কথাটা নজরুল ইসলামের। ধর্মের কল যেমন চিরকালীন সত্য, তেমন সেই কল যে বাতাসেও নড়ে, এটা মিথ্যা নয়। ধর্মব্যবসায়ীরা ধর্মকলের ফাঁদে মানুষ ধরে মুনাফা কামিয়ে এসেছেন। দেশভাগের মূল্যে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। বুঝতে পারি ‘ধর্ম’ একটা আরোপিত আইডিয়া। এখন আবারও ভোট-রাজনীতিতে ‘ধর্ম’কে দাপাতে দেখে আমরা ভীত হয়ে পড়ি। রাজনৈতিক ভাষ্যের ধর্মীয় মেরুকরণের মধ্যে পড়ে সাধারণ মানুষ বিপন্ন। এই পরিস্থিতিতে যেন আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে যান ১২৫ বছর অতিক্রান্ত বাঙালি কবি, আমাদের নজরুল।
‘মন্দির মসজিদ’ নামে প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, ধর্ম-লড়াইয়ে রক্তাক্ত মানুষ কোনও দিন আশ্রয় পায়নি মন্দির মসজিদের দালানে। যন্ত্রণাকাতর মানুষকে রাস্তায় ফেলে কেটে পড়েছে ধর্মের পাহারাদারেরা। ধারালো ভাষায় ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’তে লিখেছেন রাজার পক্ষ যাঁরা নেন, ‘তাঁর লক্ষ্য স্বার্থ’, আর মানবতার পক্ষে যাঁরা থাকেন, তাঁদের ‘লক্ষ্য সত্য’।
নজরুলের ধর্মচেতনা বুঝতে ‘আমার ধর্ম’ প্রবন্ধের পাতা ওল্টাতে হয়। “কিসের ধর্ম? আমার বাঁচাই আমার ধর্ম। দু’বেলা দুটি খাবার জন্যই যার বাঁচা তার আবার ধর্ম কি!” এই সত্যকে জানলে, নিজের ধর্মকে চেনা যায় আর নিজের ধর্মকে চিনলে অপরের ধর্মপালনকে ঘৃণা করা যায় না। প্রতিরোধের এই ভাষ্য নির্মাণে তিনি অতুলনীয়। এলিটিস্ট বাঙালিদের অনেকেই বৈশাখে ‘রবি’র পাশে জ্যৈষ্ঠে নজরুলকে জুড়ে ‘রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যা’ পালনে মনোযোগী। সেখানে এই প্রতিরোধের কথা বেশি শোনা যায় না। অবশ্য সম্প্রতি ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানের সুর বিকৃতিতে গর্জে উঠতে দেখেছি বাঙালির নজরুল-আবেগ।
নজরুল মানবতাবাদী। বিদ্রোহীর ভাষ্যে। উপমহাদেশের রাজনৈতিক নেতারা সাম্প্রদায়িক সমস্যাকে গুরুত্ব দিলে ‘ডিভাইডিং রুল’ চাপানো যেত না। এটা তিনি বুঝেছিলেন। সেইমতো নিজের সত্তাকে লেখার ভাষায় নির্মিতি দিলেন “হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?/ কান্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা’র।”
মানবতাবাদ, সমন্বয়বাদ থেকে ‘বাদ’টা সরালে পড়ে থাকে মানুষ আর সমন্বয়। গান-কবিতা সর্বত্র এই দুই ভাবনাতেই জোর দিয়েছেন তিনি। বাংলা গজল, জাতীয়তাবাদী ‘কোরাস’, ইসলামি গান, নবির গান, ছাদ-পেটানো বা ঝুমুর গান সমন্বয়ের সফরকে পরিপূর্ণতা দেয়। গানের ফর্মে মিলে যায় উত্তর ভারতের রাগসঙ্গীত আর বাংলার লোকগান। নিজের ধর্মবিশ্বাসে লিখছেন ইসলামি গান (মোহাম্মদ নাম জপমালা)। হিন্দুধর্মের আধ্যাত্মিক প্রেরণায় লিখেছেন শ্যামা-সঙ্গীত (কালো মেয়ের পায়ের তলায়), বা কীর্তনের পদ (আমি কী সুখে লো গৃহে রব/ আমার শ্যাম যদি ওগো যোগী)। এই সহাবস্থান আমাদের সম্পদ। আমাদেরই।
দেশপ্রেমের আবেগে বাঙালি জাতিকে একটা পোক্ত চেহারা দিতে চেয়েছিলেন তিনি। বলতেন, কবিতার সঙ্গে ব্যক্তি নজরুল ইসলামকে জড়িয়ে দেখাটা ভুল। ধর্মের মাপকাঠিতে কবি আর তার কবিতাকে মাপতে গেলে হট্টগোল বাঁধে। ধর্মের কড়াকড়ির মধ্যে কবি-কবিতা কেউ বাঁচে না। তৎকালীন কিছু মানুষের চোখে নজরুল ‘কাফের’, কিছু মানুষের কাছে ‘সেকুলার’ জাতীয়তার কবি। সর্বজনীন জাতীয়তার যে চেতনাকে চারণকবির মতো নিম্নবর্গীয়ের মধ্যে, মাঠে-ঘাটে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। রুক্ষ, দরিদ্র, দলিত, অত্যাচারিত মানুষের কথা এসেছিল তাঁর কবিতায়। সংবাদপত্রে নতুন যুগ এনে দিয়েছিলেন। সাহসী নজরুল পর পর সম্পাদনা করে গেছেন নবযুগ, ধূমকেতু, লাঙল-এর মতো পত্রিকা। চল্লিশের দশকে সাম্প্রদায়িকতার দিনে জাতীয়তাবাদী মুসলিম পত্রিকা এবং নবযুগ-এর প্রধান সম্পাদক হওয়া মুখের কথা ছিল না।
‘নজরুল একটা জিয়ন্ত মানুষ’, গর্ব করে বলেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। ‘জ্যান্ত’ মানুষটাকে চেনা যায় তাঁর যাপন দিয়ে। কিছু স্মৃতিচারণের সূত্রে জানা যায়, এক দুঃস্থ হিন্দু মেয়ের বিয়েতে সাহায্য করতে চৌরঙ্গির ‘বেঙ্গল স্টোর্স’ থেকে বিয়ের তত্ত্বের বহু জিনিস কিনে পৌঁছে দিয়ে এসেছিলেন তার বাড়িতে। রাত্রি বারোটার সময় হ্যারিসন রোডের এক রিকশাওয়ালাকে বলেন, অনেককে রিকশায় টেনেছিস! এ বার তুই রিকশায় উঠে পড় আমি টেনে নিয়ে যাই! নিজে অভুক্ত থেকে অন্য অভুক্তকে খাইয়েছেন। নিজে অর্থ কষ্ট নিয়ে অন্যকে অর্থ সাহায্য করেছেন।
দেশ ভাগ হলেও নজরুলের মতো দিলদরিয়া-আপনভোলা মানুষেরা ভাগ হন না। যত দিন রাষ্ট্র-যুদ্ধ-রক্ত-ধ্বংস দারিদ্র-উৎপীড়িতের কান্না থাকবে তত দিন নজরুল থাকবেন। চাপিয়ে দেওয়া ‘ধর্ম’কে উড়িয়ে গ্রামের ভাঙা পাঁচিলে বসে যাত্রা শুনবেন। কিংবা, সুর করে পড়ে চলবেন রামায়ণ-মহাভারত।