জাগ্রত: রাত দখল করার আন্দোলনে রাজ্য জুড়ে পথে নামলেন মহিলারা। কলেজ স্ট্রিট, কলকাতা, ১৪ অগস্ট ২০২৪। সুদীপ্ত ভৌমিক।
সিঙ্গুর আন্দোলন শুরু হয়েছিল ২০০৬-এর শেষ দিকে, বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্টের বিপুল জয়ের পরে। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কণ্ঠে তখনও ‘আমরা ২৩৫, ওরা ৩০’-এর আত্মবিশ্বাস। সেই আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরিয়েই প্রথমে সিঙ্গুরের জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে, তার পরে ২০০৭-এর গোড়া থেকে নন্দীগ্রামে জমি অধিগ্রহণের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে রাজ্য জুড়ে প্রতিবাদ শুরু হয়। আর জি কর-কাণ্ডের বিরুদ্ধে চলা বর্তমান প্রতিবাদের সঙ্গে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের একটি বিশেষ মিল রয়েছে— এ ক্ষেত্রেও আন্দোলন শুরু হয়েছে নির্বাচনে রাজ্যের শাসক দলের বিপুল জয়লাভের পরে পরেই। তৃণমূল কংগ্রেস আগের বারের থেকে সাতটি আসন বাড়িয়ে ২৯টি লোকসভা কেন্দ্র জিতেছে, বিজেপির আসনসংখ্যা ১৮ থেকে কমে ১২।
নেতারা অনেক সময়ই ধরে নেন যে, নির্বাচনে জয়ের অর্থ হল ভোটার বা নাগরিকের প্রশ্নাতীত আনুগত্য। কিন্তু গণতন্ত্রে সচেতন নাগরিক কাউকে ভোট দিলেও রাজনৈতিক দাসখত লিখে দেন না। রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ দু’তিন মাস আগেই তৃণমূলকে ভোট দিয়েছেন। সেই মানুষই আবার তৃণমূলের শীর্ষনেতৃত্ব আর জি কর-কাণ্ডে ভুল পদক্ষেপ করায় পথে নামতে দেরি করেননি। গণতন্ত্রের জন্য এটা নিঃসন্দেহে সুসংবাদ।
রাজ্যের রাজনীতিতে আসল প্রশ্ন অবশ্য অন্য— আর জি কর-কাণ্ডের রাজনৈতিক প্রভাব কতখানি সুদূরপ্রসারী?
দু’বছরের মাথায় রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন। যে কোনও নাগরিক আন্দোলনকেই রাজনৈতিক নেতারা তাঁদের ফয়দার জন্য ব্যবহার করতে চান। সিপিএম, বিজেপিও ঠিক সেই চেষ্টাই করছে। দুই দলই এই নাগরিক আন্দোলনকে একটা রাজনৈতিক সূচিমুখ দিতে চাইছে। তা হল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদত্যাগের দাবি। হাতে-গরম উদাহরণ, বাংলাদেশে সংরক্ষণ বিরোধী আন্দোলন আচমকাই ‘শেখ হাসিনা হটাও’ আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী তা আঁচ করেই বলেছেন, বিরোধীরা পশ্চিমবঙ্গে ‘বাংলাদেশ’ করতে চাইছেন।
গত বিধানসভা নির্বাচন, সদ্যসমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে সিপিএম পশ্চিমবঙ্গে শূন্য হাতে ফিরেছে। তা সত্ত্বেও আর জি কর-আন্দোলন থেকে স্পষ্ট যে, বাঙালির মননে এখনও বামেদের প্রভাব রয়েছে। বামেদের দেখানো পথেই নাগরিক আন্দোলন শুরু হয়। মহিলাদের ‘রাত দখল করো’ প্রতিবাদও মূলত বাম মস্তিষ্কপ্রসূত ভাবনা। তাতে রাজ্যের মহিলারা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে যোগ দিয়েছেন। নিজেদের সাংগঠনিক সমস্যায় জেরবার বিজেপি রাস্তায় নামতে দেরি করেছিল। তবে শেষ পর্যন্ত এই আন্দোলন থেকে যদি রাজনৈতিক সুবিধা মেলে, তা বিজেপিই ঘরে তুলবে।
নাগরিক আন্দোলনের ঢেউ কতখানি ধাক্কা দিতে পারে, তা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সবচেয়ে ভাল জানেন। তাঁর মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে উত্থানই সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের মাধ্যমে। তিনি নিজে সিঙ্গুরের টাটা মোটর্সের জমির বাইরে আন্দোলনের মঞ্চ তৈরি করেছিলেন। এখন তিনি কোনও ভাবেই বিজেপি বা সিপিএমকে পাকাপাকি আন্দোলনের মঞ্চ বাঁধতে দিতে নারাজ। ১৪ অগস্ট রাতে আর জি করে ভাঙচুরের পরে পুলিশ-প্রশাসন প্রথম সুযোগেই হাসপাতালের বাইরের রাস্তায় সিপিএমের গণ সংগঠনগুলির আন্দোলনের মঞ্চ ভেঙে ফেলেছে। বিজেপিকেও শ্যামবাজারে মঞ্চ বেঁধে আন্দোলনে বসতে দেওয়া হয়নি।
২০১২ সালে দিল্লিতে নির্ভয়া-কাণ্ডের পরে দেশ জুড়ে খুন-ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদ আন্দোলন হয়েছিল। দিল্লির সরকারি ক্ষমতার কেন্দ্র রাইসিনা হিলসের সামনে বিক্ষোভে শামিল হয়েছিলেন আমজনতা। সেই আন্দোলনের মূল দাবি ছিল, যৌন নির্যাতন রুখতে কড়া আইন। এ বিষয়ে প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি জে এস বর্মার নেতৃত্বে কমিটি তৈরি হতে সেই আন্দোলনে দাঁড়ি পড়েছিল। আন্দোলনকারীদের কেউ প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের পদত্যাগ দাবি করেনি। কিন্তু দিল্লির বুকে সেই আন্দোলন কোথাও যেন মনমোহন সরকারের প্রতি জনতার আস্থা নড়িয়ে দিয়েছিল। তাতে অনুঘটকের কাজ করেছিল ঠিক এক বছর আগে অণ্ণা হজারের নেতৃত্বে দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলন। ক্ষোভ জমেই ছিল। লোকসভা নির্বাচনের দু’বছর আগে তা প্রকাশ্যে আসে।
২০২৬-এর বিধানসভা নির্বাচনের দু’বছর আগে এখন পশ্চিমবঙ্গেও ঠিক একই ভাবে মহিলাদের নিরাপত্তা, সম্মানের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়েছে। রাজ্যেও কিছু দিন আগেই নিয়োগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলন হয়েছে। যদিও তা নিয়ে নাগরিক আন্দোলন হয়নি। কিন্তু ক্ষোভ যে জমে ছিল, তা স্পষ্ট। তৃণমূল সরকার ১৩ বছর ক্ষমতায় রয়েছে। কালের নিয়মেই মানুষের মনে ক্ষোভ জমে। সেই সব এখন এক সঙ্গে বেরিয়ে এসেছে। বিরোধীদের সামনে এ এক দুর্লভ রাজনৈতিক সুযোগ।
তৃণমূল নেতৃত্ব এখনও আশা করছেন, এই নাগরিক আন্দোলন ক্রমশ মিইয়ে যাবে। এখন তৃণমূলের ভোটার, বিজেপির ভোটার, সিপিএমের ভোটার ভেদাভেদ ভুলে সবাই এক সঙ্গে পথে নেমেছেন ঠিকই, কিন্তু ভোট এলে তাঁরা আবার নিজের মতো ভোট দেবেন। যেমনটা হয়েছিল দিল্লির সীমানায় তিন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলনের ক্ষেত্রে। এক বছর ধরে পঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশের কৃষকরা দিল্লির সীমানায় বসেছিলেন। উত্তরপ্রদেশের ভোটের আগে চাপের মুখে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কৃষি আইন প্রত্যাহার করেছিলেন। তাতে আন্দোলন থেমেছিল। আন্দোলনের কোনও প্রভাবও উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা ভোটে দেখা যায়নি। তখন আবার কৃষকরা নিজেদের মতো জাতপাত বা স্থানীয় অঙ্ক কষে ভোট দিয়েছিলেন। তা ছাড়া কৃষক আন্দোলন মূলত গ্রাম থেকে তৈরি হয়েছিল। তা শহরের আন্দোলন হয়ে ওঠেনি।
আর জি কর-কাণ্ডের নাগরিক আন্দোলনে তৃণমূল শীর্ষনেতৃত্ব একই রকম গ্রাম-শহর বিভাজনের ছবি দেখছে। কামদুনি, সন্দেশখালিতে নারী নির্যাতনের ঘটনায় শহরের মানুষ সেই ভাবে আন্দোলনে নামেননি। আবার আর জি কর-কাণ্ড নিয়ে শহুরে এলাকায় যতখানি প্রতিবাদ হচ্ছে, গ্রামে ততখানি হচ্ছে না বলে তৃণমূল নেতৃত্বের মত। শহরাঞ্চলের মানুষ যে তৃণমূলের প্রতি বিমুখ হয়ে পড়ছেন, তা লোকসভা ভোটে টের পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু গ্রামের ভোট অক্ষুণ্ণ। সর্বোপরি সংখ্যালঘু ভোটে আর জি কর-কাণ্ড ভাঙন ধরাবে না বলেই তৃণমূল নেতৃত্বের অনুমান। সেই হিসাব কষে তৃণমূল নেতৃত্ব আশা করছে, আসন্ন আধ ডজন বিধানসভা উপনির্বাচনে তৃণমূলই ভাল ফল করবে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিন্তার কারণ একাধিক। প্রথমত, তৃণমূলের এত দিন বড় শক্তি ছিল মহিলা ভোটব্যাঙ্ক। এখন তাঁরাই প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছেন। দ্বিতীয়ত, গরু, কয়লা পাচার, সরকারি নিয়োগে দুর্নীতি নিয়ে তাঁর দলের একাধিক নেতা, মন্ত্রী জেলে গিয়েছেন। তাঁর প্রশাসনে স্বচ্ছতা নিয়ে বড়সড় প্রশ্ন রয়েছে। তিনি সে ক্ষেত্রে নিজের ঘনিষ্ঠ নেতা-মন্ত্রীদের বিশেষ আড়াল করেননি। নিজের গায়ে কাদা টেনে আনার ভুল করেননি। কিন্তু আর জি কর-কাণ্ডে কাকে ও কেন আড়াল করার চেষ্টা হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তৃতীয়ত, ‘সাম্প্রদায়িক’ বিজেপিকে ঠেকাতে পশ্চিমবঙ্গে একমাত্র তিনিই ভরসা— এই মন্ত্রে মমতা এত দিন শিক্ষিত, ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালির ভোট কুড়িয়েছেন। এই শিক্ষিত, ধর্মনিরপেক্ষ সমাজের প্রতিনিধিরাই কিন্তু এখন প্রতিবাদের প্রথম সারিতে। তৃণমূলনেত্রীর সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা হল, দলের মধ্যে থেকেই তাঁর পদক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। খোদ তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ই ঘনিষ্ঠ বৃত্তে জানিয়েছেন, আর জি কর-কাণ্ডে উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দিতে রাজ্য সরকার ব্যর্থ। রাজ্য প্রশাসনের ভুল পদক্ষেপই পরিস্থিতি আরও ঘোরালো করে তুলেছে। যার অর্থ, চাপ শুধু বাইরে নয়, ঘরেও।
এই মুহূর্তে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো পোড়খাওয়া রাজনীতিক গোটা দেশেই হাতেগোনা। তিনি কী কৌশলে এই কোণঠাসা পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার রাস্তা খোঁজেন, গোটা দেশের রাজনৈতিক শিবিরই তা দেখতে চায়।