আন্দোলন: আনিস খানের ‘অস্বাভাবিক মৃত্যু’র যথাযথ তদন্ত ও বিচারের দাবিতে ছাত্রছাত্রীরা। কলকাতা, ২২ ফেব্রুয়ারি। ছবি পিটিআই।
সম্প্রতি শিল্পোদ্যোগী ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে একটি বৈঠকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বেজায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ক্ষোভের কারণ আন্দোলন। আন্দোলনের বিষয় প্রধানত দু’টি: ডেউচা-পাঁচামি এবং আনিস খান। উভয় ক্ষেত্রেই আন্দোলনকারীদের সাবধান করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রথমত, বীরভূমের ডেউচা-পাঁচামিতে কয়লা খনি প্রকল্পের যে বিরোধিতা চলছে, ‘রাজ্যের উন্নয়নের স্বার্থেই’ তিনি তা বরদাস্ত করবেন না। দ্বিতীয়ত, ছাত্র-নেতা আনিস খানের ভয়াবহ মৃত্যুকে কেন্দ্র করে যে ভাবে লাগাতার প্রতিবাদ মিছিল বিক্ষোভ করা হচ্ছে, সেটা তিনি আর মেনে নেবেন না। তাঁর সাফ কথা: “অনেক হয়েছে। ৩০ বছর ধরে এ সব দেখেছি। আন্দোলন করে বড় হয়েছি। আমাকে কেউ যেন আন্দোলন না শেখায়।”
যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তাঁরা আন্দোলনের প্রতি অনুকূল মনোভাব পোষণ করবেন না, সেটা স্বাভাবিক। ছোটখাটো বিক্ষোভ-টিক্ষোভ হল, দু’চারটে মিছিল এ-পাশ ও-পাশ দিয়ে চলে গেল, রাজপথে কয়েক পশলা স্লোগান ঝরে পড়ল, এই অবধি ঠিক আছে; কিন্তু আন্দোলন দানা বাঁধলে, সেই আন্দোলন ক্ষমতার চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন তুললে, সরকারি সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের জন্য চাপ দিলে, আন্দোলনের চাপে রাষ্ট্রশক্তির অপব্যবহারের গূঢ় সংবাদ প্রকাশ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে ক্ষমতাবানদের অন্তরে ক্রোধ জাগ্রত হয়, মগজের ঈশান কোণে উদ্বেগ জমে। আর, কে না জানে, দুশ্চিন্তা ও ক্রোধ একে অপরকে ইন্ধন জোগায়। তখন ক্ষমতার চক্ষু রক্তবর্ণ, তর্জনী সমুদ্যত, বাক্যগুলি রূঢ় ও কর্কশ। মনে পড়ে, বছরখানেক আগে কৃষক আন্দোলনের মোকাবিলায় লেজেগোবরে হয়ে ক্রুদ্ধ এবং উদ্বিগ্ন প্রধানমন্ত্রী প্রতিপক্ষকে ‘আন্দোলনজীবী’ বলে গাল পেড়েছিলেন। একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনকে এ-ভাবে ছোট করার ফল তাঁর পক্ষে ভাল হয়নি, ওই কটু মন্তব্যের ফলে প্রতিবাদী কৃষকদের প্রতি জনসমর্থন দ্বিগুণ সংহত হয়েছিল।
মুখ্যমন্ত্রী আন্দোলনকে ছোট করেননি, আন্দোলনকারীদের ছোট করেছেন। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, যাঁরা সরকারের তথা শাসক দলের বিরুদ্ধে (সুতরাং তাঁর বিরুদ্ধে) প্রতিবাদে সরব ও সক্রিয়, তাঁদের ছোট করেছেন। এবং সে জন্য, প্রচলিত রীতি মেনে, নিজেকে বড় করেছেন— বিরোধী নেত্রী হিসাবে দীর্ঘ ও সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতার পরে ‘আমাকে কেউ যেন আন্দোলন না শেখায়’। এই উচ্চারণে ক্ষমতার যে কণ্ঠস্বর, এক দশকের রাজত্বে সেটি বহুশ্রুত। বিশেষ করে প্রশাসনের উপর কোনও বড় রকমের চাপ তৈরি হলে এই স্বরধ্বনি প্রবল হয়। যেমন চাপ গত কিছু দিন ধরে তৈরি হয়েছে; ক্রমাগত সে-চাপ বাড়ছে, আর প্রায় তার প্রতিবর্ত ক্রিয়াতেই বারংবার প্রকট হচ্ছে শাসকের রুদ্রমূর্তি।
শাসনযন্ত্রের কীর্তিকলাপেও তারই প্রতিফলন। বীরভূম থেকে কলকাতা-হাওড়া, প্রতিবাদী আন্দোলনের উপরে রাষ্ট্রীয় এবং দলীয় দাপট যে ভাবে ক্রমাগত চড়াও হচ্ছে তা শুধু ভয়ানক নয়, তাৎপর্যপূর্ণও বটে। উর্দিধারীদের (এবং উর্দিবিহীনদের) আচরণে অহরহ ফুটে উঠছে একটা মরিয়া ভাব, যা এ-রাজ্যের পুলিশের মাপকাঠিতেও কিছুটা অস্বাভাবিক। প্রকাশ্য রাজপথে প্রতিবাদীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লে সেই সুকীর্তির চলৎচিত্র মুহূর্তের মধ্যে লক্ষ মোবাইলে সঞ্চারিত হবে— এ-কথা ষোলো আনা জেনেও শাসকের বাহিনী কিছুমাত্র পিছপা হচ্ছে না। এই বাস্তব এক দিকে চিনিয়ে দেয় (শঙ্খ ঘোষের ভাষায়) ‘প্রতাপ-অন্ধতা’কে, অন্য দিকে সংশয় জাগায়— ক্ষমতার অধীশ্বররা কি তবে ভয় পাচ্ছেন? সবুজ ঝড়ও যে ভয়কে উড়িয়ে দিতে অক্ষম?
এই সংশয় সত্য হলে অবাক হব না, বরং শাসকদের রাজনৈতিক ঘ্রাণশক্তির তারিফ করব। তার কারণ, ঝড়-টড়ের সাময়িক উন্মাদনার অন্তরালে রাজ্য রাজনীতিতে যে বাতাস বইছে সেটা বাস্তবিকই তাঁদের পক্ষে সুবাতাস নয়। যে দু’টি ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক বিক্ষোভ ঘনিয়েছে, সেই দু’টিই এ ক্ষেত্রে বিশেষ প্রাসঙ্গিক। ডেউচা-পাঁচামির বিস্তীর্ণ এলাকায় মাটি আর পাথরের নীচ থেকে কয়লা তোলার প্রকল্পটি কোন সুদূর ভবিষ্যতে রাজ্য অর্থনীতির ক’আনা উন্নয়ন ঘটাবে, সেই উন্নয়নের মানে কী, পরিবেশের তাৎক্ষণিক এবং দীর্ঘমেয়াদি ক্ষয়ক্ষতি হিসাবে তার কতটা মাসুল গুনতে হবে, সেই সব প্রশ্ন আছে এবং থাকবে, কিন্তু এই মুহূর্তে যে প্রশ্নটা সবচেয়ে বড় আকারে উঠে এসেছে তা হল, যে প্রকল্পের কারণে বহু মানুষের উচ্ছেদ— কেবল বসতি থেকে নয়, জীবনযাত্রার সামগ্রিক পরিসর থেকে উচ্ছেদ অনিবার্য, যথার্থ সামাজিক সম্মতি না থাকলে অতি বড় উন্নয়নের নামেও তা চাপিয়ে দেওয়া চলে কি? প্রশ্নটা নৈতিকতার, কিন্তু নৈতিকতার মাত্রাটি এখানে নিছক আদর্শের নয়, বাস্তবেরও। রাজনৈতিক বাস্তব। সামাজিক সম্মতিকে অস্বীকার করে কিংবা ছলে বলে কৌশলে সেই সম্মতি উৎপাদনের চেষ্টা চালিয়ে রাজনীতির হাটে শেষরক্ষা করা যাবে কি না, সে বিষয়ে বিস্তর সন্দেহ আছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এগারো বছর রাজ্য চালানোর পরে এ-বার ‘উন্নয়ন বনাম উচ্ছেদ’ নামক পরিচিত (রাজ)নৈতিক সমস্যাটির মুখোমুখি। এ-সমস্যার চরিত্র যে আগ্নেয়গিরির মতো, সে-কথা তিনি নিশ্চয়ই বোঝেন। তিনি তো আন্দোলন করে বড় হয়েছেন।
দ্বিতীয় প্রসঙ্গটিও (রাজ)নীতির সঙ্গে নিবিড় ভাবে জড়িয়ে আছে। আনিস খান কাহিনির পূর্ণ বিবরণ এখনও অজ্ঞাত, চিরকাল অ-জ্ঞাত থাকলেও বিস্ময়ের কিছু নেই; কিন্তু যে অঞ্চলে তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ছিল, যে ধরনের আশঙ্কার কথা তিনি সাম্প্রতিক অতীতে জানিয়েছিলেন, তাঁর যে পরিণতি হল এবং তার উত্তরকাণ্ডে যা কিছু ঘটে চলেছে— সবটা পাশাপাশি রাখলে রাজ্যের শাসক দল ও পুলিশ প্রশাসন সম্পর্কে ভয়াবহ সন্দেহগুলিকে ভুলে যাওয়া অত্যন্ত কঠিন বইকি। রাজধর্ম শব্দটি সেই ২০০২ সালে প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর পবিত্র সুসমাচার থেকে শুরু করে ক্রমাগত বহুব্যবহারে এবং অপব্যবহারে নষ্ট হয়ে গেছে, তা না হলে বলা যেত, পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসনকে রাজধর্মে ফিরতে চাইলে একেবারে অআকখ থেকে শুরু করতে হবে।
রাষ্ট্রযন্ত্রের চালকদের নির্বোধ মনে করার কারণ নেই। তাঁরা জানেন, ভোটের অঙ্ক আর নৈতিক অধিকার এক জিনিস নয়, এবং ‘ভোটযন্ত্র’ যত শক্তিশালীই হোক না কেন, শাসনের নৈতিক ভিতটি হারিয়ে ফেললে সর্বগ্রাসী জনবাদের ইমারত নড়বড়ে হয়ে পড়বে, ফলে ক্ষমতার ভবিষ্যৎ বিপন্ন হবে। আর সেটা জানেন বলেই, তরুণ প্রতিবাদীদের প্রতিস্পর্ধী আন্দোলন রাষ্ট্রশক্তির অন্যায় ও অনৈতিকতাকে জনসমক্ষে চিহ্নিত করলে, অনাচারের প্রতিবাদ করলে শক্তিমানদের দুশ্চিন্তা ও ক্রোধ উত্তেজিত হয়, সুতরাং তাঁদের সেপাই-সান্ত্রিরা মরিয়া ও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এই আত্মভুক প্রতাপ-অন্ধতার চেহারা পশ্চিমবঙ্গবাসী অতীতেও দেখেছেন, বর্তমানেও দেখছেন, আশঙ্কা হয় ভবিষ্যতেও দেখবেন।
এ-ব্যাধির নিজস্ব নিয়মেই, যত দিন যায় সেই চেহারা উত্তরোত্তর নিরাবরণ হয়ে ওঠে। এতটাই, যে, সিনেমার পর্দায় বা নাটকের মঞ্চে নয়, পাড়ার রাস্তায় দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রশক্তির স্থানীয় উপস্বত্বভোগী অম্লানবদনে জানিয়ে দেন: পুরনির্বাচনে ছাপ্পা ভোট যদি হয়ে থাকে, ঠিকই হয়েছে, তিনি সে জন্য ছাপ্পা-কুশলীদের ‘ধন্যবাদ’ জানাচ্ছেন, আর আগামী পঞ্চায়েত ভোট? সে তো ‘আমাদের ব্যক্তিগত ভোট’। গণতান্ত্রিকতার ধ্বজাটিকে এই উচ্চতায় তুলে ধরার জন্য এমন দলীয় সম্পদদের কি শাস্তি হবে? অন্তত সরকার বা দলের উপরমহল থেকে তিরস্কার শুনতে হবে? উত্তর আমাদের জানা। ক্ষমতার দাপট কাকে বলে— প্রতিবাদী আন্দোলনকে দমন করতেই হোক, ভোটের ফসল গোলায় তুলতেই হোক— তার লীলা কোথায় পৌঁছতে পারে, আমাদের কেউ যেন সেটা না শেখাতে আসে।