এক কন্যা রাঁধেন বাড়েন, এক কন্যা খান/ এক কন্যা রাগ করে বাপের বাড়ি যান।’ কন্যার গল্প বটে, তবে এই কন্যারা অঙ্ক কষেন। অঙ্ক কষতে গিয়ে সংসারের হিসাবটা এলোমেলো হয়ে যায় বইকি। নইলে গয়না বন্ধক রেখে কেউ কম্পিউটারের প্রোগ্রাম লেখেন? পৃথিবীর প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রাম। আজকের এক শিশুকেও জিজ্ঞেস করলে সে বলবে, কম্পিউটারের জনকের নাম চার্লস ব্যাবেজ। অথচ, ব্যাবেজের অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিনের জন্য মেধা খরচ করেছিলেন আডা লাভলেস (১৮১৫-১৮৫২, ছবিতে)। তিনি কবি লর্ড বায়রনের পরিত্যক্ত কন্যাও বটে। শুধু পিতা নয়, তাঁকে ভুলে গিয়েছে এই সময়ও। নইলে জন্মের ২০৬ বছর পরও কম্পিউটারের আদি জননীর শিরোপা পেলেন না কেন আডা? তিনি তো তবু অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিনের জন্যে প্রোগ্রাম বানানোর উদ্দেশ্যে আঁক কষতেন। সাধারণ ঘরের এক মেয়ে, চাকরি করেন না, গৃহবধূ, তিনি স্রেফ ভালবেসে অঙ্ক কষতেন। খুব কম ছেলেমেয়ে অঙ্ককে ভালবাসে। এই মেয়েটি কিন্তু অঙ্ককে ভয় পেতেন না মোটেই। অঙ্ক কষতে কষতে এমন বিভোর হয়ে যেতেন, স্কুলবাস থেকে ছেলেকে নামানোর কথাই মনে থাকত না তাঁর। এ কী অনাসৃষ্টি! প্রচলিত ধারণা হল, মেয়েরা অঙ্কে কাঁচা, তারা আর্টস পড়বে— এটাই দস্তুর। মেয়েদেরও এমনটাই ভাবতে শেখানো হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের দুই বোন উপন্যাসে দিদি শর্মিলা, বোন ঊর্মিমালার ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রয়িং নিয়ে মেতে ওঠা দেখে বিস্ময় প্রকাশ করে বলে, “আচ্ছা উর্মি তোর কি ঐ সব আঁকাজোকা, আঁক কষা, ট্রেস করা সত্যিই ভালো লাগে?”
এই রকম আর এক অনাসৃষ্টি অঙ্কের নেশা ছিল হানা নিউম্যানের (১৯১৪-১৯৭১)। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রথম দিনে হত্যা করা হয় তাঁর ইতিহাসবিদ বাবাকে। মাত্র ১৩ বছর বয়সে কাঁধে তুলে নেন সংসারের দায়িত্ব, সেই সময়েই ঝুঁকে পড়েন অঙ্কের দিকে। যদিও পার্থিব প্রাপ্তির হিসাবে বরাবরই গরমিল থেকে গিয়েছে। ইহুদি বিদ্বেষের বাতাবরণে হারাতে হয় চাকরি, ডক্টরেটের মৌখিক পরীক্ষায় তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসকেও পরীক্ষার মুখে পড়তে হয়। ইহুদি বলে কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে বিয়ে করায় বাধা আসে। কিন্তু হানা কোনও বাধাকে বাধা মানেননি।
হানার মতো বন্ধুর জীবনপথ ডরোথি লুইস বার্নস্টেইনেরও (১৯১৪-১৯৮৮)। ছোট থেকেই দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই শুরু। ডক্টরেটের মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয় নির্ধারিত সময়ের অনেক বেশি সময় ধরে। কারণ, তিনি মেয়ে। ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর সময় ছাত্রদের পড়ানো বারণ ছিল তাঁর। প্রখ্যাত গণিতবিদ জি ডি রিচার্ডসনকে চাকরির কথা বললে তিনি একটি মানচিত্র খুলে তাঁকে বলেন— “মিসিসিপির পশ্চিমে তুমি চাকরি পাবে না, যে হেতু তুমি এক জন মহিলা আর ওহায়োর দক্ষিণে কোনও চাকরি পাবে না, যে হেতু তুমি এক জন ইহুদি।” প্রসঙ্গত, তিনিই ‘ম্যাথমেটিক্স অ্যাসোসিয়েশন অব আমেরিকা’র প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন।
হানা এবং ডরোথি দু’জনকেই নতুন মানচিত্র তৈরি করতে হয় গণিতজ্ঞ হিসাবে একটু জায়গা পেতে। দু’জনেরই জন্মশতবর্ষ নিঃশব্দে চলে গিয়েছে। এঁদের আমরা ভুলে গিয়েছি। কারণ, আলেকজ়ান্দ্রিয়ার গণিতজ্ঞ থিয়ন কন্যা হাইপেশিয়ার মতো তাঁদের পাথর ছুড়ে মারা হয়নি, জ্যোতির্বিদ খনার মতো জিব কেটে ফেলা হয়নি, বিশ্বের প্রথম বিজ্ঞানের অধ্যাপিকা লরা ক্যাটেরিনার (১৭১১-১৭৭৮) মতো অধ্যাপনার চাকরি পেতে ৪৪ বছর অপেক্ষাও করানো হয়নি। স্রেফ ভুলে যাওয়া হয়েছে। অবলাবান্ধব কেশবচন্দ্র সেন বলেছিলেন “মেয়েরা আবার জ্যামিতি শিখিয়া কী করিবে?” রামমোহন রায় অবশ্য অনেক আগে বলেছিলেন, “স্ত্রীলোকের বুদ্ধির পরীক্ষা কোনকালে লইয়াছেন যে অনায়াসেই তাহাদিগকে অল্পবুদ্ধি কহেন?”
আমাদের সেই বাঁধা অঙ্কেও ভুল করে দিলেন পোটোদিদি। লীলা মজুমদার তাঁর খেরোর খাতা-য় বলেছেন, “মাথাখানা অংকে ঠাসা ছিল। বাস্তবিক এমন অংকের মাথা আমি আর কোন মেয়ের দেখিনি, যদিও আমি অংকে একশোতে একশো পেতাম।... পোটোদিদি ওরফে স্নেহলতা মৈত্রর কখনো কখনো সংশয় হত তিনি তিনিই, নাকি তিনি তাঁর ছোট বোন বুডু, অমনি ত্রিকোণমিতির খটমটে একটা অংক নিয়ে বসতেন। অংকটা হয়ে গেলে নিশ্চিন্ত হতেন। ‘নাহ, এ অংক কষা বুডুর কর্ম নয়। তাহলে আমি নিশ্চয় আমি’।”
আমরাও নিশ্চিত হই, ইনি লীলাবতীর কন্যে না হয়ে যান না। যে লীলাবতী বিখ্যাত গণিতবিদ দ্বিতীয় ভাস্করের বিধবা কন্যা না স্ত্রী, তা নিয়ে ধন্দ আছে। এমনকি একটা মেয়ের অঙ্কে এত পারদর্শিতা ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার জন্যে তাঁকে কাল্পনিক ভাবতে ভালবাসেন অনেকে। কিন্তু ২০০৮ সালে ‘ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স বেঙ্গালুরু’ থেকে রোহিণী গোড়বোলে এবং রাম রামাস্বামী সম্পাদিত মহিলা বিজ্ঞানীদের যে জীবনীগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, তার নাম লীলাবতীজ় ডটারস। একেই বলে মধুর প্রতিশোধ। যদিও তার জন্য সময় লাগল ৮৫৮ বছর মাত্র (১১৫০ থেকে ২০০৮)!