শিক্ষাজীবনে এক সঙ্গে সময় কাটাতে হয় বলে সহপাঠীদের উপর অধিকার জন্মায়। এই অধিকারবোধ থেকে প্রাণ খুলে কথা বলা যায়, সব বিষয়ে তুমুল তর্ক করেও বন্ধুত্বে ফেরা যায়। কিন্তু এ বার গেল না।
ভোটের কিছু আগে ছুটির দিনের অলস সকালের মামুলি কথোপকথন শেষ হল ‘এ রাজ্যে মুসলমানদের বাড়’ দিয়ে। মহরমের কারণে দেবী দুর্গার বিসর্জন কেন পিছোতে হয়েছে, এই প্রশ্নেই সবচেয়ে বেশি আঘাত পেয়েছেন প্রবাসী বন্ধু। এ ব্যাপারে আমার নীরবতা তাঁকে আঘাত করেছে, এবং ‘মুসলমানের বাড়’-এর লম্বা ফিরিস্তি নিয়ে হাজির হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। ‘বাড়’-এর একমাত্র কারণ— আমার বন্ধুর কথায় এবং অগণন বাঙালির মতে— ‘দিদির মুসলমান তোষণ’। লোকাল ট্রেনের সহযাত্রীর স্বীকারোক্তি: “আমার মেয়ে সবুজ সাথীর সাইকেল পেয়েছে, কন্যাশ্রীর পঁচিশ হাজার টাকাও পেয়েছে, তবে দিদি মুসলমানদের জন্য একটু বেশি বেশি করেছে, এমনকি ইমামরাও ভাতা পেয়েছে।” দিদির পার্টির দাপটে এ নিয়ে আগে মুখ খুলতে পারেননি, পালে হাওয়া পেয়েছেন দিল্লি থেকে আসা দুই নেতার উচ্চগ্রামে অভিযোগের পর। বিজেপির ছোট-মেজো-বড় নেতাদের মুখে ঘুরেফিরে এসেছে ‘পশ্চিমবঙ্গকে বাংলাদেশ বানানোর চেষ্টা’ অথবা ‘ক্রিকেটে পাকিস্তান জিতলে ওই পাড়ায় বাজি ফাটে’। এই ‘তোষণ’-এর সঙ্গে যোগ হয়েছে মুসলমানদের সম্পর্কে পুরনো অতিকথনও। যেমন, একাধিক সন্তানের কারণে ক্রমাগত জনসংখ্যা বৃদ্ধি অথবা বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারী ঢুকে পড়া। এই দাবির সমর্থনে গবেষণায় কিছু পাওয়া যায় না, অথচ নির্বাচনে প্রসঙ্গগুলি তুলে এনে মুসলমানদের সম্পর্কে বিদ্বেষ ছড়ানো হয়। এ বারও হয়েছে।
কিছু অপরিকল্পিত ও রাজনৈতিক চমকের জন্য রমজান মাসে অতিরিক্ত চিনি বরাদ্দ করা হয়, অথবা ইমাম ভাতার মতো প্রতীকী উদ্যাগ তৈরি হয়। এতে মুসলমান সমাজই কঠিন সঙ্কটে পড়ে। এই ‘তোষণ’-এর ফলে মুসলমানের জীবনে কি আদৌ পরিবর্তন হয়েছে? রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান সম্প্রদায়ের অগ্রগতি কতখানি? সাচার কমিটির রিপোর্ট বা পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানরা কেমন আছে, সে বিষয়ে ‘প্রতীচী-স্ন্যাপ’এর সমীক্ষায় দেখা যায় যে, তাদের শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিসরে অংশগ্রহণ আশানুরূপ ছিল না। গত এক দশকে প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে মুসলমানদের অংশগ্রহণ জনসংখ্যার অনুপাতে নিশ্চিত হয়েছে, তবে উচ্চ-প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ছেলেদের স্কুলছুটের প্রবণতা খুব বেশি। সরকারি চাকরির ক্ষেত্র ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে আসছে, এই পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর জন্য সুযোগ আরও কম, সুতরাং পড়াশোনায় সময় নষ্ট না করে অনেকেই পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে অন্য রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছে। মুসলমান মেয়েরা কিছু জনমুখী শিক্ষা প্রকল্পের— যেমন সবুজ সাথী বা কন্যাশ্রী— কারণে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। মনে রাখতে হবে, এই দুই প্রকল্প সর্বজনীন; সব সম্প্রদায়ের সঙ্গে মুসলমান মেয়েরাও উপকৃত হয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে যে অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে, তার একটা বড় কারণ ‘আল-আমিন মিশন’ বা ‘নাবিবিয়া মিশন’-এর মতো কিছু আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অদম্য চেষ্টা। তাদের উদ্যোগেই চিকিৎসা ও বিজ্ঞান পাঠের ক্ষেত্রে চমকপ্রদ কিছু সাফল্য দেখা গিয়েছে। তবে এখনও পর্যন্ত অন্য সামাজিক গোষ্ঠীর চেয়ে মুসলমানরা গড়ে কম সময় স্কুলে কাটায়। আলিয়া বা গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠান তৈরির ফলে উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রে মুসলমানদের সুযোগ বাড়লেও, সামগ্রিক ভাবে রাজ্যে উচ্চশিক্ষায় তাদের অংশগ্রহণ স্নাতক স্তরে ৮ শতাংশ, স্নাতকোত্তরে ৪.২। রাজ্য সরকারের ২০১৬-১৭ স্টাফ সেনসাস অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে মোট ৩২১,০০০ কর্মিবর্গের মধ্যে মাত্র ৬.৮ শতাংশ মুসলমান। ২০১১ সালে সংখ্যাটি ছিল ৫.১৯ শতাংশ, শ্লথ গতিতে সরকারি চাকরিতে তাদের অংশগ্রহণ বাড়লেও জনসংখ্যার অনুপাতে অংশগ্রহণ নিশ্চিত হতে অন্তত ৫০ বছর লাগবে। ২০১৯-এর হিসেব বলছে, কলকাতা পুরসভায় ২১ হাজারেরও বেশি কর্মীর মধ্যে মুসলমান ৫.২ শতাংশ। কলকাতা পুলিশে প্রায় ২৬ হাজার কর্মীর মধ্যে ১১.১৪ শতাংশ। গুরুত্বপূর্ণ সরকারি বিভাগের উচ্চপদে তাঁদের উপস্থিতি আণুবীক্ষণিক।
যে পেশার সঙ্গে ক্ষমতার যোগ, যেমন আইনজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, সে সবে এই বড় জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো নয়। গত এক দশকে বিধানসভায় রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব কিছু বাড়লেও সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনে সেই সংখ্যা ফের নিম্নগামী। বিদায়ী বিধানসভায় ২৯৪ জন সদস্যের মধ্যে ২০ শতাংশ মুসলমান, মন্ত্রিসভায় ৪৪-এর মধ্যে পাঁচ। নগরোন্নয়ন ছাড়া মুসলমান মন্ত্রীদের দায়িত্বে থাকা কোনও দফতরই তত ‘গুরুত্বপূর্ণ’ নয়। এ বার শাসক দলেও মুসলমান প্রার্থীর সংখ্যা কমেছে। বিজেপির রাজনৈতিক উত্থান, এবং বহু গুণে বিধায়ক সংখ্যা বৃদ্ধি এই প্রতিনিধিত্ব হ্রাসের পিছনে নিশ্চিত ভাবেই দায়ী।
দেশভাগের ফলে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে মেরুদণ্ড ভেঙে যাওয়া বাঙালি মুসলমান স্বাধীনতার সাত দশক পরে সবেমাত্র উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। ধর্মীয় পরিচিতি বাদ দিয়ে আর্থ-সামাজিক ভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হিসেবে বঞ্চনার কথা তুলে ধরার চেষ্টা করছে। ঠিক তখনই পশ্চিমবঙ্গে কট্টর হিন্দুত্ববাদের উত্থান ঘটল, মুসলমানদের আবার প্রান্তে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা হল। এ রাজ্যে মুসলমানদের তোষণ করা হয়— পরিসংখ্যান তা বলে না। বরং, তোষণের অভিযোগ তুলে পশ্চিমবঙ্গে এক সঙ্গে বাস করা দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি বিভেদের প্রাচীর তৈরির চেষ্টা হয়। যদিও গত ২ মে তাতে কিছুটা ধাক্কা লেগেছে, আপাতত আশার কথা এটুকুই।
প্রতীচী ইনস্টিটিউট