অ-প্রস্তুত: কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে উপস্থিত রাহুল গাঁধী, সনিয়া গাঁধী-সহ কংগ্রেস নেতারা। নয়া দিল্লি, ১৬ অক্টোবর। পিটিআই।
রাহুল গাঁধী হওয়ার ঝক্কি অনেক। সবাই চায়, তিনি সেনাপতি হোন। তিনি নিজে বিবেকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চান। তাঁকে দল সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে বলে। তিনি চান মতাদর্শের প্রশিক্ষণ দিতে। কংগ্রেসের নেতারা বলেন, একমাত্র রাহুল গাঁধীই নরেন্দ্র মোদীকে হারাতে পারেন। রাহুল বলেন, তিনি নরেন্দ্র মোদীর মতাদর্শকে হারাতে চান— যে মতাদর্শ ভারতে বিভাজন তৈরি করে।
শনিবারের বারবেলায় এআইসিসি-র সদর দফতরে কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটিতে যখন সবাই রাহুলকে ফের দলের সভাপতির মুকুট পরাতে চাইছেন, রাহুল তখন মাথা নেড়ে বললেন, ও সব পরে ভেবে দেখা যাবে। আগে দলের নেতাদের সামনে কংগ্রেসের মতাদর্শ স্পষ্ট হওয়া দরকার। কারণ, বিজেপি-আরএসএসের সামনে কংগ্রেসের নেতারা মতাদর্শের প্রশ্নে আপস করে ফেলছেন।
এক কালে যাঁরা তাঁর ডান হাত, বাঁ হাত বলে পরিচিত ছিলেন, সেই জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া, জিতিন প্রসাদরা কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। তার পর থেকেই রাহুল বার বার একটা কথা বলছেন— যাঁরা বিজেপি-আরএসএসকে ভয় পান, তাঁদের কংগ্রেসে দরকার নেই। তাঁরা যেতে পারেন। যাঁরা কংগ্রেসের মতাদর্শে বিশ্বাসী, বিজেপি-আরএসএসের সঙ্গে লড়তে ভয় পাবেন না, শুধু তাঁরাই কংগ্রেসে থাকবেন।
রাহুলকে দেখে সিপিএমের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাটের কথা মনে পড়তে বাধ্য। ২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচনে সিপিএম প্রথম বার বাংলায় ধাক্কা খেল। আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের নেতারা কারাটকে দুষলেন— তাঁর জেদেই আমেরিকার সঙ্গে পরমাণু চুক্তির বিরোধিতায় বামেরা ইউপিএ সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করেছিল। সেই সুযোগে তৃণমূল ও কংগ্রেসের জোট হওয়াতেই তাঁদের হারতে হয়েছে বলে বাম নেতারা কারাটকে দোষারোপ করলেন। ছোটবেলা থেকে ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক’ স্লোগান তোলা কারাট তবু নিজের মতাদর্শে অবিচল। শুরু করলেন দলের ‘শুদ্ধিকরণ অভিযান’। যাঁদের বামপন্থী মতাদর্শে বিশ্বাস নেই, শুধু দল ক্ষমতায় বলে পার্টিতে এসে জুটেছেন, তাঁদের বিদায় করা হোক।
লাভ বিশেষ হয়নি। ২০১১-তে পশ্চিমবঙ্গে বাম দুর্গের পতন হল। প্রকাশ কারাট এ বার ‘মতাদর্শগত দলিল’ তৈরি করলেন— বামপন্থী মতাদর্শটা আবার ঝালিয়ে নিতে হবে। ক্ষমতায় থেকে বিচ্যুতি হয়েছে। তা শুধরে নিতে হবে। চিনের ধাঁচে এ দেশে শিল্পায়ন চলতে পারে না। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি চলবে ভারতীয় পরিস্থিতি মেনে।
এক দশক পরে সিপিএমের সেই ‘শুদ্ধিকরণ অভিযান’ ও ‘মতাদর্শগত দলিল’-এর কতখানি ফল মিলেছে, তা সকলেরই জানা। এ বার কংগ্রেসের পুনরুত্থানের জন্য রাহুল গাঁধীও সেই মতাদর্শের কথাই বলছেন। পর পর দু’বার লোকসভা নির্বাচনে হার ও সিংহভাগ রাজ্যে ক্ষমতা হারিয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া দলের জন্য রাহুলের দাওয়াই হল, বিজেপির ‘উগ্র জাতীয়তাবাদ’-এর মোকাবিলায় ‘সাংবিধানিক জাতীয়তাবাদ’-এর কথা বলা। আরএসএসের হিন্দুত্ববাদের জবাবে সংবিধানে ভারত সম্পর্কে যে ভাবনা রয়েছে, তা তুলে ধরা।
সিপিএম তবু মতাদর্শ-নির্ভর পার্টি। বিজেপির মতোই। কিন্তু কংগ্রেস মতাদর্শের প্রশ্নে বরাবরই নমনীয়। মুখে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির বুলি। আদতে সংখ্যালঘু তোষণের রাজনীতি। দরকার পড়লে নরম হিন্দুত্বও। বিজেপি কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু তোষণের অভিযোগ তুলেই মেরুকরণের লাভ কুড়িয়েছে। এখন জনসভায় রাহুলের ‘জয় মাতা দি’ ধ্বনি বা প্রিয়ঙ্কার মন্দিরে পুজো দেওয়ার লাভও বিজেপিই পাচ্ছে। এ বার বিজেপি বিনায়ক দামোদর সাভারকরের মহিমা বর্ণনা করছে। কংগ্রেস যত সেই তরজায় জড়াবে, ততই বিজেপির লাভ।
একই ভাবে রাহুল শুদ্ধিকরণের কথা বললেও, কংগ্রেস কোনও মতেই বিজেপি বা সিপিএমের মতো শৃঙ্খলাবদ্ধ ক্যাডারভিত্তিক পার্টি নয়। নিচুতলার ক্যাডার নয়, কংগ্রেসের আসল শক্তি রাজ্যের প্রভাবশালী নেতারা। তাঁরাই ভোট টানেন। কংগ্রেস অনেকটা ‘সতেরও মা, অসতেরও মা’। রাহুলের মতোই কংগ্রেসের একটা বড় অংশের নেতা বাপ-ঠাকুর্দার পদাঙ্ক অনুসরণ করে রাজনীতিতে এসেছেন। কেউ প্রথমেই ছাত্র, যুব সংগঠনের নেতা হয়েছেন। কেউ আবার সরাসরি বিধায়ক, সাংসদ, পঞ্চায়েত প্রধান বা পুরসভার চেয়ারম্যানের পদে বসেছেন। এখন ক্ষমতার আঁচ ধরে রাখতে বিজেপির দিকে পা বাড়াচ্ছেন।
কংগ্রেসের এই সংস্কৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে রাহুল ছাত্র, যুব সংগঠনে গণতন্ত্র নিয়ে আসার চেষ্টা করেছিলেন। সনিয়া গাঁধী, মনমোহন সিংহ তাঁকে ইউপিএ সরকারের মন্ত্রী হয়ে প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা কুড়োতে বলেছিলেন। তাতে কান না দিয়ে ছাত্র-যুব সংগঠনের নির্বাচন নিয়ে সময় ব্যয় করেছেন। হাই কমান্ড সংস্কৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে লোকসভা, বিধানসভার ভোটে কংগ্রেস কর্মীরাই প্রার্থী বাছাই করবেন, এমন ব্যবস্থা চালুর চেষ্টা করেছিলেন তিনি।
প্রকাশ কারাটের মতো নীতিবাদী সিপিএম নেতারা বরাবরই ভেবে এসেছেন, শুধু মতাদর্শ আঁকড়ে থাকলেই দলের শ্রীবৃদ্ধি নিশ্চিত। ভোটে জেতার জন্য তাড়াহুড়োর কিছু নেই। একই ভাবে রাহুলও ভাবেন, তাঁর মতাদর্শে আস্থার এতটাই জোর যে, আর কিছুই করার দরকার নেই। মানুষ এক সময় নিজে থেকেই নরেন্দ্র মোদীর থেকে সরে এসে তাঁর পিছনে দাঁড়াবে। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা অরবিন্দ কেজরীবাল যে ভাবে পশ্চিমবঙ্গে, দিল্লিতে নিজেদের বিজেপির বিকল্প হিসাবে তুলে ধরতে পেরেছেন, রাহুল তা পারেননি। মমতা, কেজরীবালের যে নিজস্ব ভোটব্যাঙ্ক রয়েছে, অন্ধ ভক্ত রয়েছে, রাহুলের তা নেই।
এ কথা ঠিক যে, মমতা বা কেজরীবালের বিজেপি-বিরোধিতায় কতখানি আসল, কতখানি খাদ, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ কথাও ঠিক যে, সেই তুলনায় রাহুল গাঁধী নিরবচ্ছিন্ন ভাবে মোদী সরকারের ব্যর্থতা, বিজেপি-আরএসএসের সাম্প্রদায়িক নীতি নিয়ে যথাযথ প্রশ্ন তুলে গিয়েছেন। কিন্তু দলের নেতৃত্ব গ্রহণ নিয়ে রাহুলের ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ মনোভাব তাঁর রাষ্ট্রনেতা হয়ে ওঠার সম্ভাবনাতে সংশয়চিহ্ন ঝুলিয়ে রেখেছে। রাহুল ভুলে যাচ্ছেন, নরেন্দ্র মোদী ২০১৪-র ভোটে জিতে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন পরে— আগে তাঁকে দলের মধ্যে লালকৃষ্ণ আডবাণী, সুষমা স্বরাজদের সামলে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হওয়ার লড়াইয়ে জিততে হয়েছিল। প্রথমে তিনি দলের লাগাম ধরেছেন। তার পর ভোটে জিতেছেন।
রাহুল ভাবছেন উল্টো। আগে তিনি দলকে নিজের মতো সাজাবেন। তার পর ফের সভাপতির দায়িত্ব নেবেন। হয়তো ২০২২-এর শেষে। তার আগে দলকে নতুন করে মতাদর্শে দীক্ষিত করবেন। মনে হচ্ছে, তিনি যেন ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচন নিয়ে না ভেবে ২০২৯-এর প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
রাহুল গাঁধী হওয়ার ঝক্কি হল, খেলতে নামলে তাঁকে হয় ‘ক্যাপ্টেন’ হতে হবে, নয়তো অবসর নিতে হবে। গাঁধী পরিবারের উত্তরসূরির সামনে কংগ্রেসে আর কোনও বিকল্প নেই। নীতিবাগীশ হয়ে বসে না থেকে তাঁকে কোন রাজ্যে কাকে, কোথায় প্রার্থী করা হবে, তা ঠিক করতে হবে। কোথায় টাকার বিনিময়ে কংগ্রেসের নেতারা টিকিট বিলি করছেন, সেই পাঁকও ঘাঁটতে হবে। আদর্শের ঘাটতি থাকলেও তাঁকে কংগ্রেস নেতাদের দলত্যাগ আটকাতে হবে। কোভিডের বিপদ বা অর্থনীতিতে নোট বাতিল-জিএসটির ধাক্কা নিয়ে তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী মিলে গিয়েছে বলে রাহুল প্রায়ই গর্ব করেন। তিনি নিজেকে ‘দূরদৃষ্টিসম্পন্ন’ হিসাবে প্রমাণ করতে পারেন। কিন্তু ‘ভোটকুশলী’ হতে হলে তাঁকে রোজকার রাজনীতিতেও মাথা ঘামাতে হবে।
কংগ্রেস সাত বছর কেন্দ্রে ক্ষমতায় নেই। রাহুল গাঁধী কোনও ভাবেই ইউপিএ-সরকারের সনিয়া গাঁধী নন, যিনি সরকারের ‘পথপ্রদর্শক’ হিসাবে কাজ করবেন। পথেও তাঁকেই নামতে হবে। এবং প্রতি দিন। তিনি শুধুই কংগ্রেসের বিবেক হয়ে বসে থাকতে পারেন না, যেমনটা এক সময় মোহনদাস গাঁধী ছিলেন। গাঁধীজির সেবাগ্রাম আশ্রমে কংগ্রেস নেতাদের জন্য তিনি পাঠশালা খুলতে পারেন। কিন্তু রাহুল গাঁধীকে বুঝতে হবে, তিনি শুধুই রাহুল। গাঁধীজি নন।