সতর্ক: প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে দূরবৈঠকে বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর, আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও বিদেশসচিব ব্লিঙ্কেন, ওয়াশিংটন, ১১ এপ্রিল। রয়টার্স
সঘন গহন রাত্রি। বর্ষায়, বন্যায় বিধ্বস্ত এক ভালুক কোনওক্রমে প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছে নদী-তীরবর্তী একটি বৃক্ষে। কিন্তু স্রোতের দাপটে সেই গাছ নদীতে, ভালুকও ভেসে যাচ্ছে। কম্বল ভেবে এক ব্যক্তি নদীতে ঝাঁপ দিল। ভালুকও প্রাণের তাড়নায় তাকে জাপটিয়ে ধরল। স্রোত বাড়ায় দু’জনেই ভেসে যেতে লাগল। চেষ্টা করেও লোকটি ভালুককে ছাড়াতে পারল না। কম্বল-সহ লোকটি ডুবে যায় দেখে তীরে থাকা এক বন্ধু চেঁচিয়ে বলে, ‘কমলি ছোড় দো কমলি ছোড় দো!’ ডুবতে ডুবতে সকাতর ব্যক্তি জবাব দেয়, ‘হাম তো ছোড়া, লেকিন কমলি নহি ছোড়তা!’
কে ভালুক, কে ওই ডুবন্ত ব্যক্তি, কে-ই বা তীরে দাঁড়ানো পরামর্শদাতা! দুর্যোগটাই বা কী? একটু অদলবদল করে নিয়ে দেখলে ‘দুর্যোগ’ হল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, যার জল ক্রমশ কানের কাছে পৌঁছে গিয়েছে বিশ্ববাসীর। আর কে কাকে বাঁচতে জড়িয়ে ধরছে? কে সেই কমলি, যে ছাড়বে না কিছুতেই? পাঠকের কল্পনার উপরেই চরিত্র নির্বাচনের ভার ছেড়ে মূলে আসি।
রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করার পর দুই মাস কাটল, মচকানো যায়নি মোদী সরকারের রাশিয়া-প্রণয়কে। রাষ্ট্রপুঞ্জে একের পর এক মস্কো-বিরোধী প্রস্তাব এনেছে এবং আনিয়েছে আমেরিকা। কোনওটির পক্ষেই ভোট না দিয়ে, কেবলমাত্র হিংসা বন্ধের আবেদন করে গিয়েছে নয়াদিল্লি। প্রীত রাশিয়ার বিদেশমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ নয়াদিল্লি পৌঁছে গিয়ে, ভারতকে সস্তায় অশোধিত তেল দেওয়ার প্রতিশ্রুতি প্রগাঢ় করেছেন। আমেরিকার উপ বিদেশসচিব দলীপ সিংহ একই সময়ে ভারতে এসে হুমকি দিয়ে গিয়েছেন, এই নিষ্ঠুর নির্মম পুতিন প্রশাসনের পাশে যে বা যারা দাঁড়াবে, তাদের ফল ভোগ করতে হবে! এর পরই ইউক্রেনের বুচায় নরমেধের ছবি বিশ্বপর্দায় আসায়, আর সবার সঙ্গে গলা মিলিয়ে ভারতও নিরপেক্ষ তদন্ত চেয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাতে তাদের রাশিয়া থেকে তেল আমদানিতে তারতম্য ঘটেনি।
এই প্রেক্ষাপটকে পিছনে নিয়ে সম্প্রতি সম্পূর্ণ আমেরিকার উদ্যোগে, মুখোমুখি হলেন (ভিডিয়ো মাধ্যমে) আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং প্রধানমন্ত্রী মোদী। আমরা কী দেখলাম? মোদী যৎপরোনাস্তি নিন্দা করলেন ইউক্রেন-হিংসার। সেই সঙ্গে বিস্তারিত ভাবে বাইডেনকে জানালেন, শান্তি ফেরানোর জন্য রাশিয়া এবং ইউক্রেন— উভয় পক্ষের সঙ্গে তিনি কী ভাবে দৌত্য করেছেন। আমরা পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানি, আমেরিকার ভবি সহজে ভোলে না। নাছোড়বান্দা বাইডেন বললেন, এই সঙ্কট নিয়ে তিনি ‘নিয়মিত এবং ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ’ রেখে যাবেন ভারতের সঙ্গে। যেটা উহ্য রইল, রাশিয়াকে দুর্বল করার জন্য তিনি নিয়মিত এবং ঘনিষ্ঠ ভাবে চাপ তৈরি করে যাবেন মোদী সরকারের উপর।
না, ‘রুপি-রুবল’ দেওয়া-নেওয়া বাইরে গোপন রেখে রাশিয়ার থেকে আমদানির সিদ্ধান্ত যতই অনড় থাক ভারত, কৌশলগত মিত্র ‘কমলি’ (ওয়াশিংটন) এর শেষ না দেখে ছাড়বে না!
এই দমবন্ধ করা সরু তারের উপর দিয়ে ভারতের চলার ‘শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে’! আর এই বিশ্লেষণ তো নিছকই তাত্ত্বিক নয়, রাস্তায় রোজ আনাজ নিয়ে বসা চাষি থেকে তথ্যপ্রযুক্তি অভ্রংলিহে অর্থের বিনিময়ে শ্রমদান করে যাওয়া যুবক-যুবতীর ত্বকে সরাসরি ছেঁকা লাগার সঙ্গে যুক্ত এই যুদ্ধের অভিঘাত। তাই, এক বার দেখে নেওয়া যাক এই জটিল যুদ্ধের পরিণতি ও সম্ভাবনাগুলি। আপাতত তিনটি সম্ভাবনাকে পাশাপাশি রাখা যায়।
এক নম্বর চিত্র। যুদ্ধশেষে ভ্লাদিমির পুতিন আগের তুলনায় অনেকটাই দুর্বলতর নেতা হয়ে গেলেন। বিশ্বজোড়া আর্থিক নিষেধাজ্ঞার চাপ, ঘরোয়া অসন্তোষের প্রাবল্য, সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে ব্যর্থতা ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে।
এই চিত্রটি ভারতের জন্য খুব সুবিধার নয়, কারণ এ ক্ষেত্রে অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখতে মস্কোর বেজিং-নির্ভরতা অনেক বাড়বে। রাশিয়া-ভারত অস্ত্র সরঞ্জামের প্রশ্নে চিন তখন অতি অবশ্যই লাল দাগ মারবে। আমেরিকার পক্ষেও এই ছবিটি সুখকর নয়, কারণ রাশিয়া দুর্বল হলে আসল জয় হবে চিনের, যে কিনা এই মুহূর্তে আমেরিকার পয়লা নম্বর শক্র। পরমাণু-সাবমেরিন থেকে শুরু করে রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র প্রযুক্তির আসল মালিকানা তখন থাকবে বেজিংয়ের হাতে। রাশিয়ার হাইড্রোকার্বন পণ্যসংস্থার মালিকানাও যে চিনের হাতে চলে যাবে না, তা কে বলতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে রাশিয়া-চিনকে এক বন্ধনীতে রেখে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভারতকে কাছে পেতে কিছুটা সুবিধা হবে আমেরিকার।
দু’নম্বর ছবি। যুদ্ধের পর পুতিন আরও শক্তিশালী হয়ে উঠলেন। যদিও আন্তর্জাতিক গতিপ্রকৃতি দেখে এই চিত্রটিকে কষ্টকল্পিতই মনে হচ্ছে আপাতত। তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যাক যুদ্ধ পুরোপুরি ভাবে রাশিয়ার পক্ষে চলে গেল। তর্কের খাতিরে এটাও ধরে নিই, আমেরিকার নিষেধাজ্ঞায় গায়ে ছেঁকা লাগল না মস্কোর। ইউরোপ এবং আমেরিকাকে তখন মানতেই হবে, জ্বালানির প্রধান উৎস হিসেবে রাশিয়াকে প্রতিস্থাপিত করা যাবে না। এই পরিস্থিতি ভারতের জন্য বেশ ভালই। চিনের উপর রাশিয়ার নির্ভরতা কমবে, এবং চিনের সঙ্গে ভারসাম্যের কূটনীতি বহাল রাখতে ভারতকে পাশে রাখবে রাশিয়া। রাষ্ট্রপুঞ্জে ভারতের ভূমিকার একটা ‘রিটার্ন গিফ্ট’ দেওয়ারও তো ব্যাপার থাকে (যদিও মস্কোর কথামতো মানবাধিকার কাউন্সিলের ভোটাভুটিতে রাশিয়ার পাশে দাঁড়ায়নি ভারত)! ভারত-রাশিয়া উন্নততর প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি সম্পর্ক, চিনের কৌশলগত অভিপ্রায়কে দুরূহ করে তুলবে। দক্ষিণ চিনা সাগরে তাদের লপচপানিও কিছুটা কমবে। রাশিয়ার মিত্র হিসেবে বিশ্ব-মানচিত্রে ভারতের দরকষাকষির ক্ষমতা বাড়বে।
তিন নম্বর চিত্র। যুদ্ধের পর পুতিনকে সরিয়ে দিয়ে রাশিয়ায় নতুন নেতাকে বাছা হতে পারে। সেই নতুন নেতাও যদি ‘পুতিনগিরি’ করেন, তা হলে উল্লিখিত প্রথম চিত্রটিই ফিরে আসবে। তবে সম্ভাব্য বিকল্প নেতাটি পুতিনের পথে হাঁটবেন না সেটাই স্বাভাবিক। কারণ, পুতিনকে সরতে গেলে দেশের ভিতর অভ্যুত্থান, গণআন্দোলন, তোলপাড়ের মধ্যে দিয়েই তা হবে। রাশিয়া নতুন পথ অবলম্বন করতে চাইবে কাঠখড় পুড়িয়ে। অনেকটাই পশ্চিমপন্থী বিদেশনীতি নিতে দেখা যাবে তখন সে দেশকে।
আর রাশিয়ার পশ্চিমমুখী নীতির অর্থ, নিষেধাজ্ঞার জুজু এড়িয়ে ভারত অস্ত্র আমদানি করতে পারবে রাশিয়া থেকে নির্ভয়ে, অবাধে। আমেরিকাও পুতিনকে পরাভূত করে নতুন অংশীদার পাবে চিনকে প্রশমিত করার জন্য। অবশ্যই এই পরিস্থিতি সবচেয়ে বেশি যে এড়াতে চাইবে— সে হল বেজিং।
এই তিনটি চিত্রের মধ্যে কিছুটা প্রথম এবং অনেকটাই তৃতীয় চিত্রে অর্থাৎ পুতিনকে সরানো হলে, ভারত এবং আমেরিকার স্বার্থের মিলন ঘটা সম্ভব। যার সম্ভাবনা আপাতত কিছুটা কম। অন্যথা, আমেরিকা এবং ভারতের অন্তহীন সন্তরণ চলবে দুর্যোগপূর্ণ নদীতে, যেখানে কখনও জোয়ার আসবে, কখনও ভাটা। চলতেই থাকবে এই দুই বৃহৎ গণতন্ত্র এবং কৌশলগত অংশীদারের মধ্যে রাশিয়াকে নিয়ে ভারসাম্য ও সংঘাতের কূটনীতি। একের পর এক নিষেধাজ্ঞার জাল বিস্তার করবে আমেরিকা। আর তা কেটে বেরোনোর চেষ্টা করবে ভারত।এ খেলা চলবে নিরন্তর।