কাঠামোগত এবং প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যাগুলিই অর্থনীতির বাধা
Indian Economy

অনেক পথ এখনও বাকি

ভারতে কর ও জিডিপি-র অনুপাত এত কম কেন, এই প্রশ্নের উত্তরে ভারতের অস্বাভাবিক রকম বড় অসংগঠিত ক্ষেত্রের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করতে হবে।

Advertisement

প্রণব বর্ধন

শেষ আপডেট: ১০ অগস্ট ২০২২ ০৪:১৯
Share:

নাগরিক: পরিযায়ী শ্রমিক পরিবারের পথ হাঁটা। নয়াদিল্লি, ২০২০।

ভারতের সংবিধানের সূচনায় লেখা আছে, এই দেশ এক ‘সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’। আজকের ভারত সম্বন্ধে এই বিশেষণগুলোর একটাও ব্যবহার করা মুশকিল। ভারত অবশ্য কোনও কালেই ‘সমাজতান্ত্রিক’ ছিল না, যদি না কেউ রাষ্ট্রবাদের সঙ্গে সমাজতন্ত্রকে গুলিয়ে ফেলেন। ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নটি জটিল, কিন্তু এখনকার রাষ্ট্রনায়কদের কথা ও কাজে স্পষ্ট যে, ধর্ম ও রাষ্ট্রের মধ্যে ‘নীতিগত ব্যবধান’ বজায় রাখার নীতিটিও আজকের ভারতে সম্পূর্ণ বিস্মৃত। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিতে বহু দশক ধরেই ক্ষয় ধরেছে, কিন্তু গত কয়েক বছরে সেই ধ্বংস এমনই গতিশীল হয়েছে যে, সুইডেনের ভি-ডেম ইনস্টিটিউট ভারতকে বলেছে ‘ইলেক্টরাল অটোক্রেসি’ বা নির্বাচন-অনুমোদিত স্বৈরতন্ত্র।

Advertisement

এই প্রবন্ধে আজকের ভারত নিয়ে যে কথাগুলি বলব, অনেকের কাছেই হয়তো তা খুব নেতিবাচক মনে হবে। তাই গোড়াতেই জানাই যে, স্বাধীনতার পর থেকে বহু ক্ষেত্রেই ভারত প্রভূত উন্নতি করেছে— আয়, প্রত্যাশিত গড় আয়ু, সাক্ষরতার হার বেড়েছে; পরিবহণ ব্যবস্থা, রাস্তাঘাট, যোগাযোগ ব্যবস্থা-সহ অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির বহু দিকের উন্নতি ঘটেছে; বেসরকারি ক্ষেত্রের কিছু অংশ টগবগ করছে; প্রযুক্তির উন্নতি হয়েছে, ডিজিটাল ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে; অন্যান্য আর্থ-সামাজিক সূচকেরও উন্নতি হয়েছে। জনসংখ্যার বেশির ভাগই এখন তরুণ, দেশ জুড়ে ব্যবসায়িক উদ্যোগের উদ্দীপনাও রয়েছে, যোগাযোগ ব্যবস্থার চমকপ্রদ উন্নতি ঘটেছে (প্রধানত, মোবাইল ফোন, সড়ক ও ডিজিটাল প্রযুক্তির উন্নতির ফলে)।

কিন্তু, ভারতের বেশ কয়েকটি কাঠামোগত এবং প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা রয়েছে, যা দেশকে তার সম্পূর্ণ ক্ষমতায় বিকশিত হতে দিচ্ছে না। এই প্রবন্ধে— এবং পরবর্তী সময়ে আরও একাধিক লেখায়— তেমনই কয়েকটি সমস্যাকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করব। এই আলোচনায় মূলত দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাগুলির কথাই বলব, অতিমারির মতো কারণে যে তীব্র কিন্তু সাময়িক সমস্যাগুলি তৈরি হয়েছে, এই লেখায় সেই প্রসঙ্গে বিশেষ ঢুকব না।

Advertisement

প্রথম সমস্যা পরিকাঠামোর ঘাটতির। স্বাধীনতা অর্জনের সাড়ে সাত দশক পরেও রেল, সড়ক, বিদ্যুৎ, সেচ, বন্দর, বিমানবন্দর এবং অধুনা ব্রডব্যান্ড সংযোগ, সব ক্ষেত্রেই বিপুল ঘাটতি থেকে গিয়েছে। দীর্ঘ দিন ধরেই সরকারের বাজেটের বড় ভাগ চলে যায় ভর্তুকি আর বেতন দিতে, পুরনো ঋণ মেটাতে। পরিকাঠামো খাতের জন্য পড়ে থাকে সামান্যই। তার উপরে আছে পরিচালনার ব্যর্থতা, লালফিতের ফাঁস, অস্বচ্ছ নিয়মকানুন, দুর্নীতি ও সাঙাততন্ত্র, এবং এখন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির খাতায় ক্রমবর্ধমান অনাদায়ি ঋণের পাহাড়।

দ্বিতীয় ঘাটতি শিক্ষায়। দেশে বহু চাকরির জন্যই ন্যূনতম যোগ্যতা লাগে মাধ্যমিক শিক্ষার। কিন্তু, সেই অবধি লেখাপড়া করার আগেই দরিদ্র পরিবারের বিপুলসংখ্যক ছেলেমেয়ে স্কুলছুট হয়— অর্থনৈতিক কারণে, মেয়েদের ক্ষেত্রে বিয়ে করার চাপেও। এতে মানবসম্পদের গুণগত মানের প্রভূত ক্ষতি হয়। তৃতীয়ত, স্কুল-কলেজের শিক্ষার গড় মানও নিচুই থেকে গিয়েছে— আজকের বেশির ভাগ চাকরির জন্যই সেই শিক্ষা যথেষ্ট নয়। বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ, দক্ষতা তৈরি, এবং বিশেষত গ্রামাঞ্চলে এবং ছোট শহরে প্রশিক্ষিত ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিয়োগকারী সংস্থার যোগাযোগ দুর্বল। এই ‘উদ্বৃত্ত শ্রম’-এর দেশে নিয়োগযোগ্য শ্রমিকের বড়ই অভাব।

চতুর্থত, অতিমারি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যে, জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ভারতের অবস্থা ভয়াবহ। গত কয়েক বছরে অতি উৎসাহী ভঙ্গিতে শৌচাগার তৈরি হয়েছে বটে, কিন্তু সেগুলির বেশ কিছু অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকে, এবং জনস্বাস্থ্যে (যেমন শিশুদের দৈহিক বৃদ্ধির মতো ক্ষেত্রে) সেই শৌচাগার নির্মাণের ইতিবাচক প্রভাব পড়ে না। জনস্বাস্থ্য ও নিকাশিতে খামতির ফলে রোগব্যাধির প্রকোপ বিপুল, শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতাও কম।

পরিবেশের ক্ষতিও অর্থব্যবস্থায় মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। ২০১৪ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবোন্নয়ন রিপোর্টে বলা হয়েছিল, ভারতে প্রতি বছর যে পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষয় হচ্ছে, তা দেশের জাতীয় আয়ের পাঁচ শতাংশ। তখন দেশের জাতীয় আয় বৃদ্ধির হার এর কাছাকাছিই ছিল। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল পারফর্ম্যান্স ইনডেক্স-এ ভারতের স্থান ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৭৭তম। বিশ্বের সবচেয়ে বায়ুদূষিত ২০টি শহরের মধ্যে পনেরোটিই ভারতে। ভূগর্ভস্থ জল ব্যবহারে ভারত দুনিয়ায় এক নম্বরে— পরের দু’টি দেশ, চিন ও আমেরিকা, মোট যত ভূগর্ভস্থ জল ব্যবহার করে, ভারতে তার চেয়ে বেশি জল ব্যবহৃত হয়। ফলে, জলস্তর হুহু করে নামছে— পুকুর, কুয়ো, এমনকি ছোট নদীও সম্পূর্ণ শুকিয়ে যাচ্ছে। মাটি আরও লবণাক্ত হচ্ছে, মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে। এখনও দেশের মোট শক্তির জোগানের ৭০% আসে কয়লা পুড়িয়ে— কয়লায় ভর্তুকিও পুনর্নবীকরণসাধ্য শক্তির ক্ষেত্রে ভর্তুকির চেয়ে অনেক বেশি। জীবাশ্ম-জ্বালানি শিল্পে বিনিয়োগও তুলনায় বেশি।

উপরোক্ত সমস্যাগুলির প্রতিটির ক্ষেত্রেই গণপরিসরে পণ্য ও পরিষেবার ব্যবস্থার প্রয়োজন, যার সঙ্গে সরকারের প্রশাসনিক কুশলতার প্রশ্নটি জড়িত। ভারতে এই কুশলতার হার অতি নিম্ন। প্রশাসন কতখানি কুশলী হতে পারে, এই লেখায় রাষ্ট্রের সক্ষমতার পরিপ্রেক্ষিতে তার উত্তর সন্ধান করব। রাষ্ট্রের সক্ষমতাকে চারটি পরস্পর-সম্পর্কিত মাপকাঠিতে দেখা যায়: সাংগঠনিক, কারিগরি, আর্থিক ও রাজনৈতিক। রাষ্ট্রের বিভিন্ন ধরনের দায়িত্ব সম্পাদনের ক্ষেত্রে সাংগঠনিক সক্ষমতার বিভিন্ন মাপ দেখতে পাওয়া যায়। বিশ্বের বৃহত্তম সাধারণ নির্বাচন, দ্বিতীয় বৃহত্তম জনশুমারি, বা বিশ্বের অন্যতম বড় কিছু ধর্মীয় উৎসব সংগঠনে ভারতীয় রাষ্ট্র মোটামুটি কুশলী। এই কাজের সবই একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সেরে ফেলতে হয়। অন্য দিকে, ন্যায্য দামে সর্ববিস্তৃত বিদ্যুৎ বণ্টনের মতো দৈনন্দিন জরুরি কাজে সরকার রীতিমতো অকুশলী।

কাজের সঙ্গে উন্নতির যোগ না থাকাতেও সাংগঠনিক সক্ষমতার ক্ষতি হয়। যেমন, পদোন্নতি ঘটে বয়স মেনে, কর্মদক্ষতার ভিত্তিতে নয়। ঘন ঘন, এবং অসুবিধাজনক বদলির হুমকিও কর্মীদের বাধ্য করে রাজনৈতিক নেতৃত্বের বশংবদ থাকতে। নিজের দক্ষতা বৃদ্ধির চেয়ে রাজনৈতিক সংযোগ তৈরিতে মনোযোগী হলে কর্মীরা লাভবান হন বেশি। নিয়মিত নজরদারি না থাকায় ফাঁকির অঢেল সুযোগ। আবার, সৎ উদ্দেশ্যেও যদি কোনও সরকারি কর্মী কোনও ভুল সিদ্ধান্ত নেন, তা হলে তদন্তের মুখে পড়ে বিপুল হয়রানির সম্ভবনা। ফলে, ঝুঁকি নিয়ে কাজ করার চেয়ে হাত গুটিয়ে রাখাই অনেকে নিরাপদ ভাবেন। সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতিতে প্রশ্রয় দেওয়া, বা সরাসরি দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার ঘটনাও আকছার ঘটে।

রাষ্ট্রের কারিগরি সক্ষমতার প্রশ্নটিও গুরুত্বপূর্ণ। তথ্যপ্রযুক্তির বিস্তার সেই পরিসরটিকে আরও বাড়িয়েছে। যেমন, গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, বায়োমেট্রিক-নির্ভর পারিশ্রমিক প্রদানের পদ্ধতি গৃহীত হলে দ্রুততর ভাবে, অধিকতর নিশ্চয়তার সঙ্গে কাজ হচ্ছে, তুলনায় কম দুর্নীতি হচ্ছে, কিন্তু প্রকল্পটি মানুষের কাছে পৌঁছচ্ছে সমান ভাবেই। বিচারব্যবস্থা, অডিট এবং অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার ক্ষেত্রেও এই পথে প্রশাসনিক সক্ষমতা বৃদ্ধির কথা ভাবা প্রয়োজন। জমির রেকর্ড নথিভুক্ত করা, বা লেনদেনের ক্ষেত্রে ডিজিটাল ব্যবস্থা ব্যবহার করে অত্যন্ত ইতিবাচক ফল পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু, অন্য দিকে, (তথ্য)প্রযুক্তির বর্ধিত ব্যবহার, এবং নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য আহরণে রাষ্ট্রের ক্ষমতাবৃদ্ধির নেতিবাচক দিক হল, রাষ্ট্রের নাগরিকের উপর নজরদারির ক্ষমতাও বাড়ে। বর্তমান কেন্দ্রীয় শাসকরা এই ক্ষমতার অপব্যবহার করে, এবং তারই সঙ্গে ঔপনিবেশিক আমলের কিছু আইনকে অস্ত্র বানিয়ে নাগরিক সমাজের মধ্যে থেকে উঠে আসা যে কোনও প্রতিবাদী স্বরকে স্তব্ধ করতে সচেষ্ট।

রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের আর্থিক সামর্থ্য অত্যন্ত সীমিত। তার ফলে, রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিসরও সীমিত। ২০১৯-২০ সালে ভারতে কর ও জিডিপি-র অনুপাত ছিল ১৭ শতাংশ। একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে এই অনুপাতটি অনেকখানি কম তো বটেই, আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে এই অনুপাত যা ছিল, এটি তার চেয়েও সামান্য কম। এই অর্থাভাবের কারণেই ভারতীয় রাষ্ট্রে মঞ্জুর হয়ে যাওয়া সরকারি কর্মীর পদও খালিই থেকে যায়, তা ছাড়া প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম পদ মঞ্জুর হয়। ২০১৪ সালে ভারতে প্রতি এক হাজার জনসংখ্যা-পিছু সরকারি কর্মীর সংখ্যা ছিল আমেরিকার অর্ধেক। উত্তর ও মধ্য ইউরোপে এই অনুপাত আরও অনেক বেশি। ভারতে পুলিশ, বিচারবিভাগ, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা-সহ সরকারের প্রতিটি শাখাতেই বহু পদ দীর্ঘ দিন ধরেই শূন্য পড়ে রয়েছে, যার সবটাই অর্থাভাবের কারণে নয়। যে কর্মীরা দফতরে রয়েছেন, বহু পদ খালি থাকার কারণে তাঁদের উপর কাজের চাপ খুবই বেশি, ফলে বহু ক্ষেত্রেই তাঁরা নিতান্ত অকুশলী হয়ে পড়েন। এই পরিস্থিতিটি রাজনীতিকদের পক্ষে ভাল— নিজেদের প্রাপ্যটুকু আদায়ের জন্য সরকারি দফতরে ঘুরে ঘুরে জুতো ক্ষয়ে যাওয়ার পরই মানুষ নেতাদের দ্বারস্থ হন। নেতাদের কাছে তা এক ক্লায়েন্টেলিস্ট বা পোষকদারি ব্যবস্থা গড়ে তোলার মোক্ষম সুযোগ, তাঁরা মানুষকে তাঁদের কিছু পাইয়ে দিয়ে ভোটের দাবি করেন।

তবে, সরকারের অর্থাভাবের সমস্যাটিও গুরুতর। অতিমারি আরম্ভ হওয়ার আগেই কেন্দ্রীয় সরকার মোট যা ধার করছিল, তার ৭০ শতাংশ চলে যাচ্ছিল চালু খাতের খরচ মেটাতেই— প্রধানত মাইনে দিতে, এবং আগেকার ধারের উপর সুদ মেটাতে। তার ফলে মূলধনি খাতে ব্যয়ে টান পড়ছিল। অতিমারির সময় অনেকের চাকরি চলে গেল, আরও অনেকের আয়ের পরিমাণ কমল। বিশেষত শহরের অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরতদের উপর প্রবল ধাক্কা লাগল। অথচ, এই পরিস্থিতিতে ত্রাণব্যয়ের নিরিখে ভারত দুনিয়ার কৃপণতম দেশগুলির মধ্যে একটি। অনুমান করা চলে, তার কারণ হল দেশের বিপুল রাজকোষ ঘাটতি, এবং আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং এজেন্সিগুলির দেওয়া রেটিং বা মূল্যায়নের বিষয়ে (অত্যধিক) দুশ্চিন্তা।

ভারতে কর ও জিডিপি-র অনুপাত এত কম কেন, এই প্রশ্নের উত্তরে ভারতের অস্বাভাবিক রকম বড় অসংগঠিত ক্ষেত্রের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করতে হবে। কৃষিশ্রমিকদের বাদ রাখলেও দেশের মোট শ্রমিকের প্রায় পঁচাত্তর শতাংশ কাজ করেন অসংগঠিত ক্ষেত্রে। তাঁদের বেশির ভাগই প্রত্যক্ষ করের আওতায় পড়েন না। কিন্তু সংগঠিত ক্ষেত্রেও করের হার কম। যেমন, ব্যক্তিগত আয়ে (দীর্ঘমেয়াদি) মূলধনি লাভের উপর করের হার ব্রাজিল, চিন বা দক্ষিণ আফ্রিকার তুলনায় অনেক কম। লগ্নি করলে ব্যক্তিগত আয়করের উপরে ছাড়ের সুবিধাও পান প্রধানত ধনীরাই। এ দেশে বিত্তকর, এবং উত্তরাধিকার করের পরিমাণ শূন্য, এমনকি সাম্প্রতিক কালে দেশে বিত্তশালীদের সম্পদের পরিমাণ বহুলাংশে বৃদ্ধি পাওয়ার পরেও।

পরোক্ষ করের বোঝা স্বল্পবিত্তের উপরে তুলনায় বেশি। ভারতে পরোক্ষ কর বাবদ আদায় হওয়া রাজস্বের পরিমাণ ধারাবাহিক ভাবে বেড়ে চলেছে। তা ছাড়াও, বিভিন্ন ধরনের কর ছাড়, সুবিধা, এবং মূলত সমাজের বিত্তশালী অংশের ভোগ করা ভর্তুকির পরিমাণ এই দেশে জিডিপি-র প্রায় আট শতাংশ। মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে খুশি করার জন্য ২০১৯ সালে করহীন আয়ের সীমা বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা হল। দেশে এমনিতেই আয়করদাতার সংখ্যা অতি সীমিত— এই ছাড়ের সীমা বাড়ানোর ফলে তাঁদেরও বড় অংশ আয়করের আওতার বাইরে চলে গেলেন। সে বছর সেপ্টেম্বর মাসেই কিন্তু সরকার এক ঝটকায় কর্পোরেট বা বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের উপর করের হার কমিয়ে দিল অনেকখনি। তার ফলে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ যতটা কমল, তা সে বছর স্বাস্থ্যক্ষেত্রের জন্য বাজেট বরাদ্দের প্রায় অর্ধেক। এর থেকে বোঝা যায়, ধনীদের প্রভূত রাজনৈতিক প্রতিপত্তি এবং যোগাযোগ কী ভাবে আর্থিক দিক থেকে ভারতীয় রাষ্ট্রের হাত-পা বেঁধে রাখে।

শেষে যে সক্ষমতাটির কথা বলব, তা হল ভারতীয় রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সক্ষমতা। দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যে অবিচলিত থাকতে পারা, এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠীর অন্যায্য চাপ সামলাতে পারাই মূলত এই সক্ষমতার সূচক। সার বা বিদ্যুতের উপর বিপুল ভর্তুকির পরিমাণ হ্রাস করার ক্ষেত্রে, এবং অবশ্যই অতিধনী কৃষকদের উপরেও আয়কর বসানোর ক্ষেত্রে ভারতীয় রাষ্ট্র যে পরিমাণ বাধার সম্মুখীন হয়েছে, তাতেই বোঝা যায় যে, অতিধনী কৃষক বা সার সংস্থাগুলির স্বার্থের বিরুদ্ধে লড়ার রাজনৈতিক সক্ষমতা ভারতীয় রাষ্ট্রের কত কম। সমীক্ষায় প্রমাণ রয়েছে যে, উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচনের আগেই বিদ্যুৎ সংস্থাগুলির বিদ্যুৎ প্রেরণ ব্যবস্থায় ক্ষতির পরিমাণ (প্রধানত চুরির ফলে) বেড়ে যায়। মূলধনি আয় বা বিত্তের উপর করের পরিমাণ বাড়ানোর ব্যর্থতাও ধনীদের বিরুদ্ধে ভারতীয় রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সক্ষমতার অভাবের প্রমাণ।

ভারতে ‘অফিশিয়াল ক্লাস’-এর— যার মধ্যে প্রথম সারির রাজনৈতিক নেতা ও আমলারা রয়েছেন— কায়েমি স্বার্থও অতি প্রবল। ভারতে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির অধিকাংশই অকুশলী, এর বড় কারণ হল— নেতা বা আমলারা নিজেদের সুবিধা বিলোনোর ক্ষমতা ছাড়তে চান না, এবং সেই কারণেই সংস্থাগুলি খাতায়-কলমে স্বশাসিত হলেও তাদের প্রকৃত অর্থে স্বশাসনের অধিকার দেন না, এই কারণেই সংস্থাগুলি অকুশলী থেকে যায়। ভারতে আর্থিক সংস্কারের পর থেকে অর্থনীতিতে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার আধিপত্য হ্রাস পেয়েছে; কিন্তু চিনে যে ভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বাণিজ্যিকীকরণ হয়েছে, ভারতে তা তেমন ভাবে হয়নি, এবং সংস্থাগুলি এখনও মূলত মন্ত্রীদের অঙ্গুলিহেলনেই পরিচালিত হয়।

এমনকি বেসরকারি ক্ষেত্রেও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলির উপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকার কারণে একচেটিয়া ব্যবসা উৎসাহ পায়, ফলে বাজার বা প্রতিযোগিতা দুর্বল হয়ে পড়ে। প্রায়শই অবসরপ্রাপ্ত আমলারা এই নজরদারি সংস্থাগুলির শীর্ষপদ আলো করে বসেন। যে ব্যবসায়িক স্বার্থের উপর তাঁদের নজর রাখার কথা, সেই গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে অতি ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক শাসকশ্রেণিকে চটিয়ে সেই ব্যবসায়িক স্বার্থের অন্যায় আচরণের পরিপন্থী সিদ্ধান্ত গ্রহণের সদিচ্ছা এঁদের থাকে না বললেই চলে। সাম্প্রতিক কালে এই ধরনের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলির বাড়বাড়ন্তের ফলে সামগ্রিক ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও সমন্বয় আসার বদলে বরং তা হয়ে পড়েছে জটিল, বহুধাবিভক্ত, দু’-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া। অধিকাংশ নিয়ন্ত্রক সংস্থারই দণ্ডদানের ক্ষমতা নেই। ‘পলিটিক্যাল ক্লাস’ বা নেতাশ্রেণির ছড়ি ঘোরানোর আরও একটা উদাহরণ হল এই যে, পুলিশের অনেকাংশ, আমলাতন্ত্রের কিছু অংশ এবং তদন্তকারী সংস্থাগুলোও (যেমন সিবিআই, ইডি বা এনএসএ) অতিমাত্রায় রাজনীতি-দুষ্ট; অনেক সময়ই তারা শাসক দলের ধামাধরা ছাড়া আর কিছু নয়।

ইমেরিটাস অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফর্নিয়া, বার্কলে

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement