‘বোঝা’?: এনআরসি-র বিরুদ্ধে বেঙ্গল জয়েন্ট কো-অর্ডিনেশন কমিটি-র অবস্থান বিক্ষোভ, গুয়াহাটি, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮। —ফাইল চিত্র।
গত মাসের ১৭ তারিখ সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ অসমের নাগরিকত্বের প্রশ্নে এক সুদূরপ্রসারী রায় দিয়েছে। এই বেঞ্চ ৪-১ মতামতের উপর নির্ভর করে চূড়ান্ত নির্দেশে জানিয়েছে যে, অসমে নাগরিকত্ব অর্জনের জন্য যোগ্যতা হিসাবে ১৯৭১-এর ২৫ মার্চই ভিত্তি তারিখ থাকবে, ১৯৫১ নয়। উল্লেখ্য যে, রাজ্যের বেশ ক’টি অসমিয়া জাতীয়তাবাদী সংগঠন শীর্ষ আদালতে আবেদন জানিয়েছিল যে, ১৯৭১ নয়, সারা দেশে নাগরিকত্ব নির্ধারণে যে ভাবে ১৯৫১-কেই ভিত্তিবর্ষ ধরা হয়, অসমের বেলায় এর অন্যথা হতে পারে না। ২০০৯ সাল থেকে সময়ে সময়ে দাখিল করা মোট নয়টি রিট আবেদন একই সঙ্গে বিবেচনা করে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সাংবিধানিক বেঞ্চ। উল্লেখ্য, রাজ্যে আসু এবং গণসংগ্রাম পরিষদের ছয় বছরের ‘বিদেশি বহিষ্কার আন্দোলন’-এর রাজনৈতিক সমাধান পাওয়া গিয়েছিল অসম চুক্তিতে। ১৯৮৫-র ১৪ অগস্ট মধ্য রাতে স্বাক্ষরিত এই ত্রিপাক্ষিক চুক্তিতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তারিখটি অসমের জন্য নাগরিকত্বের ‘কাট অফ ডেট’, অর্থাৎ ভিত্তি নির্ঘণ্ট হিসাবে স্থির হয়। পরবর্তী কালে, ওই বছরের ৭ ডিসেম্বর সংসদে নাগরিকত্ব আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনে ৬এ ধারাটি সংযোজিত হয়, যা অসমে ভারতীয় নাগরিকত্ব নির্ধারণ ও অর্জনে বিশেষ ব্যবস্থা হিসাবে আইনি পরিকাঠামোয় স্থান করে নেয়। সেই সময়ের অসমে সব রাজনৈতিক দলই রাজীব গান্ধী সরকারের এই পদক্ষেপ পাকা ব্যবস্থা বলে মেনে নেয়। কারণ অসম চুক্তির কাঠামোতে আইনি শুদ্ধতা, সাংবিধানিক নৈতিকতা ও মানবিকতার এক গণতান্ত্রিক ভারসাম্য দেখা গিয়েছিল। আন্দোলনকারী সংগঠনগুলির দাবি অবশ্য গোড়া থেকেই ১৯৫১ ছিল। কিন্তু ওই সময়ে হীনবল আসু এবং গণসংগ্রাম পরিষদের কাছে চাপাচাপি করার মতো পরিস্থিতি ছিল না। ১৯৭১ তাই তাদের যুদ্ধ জয়ের স্বাদ এনে দেয়। উল্টো দিকে, রাজ্যের অভিবাসী বাঙালির কাছেও এই চুক্তি যথেষ্ট পরিমাণে গ্রহণযোগ্য বলেই মনে হয়। ১৯৫১ থেকে ১৯৭১— এই কুড়ি বছরের সুবিধা পেয়ে যান তাঁরা। সব মিলিয়ে এক আদর্শ ‘প্যারেটো’ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, যাতে কোনও পক্ষের ক্ষতি না হয়েও সামগ্রিক ভাবে সব পক্ষেরই লাভ হয়।
কিন্তু অসমিয়া জাতীয়তাবাদের মর্মস্থলে অতৃপ্তি ও অসন্তোষ তো থেকেই যায়। “এই বিশ বছর ধরে যে-বিদেশিরা অসমে এল এবং তাদের সন্তান-সন্ততিদের ধরে এক বিশাল সংখ্যক লোক তো কলমের এক খোঁচায় পুরোদস্তুর ভারতীয় নাগরিক হয়ে গেল। এই বাড়তি ‘বোঝা’ একা অসম কেন বইবে?” সহ-নাগরিক সম্পর্কে ‘বোঝা’ শব্দের মুক্ত ও অবাধ ব্যবহার অসমের সমাজ, রাজনীতি ও গণমাধ্যমে নৈমিত্তিক অনুষঙ্গ। এই মনোভাবের স্পষ্ট প্রতিফলন আমরা দেখেছি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যেও। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে তিনি বলেছেন, এই রায় তাঁর কাছে হরিষে বিষাদ সম। তাঁর মতে অসমিয়া জাতি বরাবর ১৯৫১-ই দাবি করে এসেছে।
অসমের রাজনীতিতে পূর্ববঙ্গ মূলের দেশান্তরি সহ-নাগরিকদের নিয়ে স্থানীয়দের ক্ষোভ চিরকাল সব রাজনৈতিক দলই ব্যবহার করেছে। তবে ২০১৬ সালে বিজেপি প্রথম বারের মতো রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর থেকে অসমের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বড় গোছের পরিবর্তন হয়েছে। অসমিয়া জাতীয়তাবাদ এবং হিন্দুত্বের মিশ্রণ ও মিথস্ক্রিয়া এক নতুন ও অভিনব রাজনৈতিক পুনর্বিন্যাসের জন্ম দিয়েছে। ২০২১-এ বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী বদলের পর থেকে এই প্রক্রিয়ার গতিবৃদ্ধি হয়েছে। ‘জয় আই অসম’ ধ্বনি পাল্টে গেছে ‘জয় শ্রী রাম’-এ। এই সত্যের পাশাপাশি এটাও লক্ষণীয়, অসমিয়া জাতীয়তাবাদী শক্তি বিজেপির গোকুলেই প্রবল ভাবে বাড়ছে। অসম চুক্তির ৬ নম্বর ধারা রূপায়ণে বিচারপতি বিপ্লব কুমার শর্মা কমিটি গঠন হয় ২০১৯-এর ১৫ জুলাই। এর প্রতিবেদনে ‘অসমিয়া’দের ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য মোট ৬৭টি সুপারিশ করা হয়। এ নিয়ে আগে বিস্তারিত আলোচনা করেছি (আবাপ, ২৬/৮/২০২০, ‘অধিকার কাড়ার পাকা ব্যবস্থা’)। এই কমিটি এবং রিপোর্ট নিয়েও যথেষ্ট অস্পষ্টতা রয়েছে। কমিটি গঠন করেছিল কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। খুবই স্বাভাবিক যে, এর রিপোর্টটি জমা পড়বে ওই মন্ত্রকেই। সেটাই দস্তুর। কিন্তু আজ অবধি মন্ত্রকে শর্মা কমিটির কোনও প্রতিবেদন জমা পড়েনি। শিলচরের আইনজীবী ধর্মানন্দ দেবে তথ্য জানার অধিকার আইনে কেন্দ্রের কাছে জানতে চেয়েছিলেন যে, বিপ্লব শর্মা কমিটির প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে জমা পড়েছে কি না। গত সোমবার কেন্দ্রের সংশ্লিষ্ট আধিকারিক ওই আরটিআই প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছেন যে, কেন্দ্রের কাছে কোনও প্রতিবেদন জমা পড়েনি। তবে রাজ্যের হাতে তা রয়েছে।
এ দিকে অসম মন্ত্রিসভার হালের বৈঠকে প্রস্তাব গৃহীত হয়ে যায় যে, বিপ্লব কুমার শর্মা কমিটির গুচ্ছ সুপারিশ থেকে ৫২টি রাজ্য সরকার আগামী বছরের এপ্রিলেই রূপায়ণ করবে। বলা বাহুল্য, এতে রাজ্যে অনা-অসমিয়াদের (পড়ুন বাঙালি) প্রায় কোনও অধিকারই থাকবে না। জমির পাট্টা (স্থায়ী বন্দোবস্ত) বণ্টনের বেলায় ইতিমধ্যেই ‘বসুন্ধরা’ প্রকল্পে আবেদনকারীদের জন্য নিয়ম বেঁধে দিয়েছে সরকার। জমির পাট্টা পেতে ভিটেতে অন্তত তিন পুরুষের ধারাবাহিক বসবাসের প্রমাণ দিতে হবে, অথবা ১৯৫১ সালের এনআরসিটি দেখাতে হবে। অভিসন্ধিটি বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় অধিকাংশ বাঙালিই জমির অধিকার হারাবেন। এই জমি নীতি দৃশ্যতই রাজ্যে বসবাসরত ধর্ম নির্বিশেষে বাঙালিদের স্বার্থের পরিপন্থী হয়েছে। এর থেকেও জরুরি প্রশ্ন হচ্ছে, রাজ্যে নাগরিকত্বের ভিত্তিবর্ষ ১৯৫১ সাল হওয়া সঙ্গত কি না— সেটাই যখন শীর্ষ আদালতের বিবেচনাধীন, তখন রাজ্য সরকার নিজেই ভিত্তিবর্ষ কী হবে এর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। নাগরিকত্ব মানে তো শুধু ভোটাধিকার নয়, নাগরিকত্বের নির্যাস হচ্ছে সংবিধানে বর্ণিত প্রতিটি অধিকার সসম্মানে ভোগ করার নিশ্চয়তা।
সুপ্রিম কোর্টের রায়ের মর্মবাণীটি বোঝার সুবিধার জন্য এই প্রেক্ষাপটটি এল। সাংবিধানিক বেঞ্চের কাছে বিবেচ্য বিষয় ছিল নাগরিকত্ব আইনের ৬এ-র সাংবিধানিক বৈধতা পরীক্ষা করে এই ধারাটি বহাল থাকবে কি না সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া। তবে আদালত এর সঙ্গে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও নতুন ধরনের ব্যাখ্যা দিয়েছে।
রাজ্যের জাতীয়তাবাদী শক্তি দেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির আগে থেকেই একটি বিশ্বাসে স্থিত যে, ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষ পিলপিল করে অসমে এসে ঠাঁই নিচ্ছে এবং এতে স্থানীয়দের অস্তিত্ব বিপন্ন হচ্ছে। এই তত্ত্বের সপক্ষে কোনও সাক্ষ্য প্রমাণ কখনও ছিল না। এখনও নেই। এই মামলা চলাকালীন কেন্দ্র কত জন ‘বিদেশি’ রাজ্যে অনুপ্রবেশ করেছে এর কোনও সংখ্যা সুপ্রিম কোর্টে দাখিল করতে পারেনি। আরও গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ হচ্ছে, রাজ্যে দেশান্তরি বাঙালিরা ঠিক কী ভাবে ‘স্থানীয়’দের অর্থনৈতিক অধিকার, ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টিকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে, এরও কোনও নজির সরকার বা আবেদনকারীরা দেখাতে পারেননি।
গত কয়েক দশক ধরে ১৯৭১-বিরোধীরা নতুন এক যুক্তি খাড়া করেছেন, যা সুপ্রিম কোর্টে দায়ের করা তাঁদের আবেদনেও রয়েছে। সংবিধানের ৩৫৫ অনুচ্ছেদে বর্ণিত রয়েছে যে, দেশের জনগণকে বিদেশি আক্রমণ (এক্সটার্নাল অ্যাগ্রেশন) এবং ঘরোয়া বিশৃঙ্খলা (ইন্টারনাল ডিস্টার্বেন্স) থেকে রক্ষা করা সরকারের দায়িত্ব। জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলি এই অনুচ্ছেদ টেনে সুপ্রিম কোর্টে বারংবার বলেছে যে, তখনকার পূর্ব বাংলা এবং বর্তমান বাংলাদেশ থেকে আসা অনুপ্রবেশকারীরা নাকি ‘বহিঃশত্রু’র মতো আচরণ করছে! সুপ্রিম কোর্ট রায়দান করতে গিয়ে এই অভিযোগ পত্রপাঠ নস্যাৎ করে দেয়। সাংবিধানিক বেঞ্চ স্পষ্ট ভাষায় বলেছে যে, সহ-নাগরিকরা ভিন্ন ভাষা-সংস্কৃতির বলেই নিজেদের অধিকার ও অস্তিত্ব বিপন্ন হবে এমন ভাবনার কোনও ভিত্তি নেই। বিশেষ করে যখন এই আশঙ্কার সমর্থনে কোনও তথ্য নেই।
ভারতের মতো একটি উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সহ-নাগরিকদের প্রতি সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হবে? আরও এক বার ভাবার পাঠ দিয়েছে শীর্ষ আদালত।
অর্থনীতি বিভাগ। কাছাড় কলেজ, শিলচর