পুতুল নাচানোর ইতিকথা
Enforcement Directorate

আইএএস আইপিএস-দের উপর যথেচ্ছ ছড়ি ঘোরানো বিপজ্জনক

এ যেন এক নতুন ভারত! দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় কেন্দ্র বনাম রাজ্যের সরকারের বিবাদ এ দেশে নতুন নয়।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০২১ ০৯:১৮
Share:

প্রশ্ন: এনসিবি কর্তার প্রতি সরকারের তোপ কেন? প্রতিবাদী জমায়েত, দিল্লি, ২৬ অক্টোবর। ছবি পিটিআই।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশমতো চলতে গিয়ে আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে গরহাজির ছিলেন। কেন্দ্রীয় সরকার তাঁর বিরুদ্ধে এমন কড়া আইনে ব্যবস্থা করতে উদ্যত, যেখানে এক বছর কারাদণ্ডের বিধানও রয়েছে।

Advertisement

নারকোটিক্স কন্ট্রোল বুরোর উচ্চপদস্থ কর্তা, আইআরএস অফিসার সমীর ওয়াংখেড়ের বিরুদ্ধে রোজ তোপ দাগছেন মহারাষ্ট্রের মন্ত্রী নবাব মালিক। গ্রেফতারি থেকে বাঁচতে সমীর আদালতের শরণাপন্ন। আইপিএস অফিসার পরমবীর সিংহ, মুম্বইয়ের প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার পলাতক। তাঁর নামে মহারাষ্ট্র সরকারই হুলিয়া জারি করেছে।

এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট ওরফে ইডি পশ্চিমবঙ্গের বেআইনি কয়লা পাচার কাণ্ডে তদন্ত শুরু করার পরে কলকাতা পুলিশ ইডি-র অফিসারদের বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা শুরু করেছে।

Advertisement

চারটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। মিল একটাই। চার ক্ষেত্রেই কেন্দ্রীয় সরকার বনাম রাজ্য সরকারের রাজনৈতিক সংঘাতে আমলা থেকে আইপিএস অফিসাররা ঘুঁটি হয়ে গিয়েছেন। কেন্দ্রীয় সরকার তার আমলা, পুলিশ বাহিনীকে বিরোধী শাসিত রাজ্যের বিরুদ্ধে কাজে লাগাচ্ছে। পাল্টা জবাবে রাজ্যের নির্দেশে পুলিশ বা প্রশাসনের কর্তারা কেন্দ্রের অফিসারদের বেকায়দায় ফেলতে কোমর বেঁধে নামছেন।

এ যেন এক নতুন ভারত! দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় কেন্দ্র বনাম রাজ্যের সরকারের বিবাদ এ দেশে নতুন নয়। মুখ্যমন্ত্রীরা যুগে যুগে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে রাজ্যের অধিকারে নাক গলানোর অভিযোগ তুলেছেন। তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় তো জয়ললিতা দিল্লির বিজ্ঞান ভবনে মনমোহন সিংহের সামনেই সটান অভিযোগ তুলেছিলেন, ইউপিএ সরকার রাজ্যের সরকারগুলিকে পুরসভায় পরিণত করতে চাইছে। বিরোধীদের বিরুদ্ধে সিবিআইকে কাজে লাগানোর অভিযোগও সব প্রধানমন্ত্রীর আমলেই ছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো অনুযায়ী কেন্দ্র ও রাজ্য দু’পক্ষই সংবিধানের গণ্ডি মেনে চলত।

নরেন্দ্র মোদী জমানার সাত বছরে কেন্দ্র ও বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলির মধ্যে পারস্পরিক আস্থা এতটাই তলানিতে ঠেকেছে যে, এ বার তা থেকে আইএএস, আইপিএস অফিসাররাও নিষ্কৃতি পাচ্ছেন না। তাঁদেরও রাজনীতির রঙে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ইনি ‘দিদির কাছের লোক’, উনি ‘মোদীর আস্থাভাজন’! প্রশ্ন হল, এতে কি আইএএস, আইপিএস নামক প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার মঙ্গল হচ্ছে? না কি এই প্রবণতা দেশের সংবিধান, গণতন্ত্রের পক্ষেই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে?

ইন্দিরা গাঁধীর জরুরি অবস্থার সময় একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ছিল, আমলাতন্ত্র রাজনৈতিক শাসকদের কতখানি আজ্ঞাবহ হবে? ইন্দিরা বিচারবিভাগের লাগাম নিজের মুঠোয় রাখতে চেয়েছিলেন। সংবাদমাধ্যমের বাক্‌স্বাধীনতা স্রেফ যমুনার জলে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। কিন্তু আমলাতন্ত্র কি তাঁর পুরোপুরি আজ্ঞাবহ ছিল?

ইতিহাস বলে, জরুরি অবস্থা জারির পরে জয়প্রকাশ নারায়ণ ওরফে জেপি-কে গ্রেফতার করে চণ্ডীগড়ে পাঠানো হয়। তখন সেখানে জেলাশাসক এম জি দেবসহায়ম নামে এক আইএএস অফিসার। জেপি-র গ্রেফতারি, বন্দিদশায় তাঁর চিকিৎসার উপরে সরাসরি দিল্লির প্রধানমন্ত্রীর দফতর ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক নজর রাখত। তা সত্ত্বেও দেবসহায়ম গণ্ডি ভেঙে জেপি-কে দু’বার কার্যত প্রাণে বাঁচিয়েছিলেন। এক বার তাঁকে আমৃত্যু অনশনে বসায় বাধা দিয়ে। অন্য বার জেপি অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁকে মুম্বইয়ের হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠাতে উদ্যোগী হয়ে।

নরেন্দ্র মোদী জমানায় কেন্দ্রীয় সরকার শুধু কেন্দ্রের আমলা, পুলিশের থেকেই নিঃশর্ত আনুগত্য দাবি করে না। মনে হয়, রাজ্য সরকারে কর্মরত আমলাদের থেকেও প্রায় একই রকম আনুগত্য প্রত্যাশা করে। ইয়াস ঘূর্ণিঝড়ের পরে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে মুখ্যসচিব হিসাবে আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় থাকতে পারেননি। কারণ তাঁকে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে থাকতে হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর দফতরের অধীন কর্মিবর্গ দফতর আলাপনকে দিল্লিতে বদলির নির্দেশ দিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার প্রক্রিয়া শুরু হল। আলাপন এর বিরুদ্ধে সেন্ট্রাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইবুনালে গিয়েছিলেন। ট্রাইবুনাল কিছু না শুনেই মামলার শুনানি দিল্লিতে পাঠিয়ে দিল। সম্প্রতি কলকাতা হাই কোর্ট ট্রাইবুনালকে তোপ দেগে যা বলেছে, তার মর্মার্থ হল, ট্রাইবুনাল আসলে কেন্দ্রের নির্দেশে ওই কাজ করেছিল।

প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীর সংঘাতের মাঝে পড়ে গিয়ে আলাপনকে সত্যিই শাস্তির মুখে পড়তে হলে, এই ধরনের ঘটনা দেশে প্রথম ঘটবে। কিন্তু তা আইএএস, আইপিএসের মতো সর্বভারতীয় প্রশাসনকে কী বার্তা দেবে?

আইএএস, আইপিএস-দের দায়বদ্ধতা ভারতীয় সংবিধানের প্রতি। দুই ক্ষেত্রেই এই অফিসারদের নিয়োগ করে কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু তাঁরা কেন্দ্র ও রাজ্য, দুই সরকারের হয়েই বিভিন্ন সময়ে কাজ করেন। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রের ক্ষমতা বেশি। কারণ এই অফিসারদের বেতন, কাজের সুযোগসুবিধা, ছুটি, ভাতা এবং বদলি সবই কেন্দ্র ঠিক করে। কিন্তু সব ক্ষেত্রেই কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে একটা বোঝাপড়া থাকে। মুশকিল হয় সেই বোঝাপড়াটা নষ্ট হয়ে গেলে।

নরেন্দ্র মোদী সরকারের আমলে একই সঙ্গে তিনটি ঘটনা ঘটছে। এক, প্রধানমন্ত্রী নিজে আইএএস অফিসার বা ব্রিটিশ জমানার ভাষায় ‘বাবু’-দের হয়ে সব কাজ চালানো সম্ভব কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। দুই, এর ঠিক বিপরীতে তাঁর আস্থাভাজন আইএএস-দের উপরে নরেন্দ্র মোদীর অন্তহীন আস্থা। তিন, তাঁর সরকারের নিঃশর্ত আনুগত্য স্বীকার না করলে আইএএস অফিসারদের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসামূলক পদক্ষেপের অভিযোগও রয়েছে। একই সঙ্গে পুলিশ-প্রশাসনের অফিসারদের রাজনৈতিক স্বার্থে বিরোধীদের বিরুদ্ধে, বা বিরোধী শাসিত রাজ্যের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা, বলা ভাল, অপব্যবহার করার অভিযোগও অঢেল।

গত ফেব্রুয়ারিতে সংসদে দাঁড়িয়ে নরেন্দ্র মোদী প্রশ্ন তুলেছিলেন, “সব কাজ বাবুরা করবেন! আইএএস হয়ে গিয়েছেন বলে সারের কারখানা, রাসায়নিক কারখানা চালাবেন, বিমানও চালাবেন। আমরা এ কোন ক্ষমতাশালী শক্তি তৈরি করে ফেলেছি?” প্রধানমন্ত্রী বেসরকারিকরণ করে, পেশাদারিত্বের সঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা চালানোর পক্ষে সওয়াল করতে গিয়ে হয়তো আইএএস-দের ‘বাবু’ বলে তাচ্ছিল্য করে ফেলেছিলেন। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, পেশাদার অর্থনীতিবিদের বদলে তাঁর সরকার রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নরের পদে ইতিহাসে এমএ আইএএস অফিসারকে নিয়োগ করছে। তাঁর মন্ত্রিসভার অবসরপ্রাপ্ত আইএএস, আইপিএস অফিসারদের ভিড় সবচেয়ে বেশি। শেষ রদবদলেও তিনি পাঁচ জন অবসরপ্রাপ্ত আইএএস-কে মন্ত্রিসভায় নিয়ে এসেছেন। আবার তাঁর আস্থাভাজন অফিসার প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে অবসর নিয়ে বিজেপিতে যোগ দিয়ে উত্তরপ্রদেশে রাজনৈতিক দায়িত্ব পেয়েছেন।

কিন্তু যাঁরা আনুগত্য স্বীকার করেননি? নির্বাচন কমিশনার পদে থেকে অশোক লাভাসা বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন। তাঁর গোটা পরিবারের বিরুদ্ধে আয়কর দফতর থেকে বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সংস্থাকে মাঠে নামানো হয়েছিল বলে অভিযোগ। বিরাগভাজন হওয়ায় সিবিআই ডিরেক্টর অলোক বর্মাকে কোপে পড়তে হয়েছে। দক্ষ অফিসার হয়েও সুভাষ গর্গের মতো আমলাকে অর্থ মন্ত্রকের শীর্ষ পদে কাজ করতে করতে আগাম অবসরের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। আর পরমবীর সিংহ, সমীর ওয়াংখেড়েরা বোধ হয় জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে লড়তে গিয়ে নিজেদের বিপদ ডেকে এনেছেন! কেন্দ্রের শাসকের হয়ে কাজ করতে গিয়ে রাজ্য সরকারের বিদ্বেষের মুখে পড়েছেন! যেমন, আলাপন মুখ্যমন্ত্রীর কথায় হাঁটতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিরাগভাজন হয়ে পড়েছেন।

এর সমাধান কোথায়? সিবিআই কলকাতায় পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারের বাড়িতে হানা দিলে কলকাতা পুলিশ সিবিআই অফিসারদের উপরে পাল্টা চড়াও হবে, সিবিআই তখন আবার রাজীব কুমারকে গ্রেফতার করতে মরিয়া হয়ে উঠবে— এই ভাবে এর সমাধান হয় না।

নরেন্দ্র মোদী গুজরাতে সর্দার বল্লভভাই পটেলের আকাশছোঁয়া মূর্তি বসিয়েছেন। সংবিধান পরিষদের সদস্যরা আমলাদের সমালোচনা করায় পটেল বলেছিলেন, দক্ষ যন্ত্রী কখনও যন্ত্রকে দোষ দেয় না। আমলাদের তিনি দেশের ইস্পাত কাঠামো বলে বর্ণনা করেছিলেন।

নিজেকে পটেলের অনুগামী বলে দাবি করা প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই জানবেন, এই ইস্পাত কাঠামোকে দুর্বল করার অর্থ দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে দুর্বল করা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement