কাশ্মীরে নির্বাচন দেখতে দেখতে দু’জনের কথা মনে পড়ল। স্থান-কাল-পরিপ্রেক্ষিত, কোনও দিক থেকেই তাঁদের মধ্যে কোনও সাযুজ্য নেই। এক জনের নাম ফারুক আহমেদ দার। আর এক জন জেরেমি বেনথাম।
ফারুক আহমেদের কথা খুব সংক্ষেপে সারা যাক। ২০১৭-র ৯ এপ্রিল, শ্রীনগর লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনের দিন এই ফারুককে সামরিক জিপের বনেটের সামনে বাঁধা টায়ারের উপর বসিয়ে মানব-ঢাল হিসাবে ঘুরিয়েছিল রাষ্ট্রীয় রাইফেলস। যুবকটির শরীরের ঊর্ধ্বাংশ দড়ি দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা ছিল জিপের সঙ্গে। কেন এই শাস্তি? ফারুকের বুকে পিন আঁটা সাদা কাগজে উত্তরটাও লেখা ছিল: ‘পাত্থরবাজকো য়হী হাল হোগা’। যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া মজবুত করার জন্য এত ঢক্কানিনাদ, সেই প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের দিনেই এ-হেন অগণতান্ত্রিক পথ নেওয়ার প্রয়োজন পড়েছিল কেন রাষ্ট্রশক্তির? বেয়াড়া কাশ্মীরিদের ‘সবক’ শেখানোর জন্য? অথচ, বদগাম জেলার চিল গ্রামের বাসিন্দা ফারুক দারের প্রতিবেশীরাও জানিয়েছিলেন, ফারুকদের পেট চলে শাল তৈরি করে। অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের শান্ত এই যুবক জীবনে কখনও সেনাবাহিনীকে লক্ষ্য করে পাথর ছোড়েননি। মজার কথা, তিনি ওই উপনির্বাচনের দিন সকালে ভোটও দিয়েছিলেন!
পাঁচ বছর আগে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা হারিয়ে, সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপের পরে, মাসের পর মাস কার্যত অবরুদ্ধ অবস্থায় থেকেছে যে জম্মু-কাশ্মীর, সেখানে ফের নির্বাচন হচ্ছে। অন্তত বিধানসভায় নিজেদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে তাঁদের সুখ-দুঃখের কথা জানাতে পারবেন উপত্যকার মানুষ। কিন্তু ভূখণ্ডের নামটা যে কাশ্মীর! বিভিন্ন সময়ে কাশ্মীর এই প্রতারণা বা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের শিকার হয়েছে। ২০১৯ সালে জম্মু-কাশ্মীর এবং লাদাখকে দু’টি পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করার পর থেকে সেখানে কার্যত সামরিক শাসন চলছে। অসংখ্য সাধারণ মানুষকে জম্মু-কাশ্মীর জনসুরক্ষা আইনে (পিএসএ), অনেককে বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইনে (ইউএপিএ) কয়েদ করে নিজেদের রাজ্য ছাড়াও ভিন রাজ্যের জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করে, নানা অছিলায় সাংবাদিকদের ভয় দেখিয়ে, বহু সাংবাদিককে জেলে পুরে গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান স্তম্ভটিকে একেবারে ভঙ্গুর করে দেওয়া হয়েছে।
শুধু কি তা-ই? আদালত ছাড়াও যে যে জায়গায় সুবিচারের আশায় যাওয়া যেত, সেই সব জায়গাতেও তালা পড়ে গেছে। রাজ্য মানবাধিকার কমিশন ছাড়া জম্মু-কাশ্মীর পুনর্গঠন আইন ২০১৯-এর বলে বন্ধ হয়ে যায় আরও ছ’টি কমিশন— নারী ও শিশু-সুরক্ষা, প্রতিবন্ধী, দায়বদ্ধতা, তথ্য, ক্রেতা-সুরক্ষা এবং বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রক কমিশন।
জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভায় এখন জম্মুতেই ছ’টি এবং কাশ্মীরে একটি কেন্দ্র বেড়েছে। এই ৭ কেন্দ্রেই সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা। ৯০ আসনবিশিষ্ট বিধানসভায় ৪৬টি আসন পেলেই কোনও দল সরকার গঠনের দাবি জানাতে পারবে। ২০১৪-র বিধানসভা ভোটে বিজেপি জয়ী হয় ২৫টি আসনে। তখন জম্মু-কাশ্মীর পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা পেত। সীমানা পুনর্বিন্যাস এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু অঞ্চলে আসন বাড়ার ফলে নতুন কেন্দ্রগুলির ভোটের বেশিটাই বিজেপির দিকে যেতে পারে। এ ছাড়া, পরিবর্তিত আইনে বিধানসভায় পাঁচ জন মনোনীত সদস্যের ভোটাধিকার থাকবে। অর্থাৎ বিজেপি শিবির প্রয়োজনীয় আসনসংখ্যা না পেলে মনোনীত সদস্যেরা কোন দিকে ভোট দেবেন, তা বোঝা সহজ।
এ সব ছাড়াও, জম্মু-কাশ্মীরের নির্বাচনী ময়দানে নানা সমীকরণ এই মুহূর্তে কাজ করছে। কয়েকটি চরিত্র ময়দানে নামার পরে নানা জল্পনারও সৃষ্টি হয়েছে। যেমন, শেখ আবদুল রশিদ, ইঞ্জিনিয়ার রশিদ নামেই তিনি বেশি পরিচিত। প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর জেলে কাটানোর পর তিনি কয়েক দিনের জন্য জামিনে মুক্ত হয়েছেন। গত লোকসভা নির্বাচনে তিনিই কারাবন্দি অবস্থায় বারামুল্লা কেন্দ্রে ন্যাশনাল কনফারেন্সের উজ্জ্বল মুখ ওমর আবদুল্লাকে বড়সড় ব্যবধানে পরাস্ত করেছেন। তাঁর দল আওয়ামি ইত্তেহাদ পার্টি এ বার পুরোদস্তুর নির্বাচনী লড়াইয়ে আছে, তবে ভিন্ন কৌশল নিয়ে। ইঞ্জিনিয়ার রশিদ এ বার ৩৪টি আসনে প্রার্থী দিয়েছেন বটে, তবে নির্দল হিসাবে। নানা জনসভায় বিজেপিকে তুলকালাম আক্রমণ শাণালেও এই ‘নির্দল’ প্রার্থীরা আদপে কাদের ভোট কাটতে চলেছেন?
শুধু এঁরাই নন, উপত্যকার ভোটে এ বার যে ১৭৯ জন নির্দল প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, তাঁদের মধ্যে জামাত-এ-ইসলামি সমর্থিতরাও রয়েছেন। দীর্ঘ চার দশকের ভোট বয়কটের ডাক দেওয়ার পথ ছেড়ে তাঁরা এ বার নির্বাচনী রণাঙ্গনে। রয়েছেন কাশ্মীরি পণ্ডিত সম্প্রদায়ের ১২ জন প্রার্থীও। এই ভোট কাটাকাটিতে হয়তো সবচেয়ে লাভবান হবে বিজেপি। কিন্তু ভোট ঘিরে যে উৎসাহ দেখাচ্ছেন কাশ্মীরের মানুষ, যে ভাবে বুথের দিকে পা বাড়াতে দেখা যাচ্ছে তাঁদের, তাতে বিজেপির উল্লসিত হওয়ার কারণ আছে কি? প্রধানমন্ত্রী মোদীর ভাষায়, কাশ্মীরি যুবকেরা পাথর ছেড়ে হাতে কলম তুলে নিয়েছেন। কিন্তু ভোটদানের এই হার বৃদ্ধি পাল্টা ‘সবক’ শেখানোর পরিচায়ক নয় তো?
কাশ্মীরিরা কিন্তু উন্নয়ন বলতে স্রেফ রাস্তঘাট বা পরিকাঠামোর উন্নয়ন বোঝেন না। তাঁরা হারানো সম্মান ফিরে পাওয়াটাকে প্রকৃত স্বাধীনতা বলে জানেন। কাশ্মীরিয়তকে অটুট রাখাটা তাঁদের কাছে অগ্রাধিকার পায়। অথচ দিল্লি একটা ভিন্ন ন্যারেটিভ সুকৌশলে তৈরি করেছে। কাশ্মীরে পর্যটকের ঢল নেমেছে মানেই কাশ্মীর হাসছে! এ দিকে বেকারত্বের কথা বলা হয় না। বলা হয় না শিল্পের অভাবের কথা। বলা হয় না গণপরিবহণের চূড়ান্ত বেহাল দশার কথা। লুকিয়ে রাখা হয় জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম রসদ জোগাড়ে কালঘাম ছুটে যাওয়ার কথা।
আর আছে ভয়। কেউ বুঝি আড়াল থেকে নজর রাখছে সর্বদা। মানুষ নির্ভয়ে কথা বলতেও পারেন না। তাই মনে পড়ে ব্রিটিশ দার্শনিক জেরেমি বেনথামকে, তাঁর ‘প্যান-অপটিকন’ তত্ত্বকে। সেই সর্বগ্রাসী সর্বদর্শনের উপত্যকায় আজ গণতন্ত্রের এই কুচকাওয়াজ কি কাশ্মীরের মানবজমিন থেকে আতঙ্কের শিকড় উপড়ে ফেলতে পারবে?