—প্রতীকী চিত্র।
বাবা-মা দু’জনেই কাজ করে সংসার চালান। দিন-রাত এক করে আয় করেন। একটাই চাহিদা, বাসনা এবং স্বপ্ন। সন্তান যেন তাঁদের মতো না হয়। দিন-আনি-দিন-খাই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে নিজেকে গড়ে তুলতে পারে। কিন্তু সেই স্বপ্ন ডুবতে বসেছে ক্রমাগত তীব্র হতে থাকা পড়ানোর খরচের চাপে। সরকারি বদান্যতায় চলা স্কুল থেকে বড়টা কলেজে ভর্তি হওয়ার মুখেই ছিটকে বেরিয়ে আসত খরচের কারণেই। কিন্তু পাড়ার এক কাকুর বদান্যতায় বড়টা কলেজে পড়া চালিয়ে যাচ্ছে। অন্য কেউ যদি এগিয়ে আসেন তা হলে ছোটটাকে এগিয়ে নিয়ে যাতে পারেন এই দম্পতি।
আর এটাই বৈষম্যের মূল কথা। বিশ্বের অন্যতম আর্থিক শক্তিধর দেশ হয়েও তার প্রান্তিক নাগরিকের জন্য সেই জায়গা এখনও করে দিতে পারেনি যেখানে দাঁড়িয়ে মানবসম্পদ গড়ে তোলার প্রাথমিক পরিকাঠামোর শর্তটা পূরণ হয়ে গিয়েছে।
সমস্যাটাকে আরও সোজা করে ভাঙলে প্রশ্নটা দাঁড়ায় এই রকম। দেশের প্রান্তিক নাগরিকের সন্তান এবং আর্থিক বন্ধনীর শীর্ষে থাকা নাগরিকের সন্তান একই মেধার হলেও কি দুজনের নিজেকে গড়ে তোলার প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো ব্যবহারের সমান সুযোগ থাকবে?
এর উত্তর যে এক কথায় ‘না’ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তথ্যের বাইরে গিয়ে বোধের জায়গা থেকেই যদি এই উত্তর আমাদের মনে ভেসে ওঠে তা হলে কিন্তু বৈষম্যের রাস্তাটা এখনও যে ভেঙে ফেলা যায়নি তা মানতেই হয়।
ভারতের অর্থনীতির এই সমস্যাটি কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে বেড়েছে বই কমেনি। অথচ উল্টোটাই হওয়ার কথা ছিল। আর এটা হলেই কিন্তু বলা যেত গড়ার দায়িত্ব ছিল রাষ্ট্রের। এ বার নিজের দক্ষতা দিয়ে নিজের জীবন গড়ে নাও।
যে বাজার অর্থনীতিতে আমাদের এত আস্থা সেই অর্থনীতির তত্ত্বও কিন্তু রাষ্ট্রের এই দায়িত্ব মানে এবং উন্নয়নের প্রাথমিক শর্ত হিসাবে শিক্ষার সর্বজনীন পরিকাঠামো তৈরিতে রাষ্ট্রের দায়ের উপরেই জোর দিয়ে থাকে। আমরা সবাই জানি কেন, তবুও আরেকবার না হয় যুক্তিটা ঝালিয়ে নেওয়া যাক। সাক্ষরতা বলতে সাধারণ ভাবে বলা হয় নিজের নাম লিখতে এবং সহজ লেখা পড়তে পারার ক্ষমতা। এই অঙ্কে স্বাধীনতার পর ১৮ শতাংশ সাক্ষরের অঙ্ক থেকে আজকের ৭৭.৭ শতাংশে পৌঁছনো একটা কৃতিত্ব বলে মানতেই হবে।
এইবার একটা ঢোঁক গিলতেই হচ্ছে। এই ৭৭ শতাংশের মধ্যে কতজন লিখিত কোনও তথ্য বুঝে উঠতে পারেন তার সঠিক কোনও পরিসংখ্যান হাতের কাছে পাওয়া যায় না। বাজারের চাহিদা মেপে নিজেদের গড়ে তোলার সুযোগের তথ্যও হাতের কাছে নেই। তবে এটা সাধারণ জ্ঞান যে আজকে দুনিয়ায় যে কোনও স্তরেই করে খেতে গেলে শিক্ষার যে স্তর পর্যন্ত যাওয়া দরকার বেশির ভাগ তরুণ নাগরিককেই সেই সুযোগ করে দেওয়া মতো আর্থিক ক্ষমতা তাদের পরিবারের নেই। আর এই অধিকারের অভাবই দেশের আপাত বর্ধমান বৈষম্যের অন্যতম একটি কারণ।
কিছুদিন আগেও আমরা ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড‘ শব্দটা খুব ব্যবহার করতাম। সংবাদমাধ্যম থেকে সরকারি ইস্তাহার— সব জায়গাতেই একটা হইচই এ নিয়ে। কিন্তু এ নিয়ে বিশেষ কিছু আর শোনা যায় না ইদানীং। তখন তা করতাম তার কারণ বোধহয় আমরা ভেবেছিলাম দেশে তরুণের সংখ্যা বাড়লে শ্রমশক্তিতে তাঁদের অবদান আপনিই বেড়ে একটা বিরাট আর্থিক প্রগতির জায়গা তৈরি হবে। কিন্তু তা হয়নি তার কারণ আমরা সেই পরিকাঠামো তৈরি করতে পারিনি যা ব্যবহার করে এই তরুণরা তাঁদের দক্ষতা বাজারে বিক্রির যোগ্য করে তুলতে পারে।
এটা যে পারিনি তা কিন্তু সরকারি তথ্যে চোখ রাখলেই পরিষ্কার হয়ে যায়। অনেকেরই মনে থাকার কথা কোঠারি কমিশনের কথা। ১৯৬৬ সালে পরের ২০ বছরের উন্নয়নের ভিত্তিতে শ্রমশক্তির চাহিদার হিসাবের ভিত্তিতে বাজেটে অন্তত জাতীয় উৎপাদনের ৬ শতাংশ শিক্ষাখাতে বরাদ্দের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু আজও আমরা তার ধারে কাছে পৌঁছতে পারিনি। শুধু তাই নয়, এই অনুপাতে গড়ে তিন শতাংশও ছুঁয়ে উঠতে পারেনি। আর তাই কোঠারি কমিশনের ৫৪ বছর পরেও জাতীয় শিক্ষানীতি সেই একই কথা বলে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে দিল্লি এখনও অনেক দূরেই।
বণিকসভা সিআইআই তাদের ওয়েবসাইটে আধুনিক শিল্পে কী ধরনের শ্রমসম্পদ প্রয়োজন তা ব্যাখ্যা করে বলেছে দেশে যদি শ্রমসম্পদ অক্ষর জ্ঞানের পরে আরও কয়েক ধাপ হেঁটে কোনও তথ্য পড়ে তা আত্তীকরণ করার ক্ষমতা অর্জন করতে পারে তা হলে গোটা দেশের উৎপাদন ক্ষমতা শুধু বাড়বে তা নয়, শিল্পে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগও বাড়বে।
কিন্তু এই জায়গাটায় পৌঁছতে গেলে শিক্ষা পরিকাঠামোর বিস্তারে খরচ করলেই হবে না, তা যাতে সাধারণ নাগরিকের অধিকারে থাকে তাও দেখতে হবে। অনেকেই বলবেন, এটা মানা কষ্টকর কারণ বিগত কয়েক দশকে আইআইটি, আইআইএম এবং এআইআইএম জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে সেখানে পড়ার খরচ যে ভাবে বেড়েছে তাতে এই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রান্তিক নাগরিক তো কোন ছাড় এমনকি মধ্যবিত্তেরও হাতের বাইরে চলে গিয়েছে।
আইআইটির উদাহরণ নেওয়া যাক। গত ছয় বছরে বিশেষ কোনও অগ্রাধিকার পাওয়ার সুযোগ নেই এমন ছাত্রের পড়ার খরচ বছরে ৫০ হাজার থেকে তিন লক্ষ টাকায় বেড়ে দাঁড়িয়েছে। আনুষঙ্গিক খরচ ধরে তা গড়ে আট লক্ষ টাকার মতো হবে। অনেকেই বলবেন ইদানীং পড়াশোনার জন্য ঋণ পাওয়া সহজ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তার বোঝা বয়ে ওঠাটা যে কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠেছে তা অস্বীকার করার কোনও জায়গা নেই। সরকারি তথ্যই বলছে সাধারণ পরিবারের ঋণের বোঝা বাড়ছে, প্রকৃত আয় মোটামুটি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আর জিনিসপত্রের দাম আকাশ ছুঁয়ে ফেলেছে।
এ বার নেওয়া যাক দুই অভিভাবকের কথা। একজন নিম্ন মধ্যবিত্ত, অন্যজন উচ্চবিত্ত। দু’জনের সন্তানই সমান মেধাবী এবং দুজনেই আইআইটির মতো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার যোগ্য। কিন্তু একজন ভাববেন তাঁর পক্ষে সন্তানের পড়ার খরচ কী ভাবে চালাবেন তাই, আর আরেকজন কিন্তু পাড়ায় মিষ্টি বিলি করবেন।
অধিকারের জায়গা থেকে যদি ভাবি তা হলে কি সত্যিই সমযোগ্যতার দুই তরুণের প্রশিক্ষণের সমান সুযোগের ব্যবস্থা আমরা করে উঠতে পেরেছি? এর এক কথায় উত্তর হল, ‘না’। এই বৈষম্য শিক্ষা আর প্রশিক্ষার সব স্তরের এক এবং বাড়ছে। আর তাই দেশের ক্রমবর্ধমান আর্থিক বৈষম্য নিয়ে অনেকেই চিন্তিত। কারণ, দেশের শ্রম সম্পদের বিস্তৃত ব্যবহারের মধ্যেই রয়েছে দেশের সম্পদের সুষ্ঠু বন্টনের চাবিকাঠি। আর কয়েকদিন বাদেই কেন্দ্রীয় ব্যয়বরাদ্দের রূপরেখা সামনে আসবে। এটা ভোটের বছর। তবে এই সরকার ফিরলে খরচের চরিত্র কী রকম হবে তার স্পষ্ট আন্দাজ পাওয়াই যাবে। তাতে নানান আশার মধ্যে যা থাকবে না তা হলে এই মূল সমস্যার সমুচিত উত্তর। বৈষম্য থেকে বেরিয়ে আসার অধিকার থেকেই যাবে সেই তিমিরেই।