প্রধানমন্ত্রী মোদীর কার্যকালকে স্পষ্ট ভাবে দু’টি পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে— নোটবন্দির আগে এবং পরে। ছবি: সংগৃহীত।
সাধারণ ভাবে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কার্যকলাপে কেউ রাজনীতির ছায়া খোঁজেন না। কিন্তু কখনও কখনও ইচ্ছাকৃত ভাবে না-করলেও শীর্ষ ব্যাঙ্কের পদক্ষেপে এমন ছাপ দেখা যায়। এমনই একটি পদক্ষেপ হল শহুরে উপভোক্তাদের পছন্দ-অপছন্দ সংক্রান্ত ‘ক্রেতা-আস্থা সূচক’ (কনজিউমার কনফিডেন্স ইনডেক্স বা সিসিআই) সমীক্ষা। নরেন্দ্র মোদী শহুরে ভারতীয়দের আশাবাদী করে তুলতে যে দারুণ ভাবে সক্ষম হয়েছেন, এটি যেন তা-ই দেখাতে চায়। এটি যেন দেখাতে চায়, বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতি কঠিন হলেও, বা কোনও রকম উন্নতি না-হলেও, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে শহুরে মানুষের আশা যে হারে বাড়ছে, তা মোদী জমানার আগে দেখা যায়নি।
দেশের অর্থনীতির হাল, কর্মসংস্থানের সুযোগ থেকে শুরু করে আয় বৃদ্ধি— বিভিন্ন বিষয়ে ক্রেতাদের আস্থা কোথায় আঘাত খেয়েছে আর কোথায় তা মজবুত, নিয়মিত সেই সমীক্ষা করে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। সাধারণত সেই আস্থা যত মজবুত, ভোগ্যপণ্য কিনতে খরচের বিষয়ে তত বেশি স্বচ্ছন্দ হন ক্রেতা। আর চাকরি, আয়, এমনকি দেশের আর্থিক অবস্থার বিষয়ে আশঙ্কা যত বাড়ে, ততই খরচে হাত গোটানোর আশঙ্কা থাকে। শহুরে নাগরিকেরাই দেশের বাজারের ভোগ্যপণ্যের প্রধান ক্রেতা (কনজিউমার)। তাই দেশের বিভিন্ন শহরে তাঁদের আস্থার (কনফিডেন্স) পরিমাপ করে নিয়মিত অর্থনৈতিক স্বাস্থ্যপরীক্ষা করে আরবিআই।
দু’টি সূচকের উপর ভিত্তি করে উপভোক্তাদের মূল্যায়ন করে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক— ‘বর্তমান পরিস্থিতি সূচক’ (কারেন্ট সিচুয়েশন ইনডেক্স বা সিএসআই) এবং ‘ভবিষ্যতের প্রত্যাশা সূচক’ (‘ফিউচার এক্সপেকটেশন্স ইনডেক্স বা এফইআই)। উপভোক্তাদের দ্বৈত বৈশিষ্ট্যে ছাপ দেখা যায় সেখানে। ২০১৩ সালে (পূর্বতন ইউপিএ জমানার শেষ পর্বে) দু’টি সূচক ছিল কাছাকাছি। সে বছরের সেপ্টেম্বরের ‘বর্তমান পরিস্থিতি সূচক’ ছিল ৮৮, এবং ‘ভবিষ্যতের প্রত্যাশা সূচক’ ৯০.৫। কিন্তু ডিসেম্বর থেকেই ব্যবধান বাড়তে থাকে লাফিয়ে লাফিয়ে। ‘বর্তমান পরিস্থিতি সূচক’ সামান্য বেড়ে ৯০.৭ হয়। কিন্তু ‘ভবিষ্যতের প্রত্যাশা সূচক’ একলাফে ১০ পয়েন্টেরও বেশি বেড়ে পৌঁছয় ১০০.৭-এ। ব্যবধান দাঁড়ায় ১০ পয়েন্টের।
লক্ষণীয়, তত দিনে বিজেপির তরফে ‘প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী’ হিসাবে মোদীর নাম উঠে এসেছে। এর পর মার্চ এবং মে মাসে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সমীক্ষায় ‘বর্তমান পরিস্থিতি সূচক’ এবং ‘ভবিষ্যতের প্রত্যাশা সূচক’-এর ব্যবধান বেড়ে হয় যথাক্রমে ১৫ এবং ২২.৫ পয়েন্ট। পরবর্তী প্রায় এক দশক ধরে বজায় ছিল এই ধারা। কিন্তু গত মে মাসে ‘বর্তমান পরিস্থিতি সূচক’ দাঁড়িয়েছে ৮৮.৫ পয়েন্টে। অর্থাৎ, এক দশক আগেকার অবস্থানে। অন্য দিকে, ‘ভবিষ্যতের প্রত্যাশা সূচক’ রয়েছে ১১৬.৩ পয়েন্টে। অর্থাৎ, ব্যবধান ২৭.৮ পয়েন্টের! ক্রেতাদের বর্তমান সম্পর্কে ধারণা নীচের দিকে, যা স্বাভাবিক বলেই ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু ভবিষ্যতে পরিস্থিতির উন্নতি হওয়া নিয়ে তাঁদের আশা বেশ উঁচুতে।
প্রধানমন্ত্রী মোদীর কার্যকালকে স্পষ্ট ভাবে দু’টি পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে। নোটবন্দির আগে এবং পরে। ২০১৬ সালের নভেম্বরের ওই পদক্ষেপের আগে ‘বর্তমান পরিস্থিতি সূচক’ ধারাবাহিক ভাবে ১০০-র উপরে ছিল। ‘ভবিষ্যতের প্রত্যাশা সূচক’ ছিল ১২০-র আশপাশে। কিন্তু নোটবন্দির পরে ‘বর্তমান পরিস্থিতি সূচক’ ধীরে ধীরে নামতে শুরু করে। কিন্তু ‘ভবিষ্যতের প্রত্যাশা সূচক’-এর উপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি।
‘বর্তমান পরিস্থিতি সূচক’ এক সময়ে নেমে ১০০-র নীচে চলে গেলেও ২০১৯-এর গোড়াতে তা বেড়ে ১০৪ পয়েন্টে পৌঁছয়। অন্য দিকে, ‘ভবিষ্যতের প্রত্যাশা সূচক’ পৌঁছয় নজিরবিহীন ১৩৩.৪ পয়েন্টে। সে বছরের এপ্রিল-মে মাসের লোকসভা নির্বাচনে নজিরবিহীন জয় পায় মোদীর দল বিজেপি।
একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, মোদীর আমলে ‘ভবিষ্যতের প্রত্যাশা সূচক’ সব সময়ই ‘বর্তমান পরিস্থিতি সূচক’-এর থেকে এগিয়ে। অর্থাৎ, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে কোনও ব্যক্তি আর্থিক পরিস্থিতির যে হাল দেখছেন, এক বছর পরের পরিস্থিতি তার চেয়ে ভাল হবে বলে আশা করছেন। এমনকি, হতাশাজনক পরিস্থিতির মধ্যেও আশার আলো খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছেন মানুষ। কোভিড অতিমারির সময় যখন ‘বর্তমান পরিস্থিতি সূচক’ ৫০-এর নীচে নেমে গিয়েছিল, তখনও ‘ভবিষ্যতের প্রত্যাশা সূচক’ ১০০-র উপরে ছিল। ব্যবধান ছিল প্রায় ৬০ পয়েন্টের।
জীবনে নানা সমস্যা এবং সঙ্কট থাকা সত্ত্বেও, ভারতের শহর ও শহর লাগোয়া জনপদগুলির বেশির ভাগ মানুষ ধরে নিয়েছেন যে তাঁদের বর্তমান অসুবিধাগুলি অস্থায়ী। সেটাই তাঁরা প্রমাণ করেছেন ক্রেতা-আস্থা সমীক্ষায়। কোভিড পরবর্তী পর্যায়ে ক্রেতা-আস্থা সংক্রান্ত দু’টি সূচকই আবার বেড়েছে। তবে ঊর্ধ্বমুখী গতি আগামী লোকসভা ভোটে বিজেপিকে জেতানোর মতো কি না, সে প্রশ্ন থাকছেই।
যদি মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে আসে, এবং অর্থনৈতিক বৃদ্ধির পাশাপাশি নতুন কর্মসংস্থানের সম্ভাবনার উন্নতি হয়, তা হলে ‘বর্তমান পরিস্থিতি সূচক’ ২০১৯ সালের পরে আবার ১০০ পেরিয়ে যেতে পারে। যদি তা হয়, তার সুফল পেতে পারে দেশের শাসকদল।