োজন করা হয় বাংলাভাষী সম্মেলনের। তার উদ্বোধন করেন বিজ্ঞানী ও লোকসভা সদস্য মেঘনাদ সাহা। ১ ফেব্রুয়ারি শিল্পী এবং সাহিত্যিকরা আয়োজন করেন গণ কনভেনশনের। ২ তারিখকে ঘোষণা করা হয় চরমপত্র দিবস হিসেবে। সে দিন দু’লক্ষ ছাত্র ধর্মঘট করে। ২৪ তারিখ সংযুক্তির প্রস্তাব পেশ করার কথা ছিল বিধানসভায়। প্রশাসনকে জানিয়ে দেওয়া হয়, প্রস্তাব ফিরিয়ে না নিলে ওই দিন ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে পালন করা হবে। বিধানসভার কাছে ভাঙা হবে ১৪৪ ধারা। ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে কী, এখন জিজ্ঞাসা করলে একশোয় নিরানব্বই জনই বলবেন ১৯৪৬ সালের কথা। ১৯৫৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারির কথা বাঙালিকে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সর্বস্তরে এই তীব্র প্রতিরোধের সামনে সরকার পিছু হটে। প্রস্তাব বিধানসভায় পেশ করা হয়নি। বিধান রায় চিঠিতে নেহরুকে জানান, প্রস্তাবের সপক্ষে খুব বেশি হলে ১৫০ জন বিধায়কের সমর্থন তিনি জোগাড় করতে পারতেন। অর্থাৎ, আন্দোলনের তেজ এতটাই ছিল যে, শাসক দলের নেতারাও কেউ বিভীষণ আখ্যা পেতে চাননি। আন্দোলনের চূড়ান্ত জয় তখনও বাকি। তবে সেটারও খুব দ্রুতই নিষ্পত্তি হয়ে যায়। ফেব্রুয়ারি মাসে হঠাৎ মারা যান মেঘনাদ সাহা। তাঁর মৃত্যুতে ফাঁকা হয়ে যায় কলকাতা উত্তর-পূর্ব কেন্দ্র, ঘোষিত হয় উপনির্বাচন। মার্চ মাসে ময়দানের এক জনসভায় বিরোধী দলনেতা জ্যোতি বসু ঘোষণা করেন ভাষা পুনর্গঠন কমিটির সম্পাদক মোহিত মিত্রই হবেন নির্বাচনে বিরোধী প্রার্থী। এবং এই একটি নির্বাচনেই প্রতিফলিত হবে রাজ্য পুনর্গঠন নিয়ে মানুষের জনমত। এক ঝটকায় নির্বাচনের পুরো চরিত্রটাই বদলে যায়। যা ছিল কেন্দ্রীয় আইনসভার নেহাতই গুরুত্বহীন এক পুনর্নির্বাচনের আচার, তা হঠাৎই পরিণত হয় ‘আঞ্চলিক’ প্রশ্নে গণভোটে।
নির্বাচনে প্রত্যাশা মতোই জেতেন মোহিত মিত্র, যে কারণে পশ্চিমবঙ্গ পূর্বপ্রদেশ হয়ে যায়নি। একই সঙ্গে চিরাচরিত কংগ্রেসি আসন খেজুরিতে বাম সমর্থিত প্রার্থী লালবিহারি দাস জেতেন কুড়ি হাজারেরও বেশি ভোটে। কংগ্রেস বা সিপিআই না, এই নির্বাচনে জিতেছিল বাংলা। সংযুক্তিকরণ বাতিল হয়, কারণ বিধান রায়ের সরকারের পক্ষেও গণরায়কে অস্বীকার করা সম্ভব হয়নি।
৬৫ বছর পরে অতীতের দিকে ফিরে তাকালে কিছু জিনিস স্পষ্ট চোখে পড়ে। প্রথমত, ভারতের সংবিধানে গণভোটের ব্যবস্থা নেই, কিন্তু তার পরেও ইতিহাসের বাঁকে কোনও কোনও নির্বাচন গণভোটের চরিত্র নেয়। তখন ধরি-মাছ-না-ছুঁই-পানি না করে যাঁরা শক্ত অবস্থান নেন তাঁরাই টিকে থাকেন। ইতিহাসের মোড়ে সুবিধাবাদের স্থান নেই। প্রসঙ্গত, অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি দেশভাগের আগে থেকেই ভাষাগত বহুত্বের পক্ষে থেকেছে। ভাষা প্রশ্নে ‘আঞ্চলিকতা’র পক্ষে দাঁড়াতে আজকের বহুধাবিভক্ত বামেদের মতো তারা দ্বিধায় থাকত না।
দ্বিতীয়ত, ১৯৫৬’র আন্দোলন এটাও সোজা-সাপ্টা ভাবে দেখিয়ে দেয় যে, ভাষা কোনও আকাশ থেকে পড়া বিষয় নয়। অর্থনীতি, রুটি-রুজি, চাকরি এবং শিক্ষার অধিকার, সবের সঙ্গেই ভাষা জড়িয়ে আছে। ভাষার সঙ্কট এক রকম করে সর্বস্তরের মানুষের অস্তিত্বেরও সঙ্কট, শৌখিন ড্রয়িংরুম চর্চা একেবারেই নয়। রুটি-রুজি হল মৌলিক, ভাষা তার পরে— এ-রকম একটা ভাষ্য প্রায়ই শোনা যায় ইদানীং। কিন্তু ব্যাপারটা যে আদৌ তা নয়, জাতিগত অস্তিত্বের সঙ্কট যে সমস্ত মানুষকেই নাড়িয়ে দেয়, ১৯৫৬ সালের আন্দোলনই তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ।
তৃতীয় ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটা, তা হল বিস্মৃতি। শ্রীরামালুর অনশন অন্ধ্রবাসী ভোলেনি, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে এই গৌরবময় ইতিহাস বিলকুল ভুলে মেরে দেওয়া হয়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারি কিন্তু আমরা ভুলিনি, ভুলিনি ১৯ মে, যদিও এগুলো পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে ঘটেনি। ব্যাপারটা আসলে খুব জটিল কিছু না। ইতিহাস তো এমনি এমনি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে গড়িয়ে চলে না, তার চর্চা করতে হয়। পাঠ্যবই নয়, দেওয়াল লিখন হয়ে স্লোগান-মিছিলে চলে সে চর্চা। এ ভাবেই নতুন প্রজন্ম খাদ্য আন্দোলন জেনেছে, জরুরি অবস্থা জেনেছে। এ ক্ষেত্রে এই চর্চার দায় ছিল যাদের, তারা রাজনৈতিক ভাষ্য থেকে ভাষার বিষয়টাকেই ক্রমশ বাদ দিয়ে দিয়েছে। ‘ভারতীয়’ হওয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষায় মাথাভারী কেন্দ্রীয় কাঠামোকেই এক রকম চূড়ান্ত ধরে নেওয়া হয়েছে। আর ওই ছিদ্র দিয়েই ক্রমশ ঢুকে পড়েছে এককেন্দ্রিক হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থানের জিগির, যা এখন দৈত্যরূপে গোটা বাংলাকেই গিলে খেতে চায়।
ভুল হয়েছে, নিঃসন্দেহে। কারণ, ভাষা না বাঁচলে আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্য বাঁচবে না। আর তা না বাঁচলে বাঁচবে না ভারতীয় বহুত্ব। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে রক্ষার জন্যই বাঙালির সত্তা ও ভাষাকে রক্ষা করা দরকার, এই বোধটা পুরনো তোরঙ্গ খুলে বার করার প্রয়োজন বোধ হয় হয়েছে। ইতিহাসের এই সব মোড় যেমন নিয়ে নেয় অনেক কিছু, তেমনই চটপট ভুল শুধরে নেওয়ার সুযোগও তো করে দেয়।