সব মনীষীরই কিছু কথা পুরনো হয়ে যায়, আবার কিছু কথা কালাতিক্রমী হয়ে বেঁচে থাকে। বা হয়তো কোনও উক্তির একটি দিকের উপর সময়ের ধূলির আস্তরণ পড়ে তা মলিন হয়ে যায়, আবার একই উক্তির অন্য একটি দিক সমস্ত সময়ের দূরত্ব পেরিয়ে আমাদের সময়ে বেঁচে থাকে।
প্রতি বছরই রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে তাঁকে পড়তে গিয়ে এই কথাগুলো নতুন করে মনে আসে। এ বছরে তাঁর জন্মদিনের ঠিক আগেই দেশব্যাপী অতিমারির মধ্যে দীর্ঘ আট দফায় বিভক্ত নির্বাচনে এক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিলেন পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। যে দল এই রাজ্যে ‘শিল্পোন্নতি’র সঙ্গে সঙ্গে ধর্মীয় মেরুকরণ করতে চেয়েছিল, তাদের আসনসংখ্যা বাড়লেও রাজ্যবাসী কিন্তু সাধারণ ভাবে যিনি ‘বাংলার মেয়ে’ হিসেবে নির্বাচনী প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন, তাঁকে ও তাঁর দলীয় প্রার্থীদের প্রচুর সংখ্যক আসনে জয়ী করে বরণ করে নিয়েছেন। বলা যায়, পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির, হিংসা, কর্মসংস্থান করতে না পারা ইত্যাদি অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও এই প্রদেশের মানুষ সাধারণ ভাবে ধর্মীয় মেরুকরণের বার্তা প্রত্যাখ্যানই করেছেন। অন্তত এ বারের মতো।
অনেক সময় রবীন্দ্রনাথ পড়তে গিয়ে ভাবি: ভারতের তথা বাংলায় গণতন্ত্রের এই রাষ্ট্রিক রূপ এবং নির্বাচনী প্রতিযোগিতা দেখলে কেমন লাগত তাঁর? একটি কথা প্রত্যয়ের সঙ্গে বলা যায়। বাংলার বেশির ভাগ মানুষ যে ধর্মীয় মেরুকরণের প্রস্তাবে কান পাতেননি, এই সংবাদে খুশি হতেন তিনি। স্বদেশি যুগে, ১৩১১ বঙ্গাব্দে— যখন তিনি ব্রাহ্মণ্য হিন্দুধর্মের দিকে একটু ঝুঁকে পড়েছেন— রচিত ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধেও তিনি ‘হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সদ্ভাব স্থাপন’ করার কথা বলে গিয়েছেন। কিন্তু এই ভোটরঙ্গ, রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ে এই মাতামাতি, হানাহানি, ভারতীয় গণতন্ত্রের এই উৎসব? এ সব রবীন্দ্রনাথের কেমন লাগত?
আপাত ভাবে মনে হয়, একটু ফাঁপরেই যেন পড়তেন তিনি। আধুনিক রাষ্ট্র বস্তুটিকে কোনও দিন দেশজ বলে ভাবেননি রবীন্দ্রনাথ। ভাবতেন— রাষ্ট্র, গভর্নমেন্ট, সব ইংরেজ-আরোপিত প্রতিষ্ঠান। ভারতের নিজস্ব কোনও সত্তার ভিতরে তাদের কোনও শিকড় নেই। ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধের পরিশিষ্টে লিখছেন: “য়ুরোপের যেখানে বল আমাদের সেখানে বল নহে।... য়ুরোপের শক্তির ভাণ্ডার স্টেট অর্থাৎ সরকার। সেই স্টেট দেশের সমস্ত হিতকর কর্মের ভার গ্রহণ করিয়াছে... আমাদের দেশে কল্যাণশক্তি সমাজের মধ্যে।... এই জন্য সমাজের স্বাধীনতাই যথার্থভাবে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা।” বস্তুত এই অবস্থান থেকে কোনও দিন সরে আসেননি রবীন্দ্রনাথ। ‘আত্মশক্তি’ কথাটা যেন ছিল তাঁর রাজনৈতিক স্লোগান। ১৩৩৬ সালেও আত্মশক্তি ও সমূহ গ্রন্থে সঙ্কলিত একটি লেখায় লিখছেন, “আমি প্রথম থেকেই রাষ্ট্রীয় প্রসঙ্গে এই কথাই বারম্বার বলেছি, যে কাজ নিজে করতে পারি সে কাজ সমস্তই বাকি ফেলে, অন্যের ওপরে অভিযোগ নিয়েই অহরহ কর্মহীন উত্তেজনার মাত্রা চড়িয়ে দিন কাটানোকে আমি রাষ্ট্রীয় কর্তব্য বলে মনে করিনে।... স্বরাজ হাতে পেলে আমরা স্বরাজের কাজ নির্বাহ করতে পারব তার পরিচয় স্বরাজ পাবার আগেই দেওয়া চাই।”
১৯২৯ সালে যখন এই লাইনগুলো লিখছেন রবীন্দ্রনাথ, তখনও স্বরাজ বা স্বাধীনতা আসতে প্রায় দু’দশক বাকি। ১৯৪১ সালে তাঁর মহাপ্রয়াণের সময়েও দেশভাগ অকল্পনীয়। বাংলাদেশের ও ভারতের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গেয় গান দু’টির কথা স্মরণ করলেই সে কথা বোঝা যায় যে, অখণ্ড ভারতই তাঁর চোখে লেগে থাকত। ‘আমার সোনার বাংলা’-য় যে বাংলার বর্ণনা, সেই বাংলা তো শুধু বাংলাদেশ নয়, তাতে পশ্চিমবঙ্গও ধরা আছে। তেমনই যে ‘সিন্ধু’ প্রদেশের কল্যাণকামনা করে তিনি ‘ভারতভাগ্যবিধাতা’র বন্দনা করেছিলেন, তা এখন পাকিস্তানের অংশ। স্বরাজকে সমাজের আত্মশক্তির প্রকাশ ভেবে তার জন্য জাতীয় প্রস্তুতির উদ্ধৃত কথাগুলো তিনি যখন লিখেছিলেন, তখন তাঁর পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না যে, দ্বিতীয় একটা বিশ্বযুদ্ধ হবে, এবং তা শেষ হতে না হতেই ‘স্বরাজ’ নামক বস্তুটি হুড়মুড় করে ভারতের ঘাড়ে এসে পড়ে দেশটাকে দ্বিখণ্ড করে, এই ভূখণ্ডের একটি ভাগে সর্বজনীন ভোটাধিকার চালু করে নির্বাচনী গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করে যাবে। রবীন্দ্রনাথ যা-ই বলুন, সেই গণতন্ত্র ঐতিহাসিক ভাবে আরোপিতই হোক আর আমাদের প্রস্তুতির যত অভাবই থাকুক, আজ যে ভারতের জাতীয় জীবন এই গণতন্ত্রের পাঁচ-সালা ছন্দ ধরে উদ্বর্তিত হচ্ছে, তা অস্বীকার করি কী করে?
তা হলে প্রশ্ন ওঠে: রবীন্দ্রনাথের ‘স্বদেশী সমাজ’-এর চিন্তা, রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে সমাজকে আত্মশক্তি-নির্ভর করার কথা, এই সব চিন্তা কি আজ সম্পূর্ণ অচল? তাঁর নিজের সময়েই বা এই চিন্তা কতটা কার্যকর হয়েছিল? অথচ সারা জীবন নিজের বিশ্বাসে স্থির থেকে গিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ! গাঁধীর যেমন হিন্দ স্বরাজ গ্রন্থটি, রবীন্দ্রনাথের তেমনই ‘স্বদেশী সমাজ’ ও আত্মশক্তি-বিষয়ক প্রবন্ধগুলি। তাঁর রাজনৈতিক চিন্তার সার কথা ধরা আছে এখানে। রাজনৈতিক চিন্তক হিসেবে রবীন্দ্রনাথের কাছে আমরা কী পাই? আজকের গণতান্ত্রিক জীবনে কি কিছু নেওয়ার আছে ‘স্বদেশী সমাজ’ থেকে?
রবীন্দ্রচিন্তার কতকগুলো দিককে খারিজ করা আজ আপাত ভাবে সহজ। রবীন্দ্রনাথ বরাবরই অন্ত্যজ মানুষের প্রতি সম্পূর্ণ সহানুভূতিশীল ছিলেন, অস্পৃশ্যতা-বিরোধী রচনাও লিখেছেন। হিন্দুসমাজের আচার-বিচারের তীব্র সমালোচনা করেছেন সারা জীবন। তবু এ কথা মানতেই হয় যে, ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধে একটি ব্রাহ্মণ্য হিন্দুধর্মের চিন্তা আছে, যা আজ উত্তর-অম্বেডকর যুগের মানুষের পক্ষে মেনে নেওয়া অসম্ভব। দ্বিতীয়ত, বিদেশি সরকারের আমলে সরকার ও সমাজের মধ্যে যতটা ব্যবধান দেখেছেন রবীন্দ্রনাথ, আজ সেই দূরত্ব নেই। সরকার আমার কেউ নন, গৌরী সেন— এই ধরনের মনোভাব যে আজ একেবারে দেখি না, তা নয়। আজকে যখন আমরা সরকারি কর ফাঁকি দেবার চেষ্টা করি, তখন নিশ্চয়ই সরকারকে নিজের বলে ভাবি না। কিন্তু যে সরকার সংরক্ষণের নীতি নির্ধারণ করে, স্বাস্থ্যসাথী, কন্যাশ্রী ইত্যাদি ব্যবস্থা চালু করে, তাকে সমাজের বাইরের বলেই বা ভাবি কী ভাবে?
রবীন্দ্রনাথের চিন্তার যে অংশটুকু আপাত-গোলমেলে ঠেকলেও যথেষ্ট ভাবায়, তা তাঁর এই ধারণা যে, ‘আত্মশক্তি’ অর্জন করতে গেলে— তিনি ‘পোলিটিক্যাল’ কথাটিও ব্যবহার করেছেন— সমাজকে তার বিভিন্ন স্তরে কিছু কিছু মানুষকে ‘সমাজপতি’ হিসেবে পেতে হবে: “স্বদেশকে একটি বিশেষ ব্যক্তির মধ্যে আমরা উপলব্ধি করিতে চাই। এমন একটি লোক চাই, যিনি আমাদের সমস্ত সমাজের প্রতিমাস্বরূপ হইবেন। তাঁহাকে অবলম্বন করিয়াই আমরা আমাদের বৃহৎ স্বদেশীয় সমাজকে ভক্তি করিব, সেবা করিব।” বিষয়টা ভাবায় এই কারণেই যে, গণতন্ত্রের ভিত্তি এমন (অনির্বাচিত) সমাজপতি-শাসিত ব্যবস্থায় হতে পারে না। এমন প্রস্তাব আজকে অচল ঠেকবে। আবার উল্টো দিকটাও আছে। গণতন্ত্রেও অনেক সময়েই আমরা নেতৃত্বে তাঁকেই দেখতে চাই, যিনি সমাজের কোনও সম্মিলিত বাসনা, আকাঙ্ক্ষা, বা চিন্তার রূপকার হিসেবে নিজেকে হাজির করতে পারেন। মোদী যখন গুজরাতে ‘হিন্দুহৃদয়সম্রাট’ বলে বা ২০১৪ সালে ‘বিকাশপুরুষ’ হিসেবে ভোট পেয়েছিলেন, তখন নিশ্চয়ই অনেক মানুষ তাঁকে কোনও সামূহিক আকাঙ্ক্ষার প্রতিমূর্তি হিসেবে দেখেছেন। অথবা সাম্প্রতিক ভোটে মমতাকে ‘বাংলার মেয়ে’ হিসেবে দেখা। অনেকেরই নিশ্চয় মনে হয়েছিল যে, বাংলার ও বাঙালির সাধারণ সংস্কৃতি বলতে আমরা যা বুঝি, তার আসন্ন বিপদ— তাই তাঁরা অন্যান্য বিভেদ ভুলে বাংলার মেয়েকে জয়ী করেছেন।
কিন্তু শাসক ও শাসিতের এই মিলন প্রায়শই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। ভোটের মুহূর্তে নেতা বা নেত্রীকে এই ভাবে দেখলেও ভোট-পরবর্তী অবস্থায় অনেক সময়ই এই ধরনের সম্পর্ক টেকে না। তথাকথিত ‘সমাজ’ আবার নানান দ্বন্দ্বে খণ্ডিত হয়ে যায়। অথচ রবীন্দ্রনাথ একটা জরুরি প্রশ্ন তুলেছেন। শাসনের সঙ্গে সমাজের স্থায়ী সম্পর্ক কী হবে? আমরা রবীন্দ্রনাথের সময়ের মানুষ নই। বিদেশি শাসকের মুখাপেক্ষী না থেকে তিনি নিজস্ব সমাজের মানুষের নেতৃত্বে সামাজিক প্রয়োজনের দিকে নজর ফেরাতে বলেছিলেন। কিন্তু আজ রাষ্ট্র বিদেশির নয়, দেড়শো-দু’শো বছর বাদে ‘স্টেট’কে আরোপিতও বলা যায় না। আমাদের এই রাষ্ট্রব্যবস্থার শিকড় উত্তর-মোগল ও ব্রিটিশ যুগে চারানো আছে। আজ রাষ্ট্র নিয়েই ঘর করা। এখানে ভাবতে হয়, সমাজের সঙ্গে রাষ্ট্রের স্থায়ী ও কল্যাণকর সম্পর্ক কী ভাবে তৈরি হবে?
এই সম্পর্ক স্থায়ী ভাবে কল্যাণকর হতে গেলে ন্যূনতম প্রয়োজন পড়ে এটি নিশ্চিত করার যে, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের হাতে সুশাসন কায়েম করার ও চালু রাখার জন্য যে সব ‘যন্ত্র’ থাকে— যথা পুলিশ, মিলিটারি, আদালত, ও আমলাতন্ত্র— এগুলি ক্ষমতাসীন কোনও রাজনৈতিক দলের হাতে নিছক সঙ্কীর্ণ ও দলীয় স্বার্থসিদ্ধির অস্ত্রমাত্র হয়ে না-দাঁড়ায়। যে কোনও রাজনৈতিক দলের সীমাহীন প্রতিপত্তি থেকে সমাজকে রক্ষা করা প্রয়োজন। দুর্ভাগ্যবশত, এটা ভারতে হয়নি। বরং গত কয়েক বছরে দেখেছি উল্টো প্রবণতাই বৃদ্ধি পেয়েছে।
সমাজপতির প্রয়োজন নেই। সেই আইডিয়াটাও আজ দূরের। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্রচিন্তার প্রশ্নের ভিতরে যে সব কল্যাণকর ভাবনা ছিল, তার সবটাই যে ইতিহাসের ধুলোয় ধূসরিত হয়ে গিয়েছে, এমনটিও নয়।
ইতিহাস বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো