মনে পড়ে, কর্মসূত্রে নদিয়ায় যাচ্ছিলাম, যাত্রাপথে দু’দিকে ধানখেত বর্ষায় সজল। আলগা ভাবেই বিষাদবৃক্ষ বইটি পড়ছিলাম প্রথমে। হঠাৎ বিস্ময়কর তীব্রতায় বইটি আমাকে সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন করে ফেলল। কান্নার কুয়াশা ছিপছিপে বইটি থেকে উৎসারিত হয়ে মাঠ, খেত, নদী, গাছপালাকে ছেয়ে দিল। “কিন্তু সবাই বলল সেদিন, হা কাপুরুষ হদ্দ কাঙাল/ চোরের মতো ছাড়লি নিজের জন্মভূমি।/ জন্মভূমি? কোথায় আমার জন্মভূমি খুঁজতে খুঁজতে জীবন গেল”: শঙ্খ ঘোষের বেদনার্ত পঙ্ক্তিগুলি মনে পড়ছিল। দেশভাগ ও সংখ্যালঘুর বিপন্নতার মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে বিষাদবৃক্ষ-র মতো বই আগে পড়িনি। ১৭ জানুয়ারি মিহির সেনগুপ্তের (ছবি) প্রয়াণ আবার সেই পাঠ-অভিজ্ঞতায় ফিরিয়ে নিয়ে গেল আমায়। আসলে, দেশভাগ নিয়ে গল্প উপন্যাস স্মৃতিকথা দুই বাংলায় আমরা কম না পেলেও তা যেন কখনওই যথেষ্ট মনে হয়নি। এ যেন এমন এক ক্ষতচিহ্ন যে আত্মগর্বী বাঙালি তা ঢেকে রাখতে চায়।
প্রথম জীবন পূর্ব পাকিস্তানে কাটিয়ে ১৯৬৩ সালে মিহির কলকাতায় আসেন। বিপর্যস্ত সামাজিক রাষ্ট্রিক পটে এক কিশোরের বড় হয়ে ওঠার আখ্যানে সবচেয়ে বড় পরীক্ষা ছিল সাম্প্রদায়িক সঙ্কীর্ণতামুক্ত নিরপেক্ষ অবস্থানে দাঁড়ানো। মিহির সেই সঙ্কট পার হতে পেরেছেন। আসলে, জমিদার পরিবারের সন্তান মিহির ও তাঁর ভাইবোনদের কঠোর জীবনসংগ্রামের মধ্যে পড়তে হয়। তখন থেকেই গ্রামের নিম্নবর্গের গরিব মানুষ, তাঁর ভাষায় ‘অপবর্গী’দের সঙ্গে তাঁর আন্তরিক যোগাযোগ। বর্ণাভিমান, আভিজাত্যের দর্প, সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি তাঁর মন থেকে সরে যায়। তাঁদের বনেদি বাড়ির পিছন দিকে বয়ে যেত ‘পিছারার খাল’— এই জলস্রোত আর এক জোড়া রেনট্রি ধুয়োর মতো বার বার বইটিতে এসেছে। এরা যেন জনপদের অধিদেবতা, নীরব দর্শক, যাদের অবজ্ঞা করে দুই সম্প্রদায় পরস্পরকে আঘাত করে শাপগ্রস্ত। বরিশালের প্রত্যন্ত গ্রামের বিন্দুতে পূর্ব পাকিস্তানের সিন্ধুদর্শন ঘটে পাঠকের। হিন্দু-মুসলমান উভয়েই সেই ধ্বংসের সমান অংশীদার। “এক ভস্ম আর ছার। দোষগুণ কব কার?” অথচ, বাংলার নিম্নবর্গে হিন্দু-মুসলমানের যে অসামান্য সহাবস্থান-সংস্কৃতি রচিত হয়ে উঠেছিল, মিহির জানান, “ভারতের আর কোথাও বোধহয় তেমনটি হয়নি।” দেশভাগের ফলে সেই সংস্কৃতি ছিঁড়ে ফেলে ভয় আর ঘৃণা সঞ্চারের চেষ্টা হয়েছিল। “লোচ্চা, লম্পট, লুম্পেনদের সে সময় রাষ্ট্রই ছেড়ে দিয়েছিল সংখ্যালঘুদের অবশিষ্টতম মানুষের উচ্ছেদকল্পে।”
রাষ্ট্রিক পরিস্থিতির এই অমানবিক আবহে একটি বালকের আত্মনির্মাণে আলো জুগিয়েছিলেন কীর্তিপাশা স্কুলের রেক্টরস্যর অশ্বিনীবাবু, তারুলি স্কুলের হাতেম মাঝি স্যর, দাদি আম্মা, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, অধ্যক্ষ মেজবাহারুল বারচৌধুরী। মিহির লক্ষ করতে ভোলেননি, নদীমাতৃক একটি সুফলা দেশে দেশভাগের ফলে যে সামগ্রিক শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল, তার চাপ কী ভাবে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের উপরেও পড়েছিল।
বিষাদবৃক্ষ-এর ব্লার্বে বলা হয়েছিল, এটি ‘একখানি শক্তিশালী এবং বিষাদময় আত্মস্মৃতি’। কিন্তু, রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্তের অভিমতই যথার্থ ঠেকে, ‘ইহাকে একখানি উপন্যাস বলিয়াই মনে করি।’ বিপন্ন দেশকালের পটে বিচিত্র ঘটনাকে মূল ভাবনার সুতোয় গেঁথে একটি ঐক্যময় মহৎ আখ্যানের দিকে যাত্রার যে শৈলী এতে আছে, তা ধ্রুপদী উপন্যাসেই থাকে। আবার সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম, ধানসিদ্ধির পরণকথা, জালালি— এই গ্রন্থগুলিতে স্মৃতিসূত্রে কাহনটি প্রবাহিত করে কথাসাহিত্যের এক নতুন ধরনের বুনট তৈরি হয়। ‘পরণকথা’ শব্দটি বরিশালের আর এক সন্তান জীবনানন্দের কবিতায় পাঠক পেয়েছেন। মিহির দেখিয়েছেন, কী ভাবে রূঢ় বাস্তবের মাটি থেকে পরণকথা জন্ম নেয়। স্থানীয় ঘটনা লোকগায়ক ও কথকদের বয়ানে ডালপালা মেলে। কখনও তা বিধুর ব্যর্থ প্রেমের গল্পে মৈমনসিংহ গীতিকার আভাস আনে, কখনও তা গ্রাম পত্তনের ইতিহাস, কখনও ক্ষমতাবানের অন্যায়ের প্রতি বিদ্রুপে বক্র।
তাঁর আখ্যান যেন গ্রামীণ ইতিহাসের দলিল। বলেশ্বরের তীরের একটি গ্রামের প্রজারা তালুকদার অক্ষয় রায়ের অত্যাচারে উত্ত্যক্ত হয়ে তাঁর সম্পর্কে দেশজ কুকথা প্রয়োগের দুঃসাহস দেখায়। ফলে সৈয়দ আলির নেতৃত্বে পাঁচশো নগদি গ্রামটিকে সহবত শিক্ষা দেয়। এক রাতের মধ্যে গ্রাম জনশূন্য হয়ে যায়, মৃতদেহগুলির গতি হয় নদীতে। থানা-পুলিশ করার জন্য গ্রামের কোনও মানুষ আর জীবিত ছিল না। আবার অন্য এক ঘটনায়, জমিদার রায়কর্তারা রাতারাতি একটি গ্রামের হিন্দু প্রজাদের খেদিয়ে এনে নতুন গ্রাম পত্তন করেন, হিন্দু ও মুসলমানের আলাদা গ্রাম। কিন্তু সাত পুরুষের ভিটে কেউ সহজে ছাড়ে? অগত্যা সৈয়দ আলির নেতৃত্বে পাঁচশো লেঠেলের নিয়োগ। গ্রামীণ গায়ক ছোমেদ বয়াতির পরণকথায় আছে, কী ভাবে রাতারাতি প্রাণভয়ে ত্রস্ত নরনারী চলে আসে নতুন গ্রামে। সামন্ততন্ত্রের সেই সিংহবিক্রম সৌভাগ্যক্রমে অতিক্রান্ত। সেই রায়কর্তাদের বাড়িতেই আবার দুর্গাপুজোয় উভয় সম্প্রদায়ের সম্মিলিত উৎসব আশার আলো দেখায়। “...আজও এই আসরে দেখছি সেই নিম্ন বর্ণের শিল্পী এবং গ্রাহকেরাই ভিড় করে আছে। সুধীর নমশূদ্র, কার্তিক কৈবর্ত, ছোমেদ মুসলমান। গোল বাধায় ধর্মব্যবসায়ীর দল।”
মহাভারতের চরিত্রগুলিকে কেন্দ্রে রেখে আধুনিক ভাষ্য রচনা করেছেন তিনি। আলাদা ধরনের বই আবার টাঁড় পাহাড়ের পদাবলি। কর্মসূত্রে গিয়েছিলেন রুখাসুখা টাঁড় পাহাড়ের দেশে। পুব বাংলার আখ্যানে যেমন চান্দ্রদ্বীপী (বরিশালি) ভাষা, এই বইতে তেমনই বাংলার সঙ্গে দেহাতি হিন্দি ও সাঁওতালি ভাষা মিলেছে। মিহিরের এই সাহসী শৈলীতে সৈয়দ মুজতবা আলীর জোরালো উত্তরাধিকার। অঞ্চলের ‘রইস’ ও ‘গরিব কেলেকুষ্টি ডিংলাপারা মানুষজন’-এর সঙ্গে লেখকের হার্দ্য সম্পর্ক গড়ে ওঠে। জনজাতির মানুষের দুর্মর জীবনীশক্তি, প্রতিকূল পরিবেশে বিরল উপকরণে আনন্দ খুঁজে নেওয়ার ক্ষমতা তাঁকে মুগ্ধ করে। তাঁর লেখা মনে পড়ায় কালো আমেরিকান সাহিত্যিক মায়া অ্যাঞ্জেলুর লেখা কাহিনি— টেরিসা পিসি কাজ করতেন ধনীর প্রাসাদে। প্রতি শনিবার পিসির ঘরে বাড়ির ও পাড়ার দারোয়ান, মালি, চাকর দাসী, ড্রাইভাররা সামান্য খাদ্যপানীয় সহযোগে নাচে-গানে মেতে উঠত। দূর থেকে তৃষ্ণার্ত দৃষ্টিতে সেই দৃশ্য দেখতেন অগাধ সম্পত্তিশালী মনিবদম্পতি।
মিহির সেনগুপ্ত অপরিচয়ের কুহেলি সরিয়ে মানবিক পরিচয়কে অবারিত করতে চেয়েছেন। আকস্মিক মৃত্যু ছেদ টেনে দিল। মনে পড়ে গেল, মানবজনম যে অন্ধকার মৃত্যুছায়াতলে এক ক্ষীণায়ু অপূর্ব ঝলক— তা নিয়ে গান গেয়েছিল মিহিরের বন্ধু শত্রুঘন সোরেন। “মানুষজনম আহা ঝিঙাফুলের কলি/ সাঁঝে ফুট্যে সকালে মলিন।/ সবঅ পরব ঘুরি আওবে হে বাবু হো/ নাহি আওবে মরণমানুখ।”