আহমেদ মাসুদ পালাননি— জানা গেল। পঞ্জশিরের যুদ্ধে তালিবানি বিপক্ষ প্রায়-পরাজিত, দু’নম্বর নেতা মাসুদ তাই তুরস্কে পালিয়েছেন, এ খবর সত্যি নয়। সংবাদে প্রকাশ, তিনি দেশেই আছেন, নিরাপদে আছেন। নিরাপদ? পঞ্জশির প্রদেশের গ্রাম-নগরের রাস্তায় এখন তালিবানি টহল, ধরাছোঁয়ার বাইরে কেবল বিস্তীর্ণ উপত্যকাগুলি। হয়তো সেখানেই আছেন মাসুদ, কিংবা নেই, সেটুকু জানানোর মতো নিরাপত্তাও অনুপস্থিত। এই লড়াই-ই শেষ লড়াই। দুর্গম গিরিরাজির খাঁজখোঁজে লুকিয়ে যত দিন হিংস্র রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা যায়।
তাঁর বাবার ভালনাম আহমেদ শাহ মাসুদ, ডাকনাম ‘পঞ্জশিরের সিংহ’। সোভিয়েট-দখলের দশ বছর (১৯৭৯-৮৯) পরাক্রমের অভিজ্ঞানেই এই গেরিলা কম্যান্ডারকে চিনেছিল বহির্বিশ্ব। তাঁকে হত্যার চেষ্টা করেছে কেজিবি আর তার আফগান সংস্করণ ‘খাদ’, পরবর্তী কালে তালিবান, আইএসআই, মুজাহিদিন নেতা গুলবউদ্দিন হেকমতিয়ার। কই মাছের প্রাণ শেষাবধি আল কায়দার ফাঁদে ধরা দেয়, ২০০১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর আত্মঘাতী বোমায় নিহত হন মাসুদ।
জ্যেষ্ঠপুত্র আহমেদ মাসুদ তখন মাত্র ১২। বাবা যখন প্রতিবেশী তাজিকিস্তানে বসে নর্দার্ন অ্যালায়েন্স গড়ে তালিবানের বিরুদ্ধে লড়েছেন, দেশের দশ শতাংশ কব্জায় এনে ফেলেছেন, ইউরোপীয় পার্লামেন্টের কাছে আর একটু সহায়তার আবেদন জানিয়েছেন, পুত্র তখন ইরানে লেখাপড়ায় ব্যস্ত। অতঃপর রয়্যাল মিলিটারি অ্যাকাডেমি স্যান্ডহার্স্ট-এ সেনা প্রশিক্ষণ; কিংস কলেজ লন্ডনে যুদ্ধশাস্ত্রে স্নাতক; সিটি, ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে স্নাতকোত্তর। গবেষণার বিষয়, তালিবান।
দ্য লায়ন কিং ছবির কথা মনে পড়ে। সিংহশাবকের পক্ষে বেশি দিন জঙ্গলের হিসাবনিকাশ ভুলে থাকা সম্ভব নয়। অতএব, ২০১৬-য় দেশে ফিরে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘মাসুদ ফাউন্ডেশন’-এর সিইও হয়ে বসলেও বছর তিনেকের মধ্যেই রাজনীতিযোগ, বাবার মতোই সুইস মডেলের সওয়াল— ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। জনজাতি আর বংশে শতধাবিভক্ত দেশ, স্থানীয় গোষ্ঠীপতি আর যুদ্ধনেতাদের (ওয়ারলর্ড) রমরমা, তাঁরাই জনতার নেতা, রাজনীতির চালক। এমন দেশকে ধর্ম ছাড়া অন্য কোনও ভাবে বাঁধতে গেলে কাবুল থেকে বার করতে হবে সরকারকে, রাজনৈতিক ক্ষমতা ছড়িয়ে দিতে হবে অঞ্চলে-অঞ্চলে। আঞ্চলিক সম্পদ আর প্রাদেশিক কর্তৃত্ব স্থানীয় নেতৃবর্গের হাতে থাকলে অন্তত কিছুটা সমৃদ্ধি ও স্থায়িত্ব আসতে পারে আফগানিস্তানে। নচেৎ, কাবুলের কেন্দ্রীয় ক্ষমতা দখল নিয়ে নানা দলের সহিংস কোন্দলই ভবিতব্য। আফগান শান্তি প্রক্রিয়াও, অতএব মাসুদের মতে, সব আফগানের স্বার্থ দেখেনি। সে সময়ই বাবার ধাঁচে নর্দার্ন অ্যালায়েন্স গড়া, কাবুল পতনের পর দেশের পলাতক ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরুল্লা সালে-র সঙ্গে হাত মিলিয়ে যুদ্ধ। আমেরিকার মিডিয়ায় জানিয়েছেন, যদি কিছু লোকবল আর অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া যায়। তার পর কানাকড়ি না মিললেও হাজারখানেক যোদ্ধা নিয়েই দম রেখে গিয়েছেন।
এখন তালিবানের দাবি, পঞ্জশিরের সত্তর ভাগই দখল হয়ে গিয়েছে। আর জোটনেতা বলছেন, আসলে চল্লিশ ভাগও নয়। হিসাব যা-ই হোক, পঞ্জশির ভাল নেই। রাস্তা কাটা, টেলিকম পরিষেবা স্তব্ধ, খাবার অমিল, বিদ্যুৎ নেই, স্কুল-কলেজ বন্ধ, বহু মানুষ নিখোঁজ। তার মধ্যেই অনেকের বিশ্বাস, গুহায় লুকিয়ে আছেন মাসুদ, সুযোগ পেলেই তাঁদের পরিত্রাণে নামবেন। নারী অধিকারের পক্ষে এবং যথেচ্ছাচার ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে মরণপণ সংগ্রাম করবেন। ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন? হতেও পারে! গত কয়েক দশক আফগান জনতা সে ভাবেই বাঁচতে শিখে গিয়েছেন। ধ্বংস আর আশার লীলাখেলায়। রুক্ষ পথেপ্রান্তরে নানা জনজাতির লড়াই, বোমায়-বোমায় ধ্বস্ত হয়ে যাওয়া শহর, কখনও বা সোভিয়েট-আমেরিকার আধুনিক সভ্যতার কিঞ্চিৎ স্পর্শ, প্রতিষ্ঠান-পরিকাঠামো-সৌধ নির্মাণের বহর, এবং তার ফাঁকেই কোনও স্বদেশি সংগ্রামীর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অবিরাম লড়াই— এ যেন শ্রয়েডিঙ্গারের বিড়ালের মতো জীবিত ও মৃত।
মাসুদের জীবনপঞ্জি যেন এই অস্থিরতারই সাক্ষ্য। বাবার হত্যার পর যুদ্ধ নিয়ে পড়াশোনা। নামীদামি বিদেশি প্রতিষ্ঠানে গিয়েও লক্ষ্যটি স্থির— আফগানভূমে খাঁটি ও সভ্য স্বদেশি শক্তির প্রতিষ্ঠা। বাবা ছিলেন সোভিয়েটের বিরুদ্ধে, তালিবানেরও। বিদেশি আগ্রাসনের মতো স্বদেশি বর্বরতাও নৈব নৈব চ। ইসলামি প্রজাতন্ত্রে মরণোত্তর ‘জাতীয় বীর’-এর খেতাব, ‘মাসুদ দিবস’ নামে অবকাশ, ফ্রান্সে সম্মানফলক, তাজিকিস্তানে সর্বোচ্চ সম্মান, হো চি মিন-চে-টিটোর সঙ্গে এক সারিতে নামোল্লেখ। দেশ আজও তেমনই অস্থির, এবং যোগ্য উত্তরসূরির মতো তেমনই মাটি কামড়ে পড়ে আছে তাঁর পুত্রও। তালিবানি দখলের মাঝে একটুখানি অন্য স্বর— অন্য আফগানিস্তান। যৎকিঞ্চিৎ আশার আলো।