প্রতি দিন কুরুক্ষেত্রে সঞ্জয়
Journalism

আবেগ জরুরি, তার উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে জানাও জরুরি

সংবাদ-উৎসারিত স্বপ্ন কিন্তু কল্পনাসৃজিত নয়, সাহিত্যের স্বপ্নও নয়; তা সম্পূর্ণ ভাবে বাঁধা ঘটনা ও তথ্যের কাঁটাতারে।

Advertisement

অগ্নি রায়

শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০২১ ০৪:৪৮
Share:

সাধারণ ভাবে বলা হয়, একটা ফোটোগ্রাফ হাজার শব্দের হয়ে কথা বলে। এই পাটিগণিতে বৈদ্যুতিন মিডিয়ার প্রতি দিনের প্রতি মিনিটের চলমান ছবির মাধ্যমে কত হাজার শব্দের আঘাত বা অভিঘাত তৈরি হচ্ছে দর্শকের মগজে? নিঃসন্দেহে সংখ্যাটা বিপুল। আর এই বিপুল তরঙ্গের মধ্যে ভাসমান আমরা, দর্শকরা যে উথালপাথাল, তা আরও স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে ইয়াস-পরবর্তী বৈদ্যুতিন মিডিয়ার কভারেজ নিয়ে মূলত সমাজমাধ্যমে প্রবল তর্কবিতর্কের পর।

Advertisement

‘জানার অধিকার’ প্রবন্ধে কেতকী কুশারী ডাইসন লিখছেন, “মিডিয়ার পক্ষে খারাপ খবরের চেয়ে ভাল খবর আর নেই। দুর্ঘটনা, দাঙ্গা, মহামারী, বন্যা, যুদ্ধ, গণমৃত্যু ইত্যাদি ভয়ঙ্কর তথ্যে মিডিয়ার চূড়ান্ত অধিকার। ...তথ্যে আমাদের অধিকারকে চালু রাখতে গিয়ে ভারাক্রান্ত হওয়াটাই কি আমাদের আধুনিক নিয়তি? ...জানার অধিকারের পিছনে পিছনে কি আসে না, কিছু করার দায়িত্ব?”

‘কিছু করার দায়িত্ব’র প্রসঙ্গ স্বতন্ত্র এবং বর্তমান আলোচনার বিষয় নয়। কিন্তু এই ‘আধুনিক নিয়তি’?

Advertisement

ফ্রান্সের অন্যতম বিশিষ্ট সংবাদপত্র ল্য মোন্দ্-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক উব্যের দ্য ব্যোভ্-মেরি ১৯৮০ সালে এক সাংবাদিক সমাবেশে দেওয়া বক্তৃতায় বলেছিলেন— “সংবাদপত্র এমনই এক স্বপ্ন, যা আমরা সমবেত ভাবে দেখি দিনের পর দিন।” বৈদ্যুতিন মিডিয়া সে সময় পশ্চিমে প্রচলিত হলেও অনুমান করি, আজকের মতো বাড়বাড়ন্ত ছিল না। তাই আজ ওই বাক্যকে একটু বদলে সংবাদপত্রের জায়গায় গণমাধ্যম হিসেবে বসিয়ে নিলেও মূল অর্থহানি হয় না। এখানে এই ‘সমবেত’ কথাটির মধ্যে রয়েছে প্রোডিউসার, অ্যাঙ্কর, রিপোর্টার এবং হ্যাঁ, অবশ্যই দর্শক এবং পাঠক। এই জ্যান্ত স্বপ্নের প্রসারে দর্শকের ভূমিকা মুখ্য, কালক্রমে যা এখন সামাজিক অভ্যাসে পরিণত।

এখানে মনে রাখলে সুবিধা হয় যে, সংবাদ-উৎসারিত স্বপ্ন কিন্তু কল্পনাসৃজিত নয়, সাহিত্যের স্বপ্নও নয়; তা সম্পূর্ণ ভাবে বাঁধা ঘটনা ও তথ্যের কাঁটাতারে। যে কাঁটাতার তৈরি রয়েছে নৈতিক ও সামাজিক গণরুচি দিয়ে; সংযমবোধ দিয়েও। সাম্প্রতিক ঝড়ের কভারেজ করতে গিয়ে এই বিষয়গুলি আহত হয়েছে বলে জনতার রায়, এবং তার থেকে প্রশ্ন-প্রতিপ্রশ্ন সমালোচনা, কৌতুক, পৌঁছে গিয়েছে সাংবাদিকতার অভ্যন্তরীণ উঠোন পর্যন্ত। প্রতিটি পেশার মতোই সাংবাদিকতাও শেষ পর্যন্ত একটি পেশাই, এবং শত চেষ্টা সত্ত্বেও অন্য সব পেশার মতোই তাতেও বিচ্যুতি আসে (কখনও যা হাস্যকর পর্যায়েও পৌঁছয়)— সে বিচারের ধৈর্যও থাকছে না। সে সব পেরিয়ে একটি প্রশ্ন সবচেয়ে বেশি করে প্রাসঙ্গিক এবং একই সঙ্গে সমালোচিত হয়ে উঠছে: সাংবাদিকতা এবং অন্তর্নিহিত আবেগের ভারসাম্যবোধ নিয়ে প্রশ্ন।

মাঠে নেমে, বা বলা ভাল যুদ্ধক্ষেত্রে নেমে, সাংবাদিকতা করার জন্য আবেগ প্রয়োজন, সেটা একশো ভাগ সত্যি। এই অ্যাড্রিনালিন-এর ওঠাপড়াকে বাদ দিলে শেষ পর্যন্ত প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ আলুনি হয়ে ওঠে। এটাও ঠিক যে, বুলেটের মুখে বা প্রবল জলোচ্ছ্বাসের মধ্যে গিয়ে দাঁড়াতে গেলে একটা বিশেষ সাহস দরকার হয়। প্রকৃত অর্থেই ছাপান্ন ইঞ্চি করে তুলতে হয় ছাতির মাপ। কিন্তু সেই অ্যাড্রিনালিন রাশ বা ক্ষরণকে একটি ভারসাম্যে ধরে রাখাটাও বোধ হয় ততটাই জরুরি, যাতে বর্ণিত বিষয়ের বাস্তবতা নষ্ট না হয় (বা তা যাতে অতিবাস্তব বা হাস্যকর না হয়ে ওঠে)। সেটাও পেশাদারিত্বই। আলগা, অগোছালো, গন্তব্যহীন আবেগে কাজের কাজ হয় না। প্যাশনেরও মাত্রাজ্ঞান কাণ্ডজ্ঞান ও বিচারবোধ রয়েছে। থাকা বিধেয়। নয়তো নিরাপদ এবং উষ্ণ ড্রয়িংরুমে বসে বন্যার কভারেজ দেখে ছিদ্রান্বেষণের অবকাশ থেকেই যাবে। যেমনটা ঘটল।

মহাভারতের ১৮ দিনের সর্বোত্তম ওয়ার রিপোর্টিং যদি এক বার দেখে নিই আমরা? সঞ্জয় যেখানে এক জন সর্বক্ষণের রিপোর্টার। প্রতি দিনের যুদ্ধে ডুবে গিয়ে আমরা খেয়াল করি না যে, ওটাও আসলে এক সাংবাদিকের চোখ দিয়েই দেখা— কখনও সামান্য বাহুল্যে, কখনও কঠিন সংযমে দুরন্ত। বর্ণনায় আবেগের অভাব নেই, অথচ নিপুণ নিটোল বাস্তব একটি রিপোর্টই লেখা হয়ে চলেছে যেন। সেই রিপোর্ট শুধুমাত্র দৈনন্দিন প্রাত্যহিকতারই নয়, তার মধ্যে রয়েছে পরিপ্রেক্ষিতের বুনোন। যে ভূমি অধিকারের জন্য এই মহারণ, সেই ভূমির বৃত্তান্তও। রয়েছে জনশ্রুতি, উপকথা, প্রয়োজনীয় তথ্য, লোকগাথার মিশেল। এবং হ্যাঁ, বর্ণনাকালীন সঞ্জয়ের আবেগের স্রোতও অন্তঃসলিলা হয়ে বয়ে রয়েছে এই রিপোর্টিং-এ। তাতে তালভঙ্গ হয়নি কোথাও। এ রকম উদাহরণ অনেক। সংযম থাকবে, কিন্তু তার মধ্যেই তাকে হতে হবে রংদার, স্পষ্ট, যা একলাফে পাঠক বা দর্শককে (ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ক্ষেত্রে) আহূত করবে। লন্ডনের অবজ়ার্ভার পত্রিকার প্রাক্তন সাহিত্য সম্পাদক সিরিল কনোলি-র মতে, “লিটারেচর ইজ় দ্য আর্ট অব রাইটিং সামথিং দ্যাট উইল বি রেড টোয়াইস। জার্নালিজ়ম হোয়াট উইল বি গ্র্যাসপ্‌ড অ্যাট ওয়ান্স।”

অনস্বীকার্য যে, এই অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণের বিষয়টি অনেকটাই বেশি বৈদ্যুতিন মিডিয়ার কর্মীদের ক্ষেত্রে। যাঁদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমরা প্রিন্ট মিডিয়ার লোকেরাও যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছি। এ ব্যাপারে একটি ঘটনা বলে বৃত্তান্ত শেষ করি। ষোলো বছর আগে এপ্রিল মাস। স্বাধীনতার পর প্রথম শ্রীনগর-মুজাফ্ফরবাদ বাস যাত্রা শুরু হওয়ার আগের দিন। টানটান উত্তেজনা শ্রীনগরে। গোটা কাশ্মীরেই মাছি গলতে না দেওয়া নিরাপত্তাবেষ্টনী। তবু তার মধ্যেই যাত্রীদের গেস্ট হাউসে হামলা চালিয়েছে জঙ্গিরা; বাইরে সেনার সঙ্গে গুলি বিনিময় চলছে। আগুনে দাউদাউ করে জ্বলছে ওই বাড়ির ছাদ (যার আট কলম ছবি প্রকাশিত হয়েছিল পরের দিন আনন্দবাজার পত্রিকা-তে)। এই ক্রস ফায়ারিং-এর মধ্যে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আমরা। এই সব ঘটনার কোনও পূর্বাভাস থাকে না, তবে কাশ্মীরে যে কোনও সময় যে কোনও অঘটনের জন্য প্রস্তুত থাকাটাই দস্তুর। তখন চ্যানেলের সংখ্যা কম, কিন্তু যাঁরা ছিলেন, তাঁদের ভূমিকার কথা ভোলার নয়। ক্যামেরাম্যানদের ধরে রাখা যাচ্ছিল না যেন। পতঙ্গের মতো ওই আগুনের দিকে ঝাঁপ দিচ্ছিলেন তাঁরা। উদ্দেশ্য, যত কাছে যাওয়া যায়, সেরা শটটি তুলে নেওয়ার জন্য। লাখ লাখ দর্শকের সঙ্গে তা ভাগ করে নেওয়ার জন্য।

আগুনের খুব কাছে গিয়ে বা ডুবন্ত জনপদের মধ্যে দাঁড়িয়ে দৃশ্যের সারকথা বা অবজেক্টিভ ট্রুথ তুলে আনার কাজটি, এক তীব্র আবেগ ছাড়া করা সম্ভব নয়। সেই সঙ্গে এই ষোলো আনা বাস্তব যাতে সাড়ে ষোলো আনা অতিবাস্তব না হয়ে ওঠে, তার জন্যও প্রয়োজন দায়িত্ব, যুক্তিবোধ এবং প্রখর সংযম।

সেটা মাথায় রাখলে তথ্য আর ভারাক্রান্ত করবে না, অতিরঞ্জিত বলে মনে হবে না বাস্তবের বর্ণনা। সমবেত ভাবে তৈরি হবে স্বপ্ন। যা নিছক কল্পনা নয়, মানবজমিন থেকে উঠে আসা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement