২০১৬ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সোল-এ এক মহিলা খুন হন। কারণ অপরাধী মনে করত, সে মহিলাদের দ্বারা অবহেলিত হচ্ছে। দীর্ঘ দিন ধরে মহিলাদের মধ্যে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছিলই। এই ঘটনায় জ্বলে ওঠে স্ফুলিঙ্গ, তৈরি হয় নারীবাদী ‘ফোর-বি’ আন্দোলন— বিপুল সংখ্যক কোরীয় মহিলা পুরুষদের সঙ্গে সম্পর্কে না জড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। কোরীয় শব্দ ‘বি’-র অর্থ ‘না’। আন্দোলন বলে, বিয়ন (পুরুষদের সঙ্গে ডেটিং নয়), বিহন (বিয়ে নয়), বিসেকসু (যৌন সম্পর্ক নয়), বিচুলসান (সন্তান উৎপাদন নয়)। প্রায় এক দশক এবং মহাদেশের দূরত্ব পেরিয়ে এখন আমেরিকায় সেই আন্দোলন দানা বাঁধছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তনে আমেরিকার বহু মহিলা নিরাশ। এক ঘোষিত নারীবিদ্বেষীকে সংখ্যাগরিষ্ঠ পুরুষদের সমর্থনেও ক্ষোভ জমেছে। আমেরিকান মহিলাদেরও মত, যিনি প্রকাশ্যেই নারী-শরীরের উপর নিয়ন্ত্রণের কথা বলেন, তাঁর অনুগামী, ভোটদাতা পুরুষদের সঙ্গে সম্পর্কের দায় তাঁদের নেই।
এই আন্দোলনে মনে পড়ে নারীবাদী আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ের দাবিগুলি। এই পর্বেরই স্লোগান ‘পার্সোনাল ইজ় পলিটিক্যাল’— অর্থাৎ, যৌন হেনস্থা থেকে সম্পর্কের কাঠামোতে ঊর্ধ্বতন-অধস্তন ধারণা, বৈধ গর্ভপাতের অধিকার থেকে পারিবারিক শ্রমের মতো বিষয়গুলিকে ব্যক্তিগত সমস্যা বলে চালানোর চেষ্টা হলেও তার মূল নিহিত সামাজিক কাঠামোর পদ্ধতিগত রাজনৈতিক প্রকৌশলেই। কেট মিলেট সেক্সুয়াল পলিটিক্স (১৯৭০) গ্রন্থে যৌনতার রাজনীতি প্রসঙ্গে বলেছিলেন, যৌনতার মাধ্যমে নারীর শরীর ও ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ করেই পুরুষতন্ত্র ক্ষমতা বজায় রাখে। যৌন-রাজনীতির পদ্ধতিটিতে যৌনতা কেবল শারীরিক অভিজ্ঞতা নয় বরং সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর অংশ যেখানে লিঙ্গভূমিকা পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। প্রজনন ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম হাতিয়ার; যৌন সম্পর্ক এবং লিঙ্গ ভূমিকা ক্ষমতার সমীকরণেরই অংশ; পিতৃতন্ত্র আধিপত্য বজায় রাখতে যৌনতা ও লিঙ্গভিত্তিক সম্পর্ককে ব্যবহার করে। সাহায্য করে পরিবার, ধর্ম, সমাজ, সরকার।
এ বারের নির্বাচনের মতো আড়াআড়ি ভাবে বিভক্ত ‘লিঙ্গ রাজনীতি’ আমেরিকায় আগে পরিলক্ষিত হয়নি। রিপাবলিকানরা প্রকাশ্যেই পুরুষ আত্মপরিচয়, পুরুষ কর্তৃত্ব, পুরুষ বন্ধুত্বের উপর প্রচার চালিয়েছে। ২০২২-এ আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট বৈধ গর্ভপাতের অধিকারকে যুক্তরাষ্ট্রীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাজ্যগুলির আওতায় আনলে তা নারীদের মৌলিক অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ বলে বিবেচিত হয়েছিল। এই বিষয়ে ট্রাম্প ও তাঁর সহযোগীদের ভূমিকা অত্যন্ত নেতিবাচক ছিল। ফলে নির্বাচনে গর্ভপাতের অধিকারের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাই পুরুষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের ট্রাম্পকে সমর্থন নারীরা পুরুষদের আধিপত্যকামী মানসিকতারই পরোক্ষ প্রকাশ মনে করেছেন। এরই প্রতিবাদ আন্দোলনে।
আমেরিকান নারীরা বিবাহিতা, সন্তান-জননীদেরও আন্দোলনে শামিল হতে বলছেন। তাঁরা অন্য পথে এই আন্দোলনে যোগদানও করছেন। যেমন, পুরুষ-পরিচালিত কোনও কিছু থেকে কিছু না কেনা, পুরুষ সহকর্মীদের সঙ্গে কাজ ছাড়া শুধুই সামাজিকতাটুকু রক্ষা করা। সমাজমাধ্যমে ছোট দল বানিয়ে মতবিনিময় করছেন, আন্দোলনকে সমাজমাধ্যমের বাইরেও ছড়াতে চলছে আলোচনা। তাঁরা বলছেন, ‘ব্যক্তি’ পুরুষকে ঘৃণা বা প্রতিশোধমূলক আকাঙ্ক্ষা নয়। এই আন্দোলন নিজের সত্তাকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া, নিজের ভাল থাকার সঙ্গে সম্পর্কিত। পরিবর্তিত আর্থিক, সামাজিক পরিস্থিতিতে নারী-হিংসা, লিঙ্গবৈষম্য হয়েই চলেছে। সেখানে বিয়ে, সন্তান জন্ম এবং প্রতিপালন তাঁদের কাছে ভয়ের, আশঙ্কার কারণ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তো সম্পর্কের ক্ষমতার ভারসাম্য পুরুষদের দিকেই ঝুঁকে আছে। এঁদের অনেকের ‘সিঙ্গল মাদার’ হওয়ার ইচ্ছা, তাই আর্থিক স্বাবলন্বনের পক্ষপাতী। লাপাতা লেডিজ়-এ মঞ্জু মাই যেমন বলেন যে, পুরুষদের প্রয়োজন নেই মহিলারা নিজেই পারবে সব— এই আন্দোলন হয়তো তারই প্রতিচ্ছবি। কোথাও গিয়ে নারীদের জন্য ভারত, কোরিয়া, আমেরিকা, ইরান সব এক হয়ে যায়। কোথাও নিয়মের বেড়া প্রত্যক্ষ, কোথাও সেটা অলিখিত।
আমেরিকাতে নবীন প্রজন্মের পুরুষদের অনেকের বিশ্বাস, বর্তমানে ‘নারীবাদ’ লিঙ্গসাম্য নয়, পুরুষবিরোধী বা পুরুষদের শাস্তির কথা বলে। সমীক্ষা জানিয়েছে, আমেরিকার ৪৫% নবীন প্রজন্মের পুরুষের ধারণা তাঁরা সমাজে পুরুষ পরিচয়ের জন্য বৈষম্যের শিকার, তাঁদের সমস্যা উপেক্ষিত। তাঁদের মধ্যে সামাজিক বিচ্ছিন্নতার প্রবণতা, সব কিছুর জন্য তাঁরা মহিলাদের দায়ী করছেন। মহিলাদের উদারপন্থী হওয়ার ঝোঁকের পাশাপাশি পুরুষরা আরও রক্ষণশীল হয়ে পড়ছেন। ২০২২-এর সমীক্ষায় পুরুষদের মাত্র ৩২% মনে করেছিলেন যে, গর্ভপাতের অধিকার না-থাকা নারীর ‘অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ’। এই পরিস্থিতিরই পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছেন ট্রাম্প ও দলবল, প্রচারে নারীদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসাবে দেখা হয়েছে, পুরুষত্বের অহংবোধ প্রকাশ পেয়েছে। ট্রাম্পের প্রকট মহিলাবিদ্বেষকে এই বৃহত্তর লিঙ্গ রাজনীতির প্রেক্ষাপটেই দেখতে হবে।
আমেরিকায় প্রচুর মহিলাও ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন। কারণ পিতৃতন্ত্রকে প্রশ্রয়ের ও নারীবিদ্বেষের মূল নিহিত থাকে সমাজেরই অভ্যন্তরে। তারই প্রকাশ পুরুষদের বড় করে তোলার প্রক্রিয়ায়, যাতে মহিলাদেরও ভূমিকা থাকে। যুবকদের বড় অংশ যে বিচ্ছিন্নতা, একাকিত্ব, দুশ্চিন্তা, আশঙ্কায় ভুগছে তার বড় কারণ তারা আবেগ প্রকাশ করতে শেখেনি। বরাবর নিজেদের উচ্চতর ভেবেছে, কিন্তু বাস্তবে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে তাদের এই ধারণা ক্রমশ ভেঙে গিয়েছে। তারা বিভ্রান্ত। রাজনীতিবিদরা এই বিভাজনেই ইন্ধন জুগিয়েছেন। তাই পুরুষদের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগের সরলীকরণে সমস্যার সমাধান নেই। বরং সাম্য, সমানাধিকার, স্বাধীনতার অর্থ বলতে নারীবাদীরা কী বোঝান, সামাজিক অর্থনৈতিক কাঠামো কী ভাবে লিঙ্গ নির্বিশেষে প্রভাব ফেলে— সেগুলো তাঁদের কাছে তুলে ধরলে হয়তো তা সম্পর্কের সমীকরণে ফলপ্রসূ হবে। নয়তো আন্দোলনের বৈপ্লবিক চরিত্র ‘নারীবাদী মাত্রেই পুরুষ বিদ্বেষী’ প্রমাণ করতে দক্ষিণপন্থীদের আরও সুযোগ দেবে।
নারীদের অধিকার ও ক্ষমতার প্রশ্নটিকে বৃহত্তর মানবাধিকারের পরিপ্রেক্ষিতে না দেখা পর্যন্ত ক্ষমতার এই কেন্দ্রীকরণ পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোতেই হতে থাকবে। পুরুষকে কখনওই শুধুমাত্র পুরুষ বলে অধিকার অর্জনের জন্য লড়তে হয়নি। ব্যক্তির দিক থেকে যা অধিকার, সমাজের দৃষ্টিকোণ থেকে তাই কর্তব্য। অর্থাৎ প্রয়োজনে বেশি রাতে বাড়ি ফিরতে হলে, বাকিদের কর্তব্য তাকে অন্যায় ভাবে আক্রমণ না করা। প্রত্যেকের অধিকারের পরিধি যে লিঙ্গনির্বিশেষে অন্যান্য সকলের প্রতি কর্তব্যবোধের দ্বারা সীমিত ও গণ্ডিবদ্ধ, সেটা পিতৃতন্ত্র বুঝলে আন্দোলনের দরকারই পড়ত না।