আনন্দাশ্রু: টি২০ বিশ্বকাপ জিতে নেওয়ার কান্না হার্দিক পাণ্ড্যের। তাঁকে ঘিরে রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলি ও অন্যান্যরা। ২৯ জুন, বার্বেডোজ়। পিটিআই।
হেরে গেলে আমরা সকলেই কাঁদি। জিতলে কাঁদে ক’জন? প্রকাশ্যে?
ইভান লেন্ডলের মতো কান্না-চেপে রাখা, শক্ত ঠোঁটের জমানায় জিতে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে ‘মনে রেখে দেব’র তালিকায় ঢুকে গিয়েছিলেন আন্দ্রে আগাসি। স্টেফি গ্রাফ অবশ্য প্রথম থেকেই জিতে কাঁদতেন। কিন্তু আশির দশকে মাধ্যমিক পাশ-করাদের যুগে পুরুষ টেনিসে জিতে কাঁদতে দেখা বোধ হয় সেই প্রথম। তার পর থেকে পুরুষদের জয়ের কান্না খুব বিরল নয়, ক্রিকেটে তো নয়ই। তিরাশির বিশ্বকাপে আনন্দে আমরা সকলে কেঁদেছিলাম। কপিলদেব নিখাঞ্জদের চোখের কোনা হয়তো চিকচিক করে উঠেছিল, কিন্তু বিশ্বকাপ জিতে যুবরাজ সিংহ বা এই সে দিন বার্বেডোজ়ে বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মা বা হার্দিক পাণ্ড্যের কান্নায় আর কোনও লুকোছাপা নেই। রোহিতের কথাই ধরুন। মাটিতে মাথা ঠেকালেন। মাটির টুকরো মুখে ঠেকালেন দু’বার। নিখাদ।
খুব দরকার ছিল এই জয়ের, এই কান্নার, এই ভূমি স্পর্শের। অবসরের দিন সচিন তেন্ডুলকরও ভূমি স্পর্শ করেছিলেন স্টেডিয়ামের। এ তো নিজস্ব মনোভূমি, নিজস্ব রণক্ষেত্রের ভূমি স্পর্শ করা। যেখানে নিত্য লড়তে হয়, হারতে হয়, রক্তাক্ত হতে হয়। টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারত যখন জয়ের খুব কাছে, টেলিভিশনের পর্দা দেখাল, এক ভারতীয় মহিলা দর্শকাসনে বসে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। জয়ের আনন্দে, না কি সর্বব্যাপী, জমে থাকা আবেগ এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এক লহমায়, প্রবল বৃষ্টিতে রাস্তায় ভিজতে ভিজতে অবিরল, কান্নার মতো।
রাজনীতির সর্বগ্রাসী যুগে যখন ভূমিস্পর্শ, চোখের জল খুব অনায়াস, রাজনীতির উপজীব্য, তখন ক্রিকেটারদের এই চোখের জল বিশুদ্ধ ও পবিত্র। যা বুঝিয়ে দেয়, সব কিছু ক্যামেরার জন্য নয়। ক্যামেরা তাকে ধরতেই পারে, কিন্তু যে মানুষটা জিতে কাঁদছে, কাঁদছে হারতে হারতে ফিরে আসার আনন্দে, যাঁকে দেখে কাঁদছে আরও লক্ষ ক্রিকেটপ্রেমী, বা যে মুহূর্তের কথা ভেবে আরও কয়েক দশক পরেও কাঁদবে অনেকেই, যেমন এখনও তিরাশির জয়ের ভিডিয়ো দেখলেই চোখ ভরে যায়, সেই কান্না মনুষ্যত্বে বিশ্বাস ফেরায়, বিশ্বাস ফেরায় বিশুদ্ধ আবেগে।
যে নীতিতে বিশ্বাসই করি না, যে নীতিকে মাড়িয়ে চলি, সেই নীতির পীঠস্থানে গিয়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত হলাম; মাথা ঠেকালাম সেই বইয়ে, যে সংবিধান নিজে লঙ্ঘন করি। এই প্রণিপাত, এই ভূমিস্পর্শ, এই কান্না দেখতেই তো আমরা অভ্যস্ত। অবস্থা এমন যে, ‘উনি’ কত বার কাঁদলেন, সংবাদমাধ্যম তার তালিকা করে রাখে। এমনকি দুর্নীতিতে অভিযুক্ত, অত্যাচারের ঘটনায় অভিযুক্ত— ধরা পড়লে এখন সকলে কাঁদে। আমাদের ছোটবেলায় খুব চালু ছিল, সিনেমায় নায়িকারা চোখে নাকি গ্লিসারিন দিয়ে কাঁদেন। যদি সত্যি তা-ই হত, তা হলেও তাঁদের ১০০ গোল দিয়ে এগিয়ে যেতেন রাজনীতিকরা। গ্লিসারিন-টিসারিনের দরকারই নেই, সুযোগ বুঝে চোখ ছলছল, গলা বুজে এলেই কেল্লা ফতে। আর চোখের জল গড়িয়ে পড়লে তো কথাই নেই।
বছর কয়েক আগে এক সহকর্মীর স্মরণ অনুষ্ঠানে যখন অন্য কনিষ্ঠ সহকর্মীরা গাইছেন একের পর এক গান, বা সমবেত ভাবে গাইছেন আগুনের পরশমণি, শ্রোতার আসনে বসে সকলেই কেঁদেছেন। সহকর্মীর অকালমৃত্যুতে শুধু? আমরা কি সকলে তাঁকে সে ভাবে চিনতাম? ভালবাসতাম? পাশে বসা বন্ধু বলেছিল, ‘আমরা সবাই কিন্তু নিজের কারণে কাঁদছি’। ঠিকই, একটি অকালমৃত্যু আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছিল আরও অনেক অকালমৃত্যুকে— মানুষের, সম্পর্কের, ফেলে আসা দিনের, সম্ভাবনার, নিজের বোধের। সে আমাদের একক এবং সমবেত শোক, কান্না।
আর জয়ে, আনন্দে? অন্যের আনন্দে আমরা কি কাঁদি?
কাঁদি। খুব কাছের লোকের জন্য কাঁদি।
আর আমার কান্নায় যাঁর কিছুই আসে যায় না, সেই অভিনেতা বা অভিনেত্রী অস্কার পেলে কাঁদি, দিয়েগো মারাদোনার জন্য কাঁদি, লিয়োনেল মেসির হাতে বিশ্বকাপ দেখে কেঁদে ভাসাই। কারণ, কোথাও সেই মানুষটি, আমাদের, আমার ব্যক্তিগত, ‘ওগো সবার, ওগো আমার’। ব্রাজ়িল, আর্জেন্টিনা, ফ্রান্স বিশ্বকাপ পেলে আমার কী? কিছুই না। মেরিল স্ট্রিপ অস্কার পেলে আমার কী? কিছুই নয়। আমার বাড়ি হবে না, চাকরি হবে না, বেতন বাড়বে না, সংসার সুখের হবে না, কিন্তু আমার আনন্দ হবে, আমার হৃদয় ভরে যাবে, কারণ সেই মানুষটি আমাদের আনন্দ দিয়েছেন, কোথাও তাঁর লড়াই, তাঁর শিল্প, তাঁর জীবন আমাকে স্পর্শ করেছে, কখন তাঁর লড়াই আমার হয়ে উঠেছে। বা ব্যক্তিগত ভাবে যা আমি-মানুষটি কোনওদিনই পাবে না, পায়নি, যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বা নেই বলেই, তাই তিনি পেয়েছেন বলেই আমার পাওয়া। এই পাওয়া, পেয়ে কান্নার মুহূর্ত ব্যক্তি মানুষটিকে উন্নীত করেছে, মুহূর্তের জন্য হলেও অন্তর শুদ্ধ করেছে, ভগ্নাংশের জন্য হলেও ভালবাসতে শিখিয়েছে। এই পৃথিবীর জন্য সে কি কম পাওয়া?
বলতেই পারেন যাঁর জন্য কাঁদছেন, যাঁদের জন্য কাঁদছেন বা যাঁদের কান্না নিয়ে লিখছেন, তাঁরা কোটি কোটি টাকা কামান ব্যাটে-বলে ঠেকিয়ে, বিজ্ঞাপন করে, বিলাসবহুল জীবনযাপন করে। ঠিকই, অন্য খেলার সঙ্গে বৈষম্য নিয়ে তর্ক চলতেই পারে, কিন্তু তাঁদের অর্জন তাই বলে মিথ্যে হয় না। সব অর্জনের পিছনেই রয়েছে কঠোর পরিশ্রম, রয়েছে অপমান, অবিচার, না-পাওয়া।
তাই বিরাট-রোহিতদের কান্না বিশ্বাস ফিরিয়েছে আবেগে, ভালবাসায়। বুঝিয়েছে সব কিছুই কৃত্রিম নয়। বুঝিয়েছে মানুষ পারে। বুঝিয়েছে, রাজনীতির গ্লিসারিন বাদ দিয়েও এই পৃথিবী, এই ভারতবর্ষ তার দারিদ্র, তার কষ্ট, তার শোষণ নিয়ে যতটাই বেঁচে আছে, তার ভূমি, তার মানুষ, তার ঘাস, তার মাঠ, তার খেলা, তার মানুষ, আর তাদের অশ্রু, ভালবাসা নিয়ে ততটাই।
তাই তিরাশির বিশ্বকাপ থেকে শুরু করে অলিম্পিক্সে নীরজ চোপড়ার সোনা, মীরাবাই চানুর রুপো, লাভলীনা বরগোঁহাইয়ের ব্রোঞ্জ, অলিম্পিক্স স্ট্যান্ডে ভারতের জাতীয় পতাকা আর জাতীয় সঙ্গীতে কেঁদেছি। কেঁদেছি বার্বেডোজ়ে।
বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মা, আপনাদের নিখাদ অশ্রুকে অভিবাদন।
অভিবাদন আমাদের কাঁদানোর জন্য আনন্দে, জয়ে। বা অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে নিজস্ব শোকের কান্না সে দিন প্রকাশ্যে অবাধে উজাড় কাঁদতে দেওয়ার জন্য।
বিজয়ের কান্নার পিছনে অনেক পরাজয় থাকে।