আমি নিট পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি। সে কারণে নিউ টাউনে কোচিং সেন্টারে সপ্তাহে চার দিন ক্লাস করতে যাই। ক্লাস শেষ করে ফিরতে ফিরতে শেষ ট্রেনটাই কোনও মতে ধরতে পারি। ক্যানিং আসতে আসতে ট্রেন প্রায় ফাঁকা হয়ে যায়। স্টেশনে নেমে কাউকেই সে ভাবে পাই না। প্রায় ১২ কিমি রাস্তা পেরিয়ে বাড়ি। এতটা রাস্তা একা ফিরতে ভয় করে। কোনও দিন বাবা, কোনও দিন দাদা স্টেশনে আমার জন্য অপেক্ষা করেন।”
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার হেড়োভাঙা গ্রামের এক তরুণীর কথাগুলি পড়লাম গত শুক্রবার, এই সংবাদপত্রের পাতায়। শেষ লোকালে ক্যানিংয়ে ফেরা কয়েক জনের অভিজ্ঞতার সূত্র ধরে লেখা হয়েছে প্রতিবেদনটি। শ্রমজীবী পরিবারের মেয়ে তাঁরা, বড় অর্থে নিজেরাও সকলেই শ্রমজীবী। কেউ ওই তরুণীর মতোই প্রচণ্ড পরিশ্রম করে পড়াশোনা করেন, কেউ বেসরকারি সংস্থার সাধারণ কর্মী, কেউ হয়তো কাজ করেন দোকানবাজারে, কেউ হয়তো বা গৃহস্থের বাড়িতে, আরও কত কাজেই তো নিয়মিত শহরে যেতে হয়। ফিরতে রাত হয়ে যায়। আর রাত হওয়া মানেই চিন্তা। নিরাপত্তার চিন্তা।
সে-চিন্তা দূর করার দায়িত্ব যাঁদের? পুলিশ? প্রশাসন? ওই প্রতিবেদনেই পড়ি তাঁদের হাতে থাকা নিরাপত্তা ব্যবস্থার দু’এক ঝলক বিবরণ। যথা, ক্যানিং থানার আওতায় প্রায় ২০৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে রাতে সচরাচর পুলিশি টহলের মাত্র দু’টি গাড়ি থাকে। প্রয়োজনের তুলনায় কম, নিশ্চয়ই, তবে টহলদারি ঠিকঠাক চালালে এইটুকু দিয়েই অনেকখানি কাজ করা যায়। কিন্তু যা থাকে, তা-ও কি আসলে থাকে? সাংবাদিক লিখেছেন, “দিন কয়েক আগে এক জন মাত্র আরপিএফ কনস্টেবলের দেখা মিলল স্টেশন চত্বরে। স্টেশনে থাকা আরপিএফের আউটপোস্টও তালা বন্ধ।” ফাঁড়ির দরজা খোলা থাকলেও সেখানে কেউ থাকত কি না, থাকলেও কতটা নিশ্চিন্ত বোধ করা যেত, বলা কঠিন। খাতায় কলমে নিরাপত্তার যে বন্দোবস্ত, তার কত শতাংশ বাস্তবে কাজ করে, কে রাখে খবর তার? শেষ ট্রেন থেকে নামা এক কর্মী-নারী অল্প কথায় জানিয়ে দেন সার সত্যটি, “পুলিশও জানে, বিপদ কিছু ঘটলে তাদের সে ভাবে কিছুই করার থাকবে না। কিছু ঘটবে না— মনে হয় পুলিশ কর্তারা নিজেরাও নিজেদের এ ভাবে প্রবোধ দেন। আর আমার মতো মহিলাদের তো এত রাতে উপরওয়ালাই ভরসা।”
এ ঘোর কলিতে কেবল উপরওয়ালার ভরসায় থাকা চলে না, সে কথা তো জানাই আছে। ভরসা বরং পাশে থাকা সহযাত্রী ও সহনাগরিকরা, যাঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই সুস্থ স্বাভাবিক ঠিকঠাক মানুষ, আজও। কিন্তু অন্য রকম মানুষও আছে, আছে ভয় আর ভাবনা, আছে নিত্যসঙ্গী উদ্বেগ। তাই শেষ অবধি কর্মী-মেয়েদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হয় তাঁদের নিজেদেরই। ব্যবস্থা আর কী? যতটা পারা যায় ঘাড় শক্ত করে চোয়াল কঠিন রেখে বাসে ট্রেনে অটোয় টোটোয় ওঠা, রাতে ফাঁকা রাস্তায় যথাসম্ভব দল বেঁধে চলাচল করা, আর বাড়ির লোককে, কাছের লোককে বলা স্টেশনের বাইরে কিংবা বাসরাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়াতে। শ্রমজীবী মেয়েদের এই ভাবেই বাঁচতে হয়, লড়তে হয়। রাস্তাঘাটে, কর্মক্ষেত্রে, হাটেবাজারে, সর্বত্র। কোনটা যে বাঁচা আর কোনটা যে লড়া, আলাদা করে বোঝাই দুষ্কর।
এই বারোমাস্যায় কি এ-বার কোনও পরিবর্তন ঘটবে? শ্রমজীবী মেয়েদের দৈনন্দিন নিরাপত্তার পরিবেশ এবং পরিকাঠামোয় কোনও উন্নতি ঘটবে কি? তাঁদের জীবন ও জীবিকার পরিসর, বিশেষত তাঁদের নিত্য যাতায়াতের পথে এবং কাজের জায়গায় অস্বস্তি, লাঞ্ছনা ও দুশ্চিন্তার কারণগুলি অন্তত কিছুটা কি কমবে? আর জি কর হাসপাতালের পৈশাচিক ঘটনাটির পরে কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে যে সব কথাবার্তা ও উদ্যোগ-আয়োজন চলছে, সেই পরিপ্রেক্ষিতেই এ-প্রশ্ন উঠে আসে।
৯ অগস্টের পরে, প্রায় তিন সপ্তাহের লাগাতার আলোড়ন থেকে উঠে এসেছে অনেক গুরুতর প্রশ্ন, অভিযোগ, দাবিদাওয়া, সওয়াল-জবাব; উঠে এসেছে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থহীন বাগ্বিতণ্ডা, চিৎকৃত আস্ফালন, আমরা-বনাম-তোমরা; উঠে এসেছে অলজ্জ আত্মপ্রচার আর অসার পরচর্চার অন্তহীন প্রদর্শনী। অস্বাভাবিক কিছু নয়। বহু মত, বহু স্বর, বহু স্বার্থের সমুদ্রমন্থন অবধারিত নিয়মেই তুলে আনে অমৃত, গরল এবং অন্যান্য পানীয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই জনজাগরণের ফলে সমাজের চিন্তা ও চেতনা বদলাবে কি না, রাজনীতির চরিত্রে কিছুমাত্র নতুনত্ব দেখা দেবে কি না, দুঃশাসনের অচলায়তনে সামান্যতম টোল পড়বে কি না, সে বড় কঠিন প্রশ্ন। ভয় হয়, এত কলরব, এত হুঙ্কার, এত স্লোগান শেষ পর্যন্ত আমাদের বিস্মৃতি আর ঔদাসীন্যের কল্যাণে অচিরেই চিরপরিচিত কৃষ্ণগহ্বরে বিলীন হয়ে যাবে।
কৃষ্ণগহ্বরের একটি সুস্পষ্ট নমুনা ইতিমধ্যেই আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে। উপস্থিত করেছে রাজ্য প্রশাসন নিজে। সেই প্রশাসন যাঁরা চালাচ্ছেন, তাঁরা প্রায় তেরাত্তির না পোহাতেই মেয়েদের ‘সুরক্ষিত’ করার তাড়নায় যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন: নির্দেশিকা জারি করে বলে দিয়েছেন যে রাতের দিকে নারী-কর্মীদের কাজে বেরোনো যথাসম্ভব কমানো চাই, একাধিক মেয়ে এক সঙ্গে কাজ করলে ভাল, ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ— মেয়েদের বাইরে স্বাধীন ভাবে কাজ করা নিয়ে যখন এত সমস্যা, এত অশান্তি, তখন বরং ছেঁটে দাও তাদের কাজের সুযোগ, নিয়ন্ত্রণ করো তাদের কাজের স্বাধীনতা। সরকারি আধিকারিকের পরিশীলিত উচ্চারণে ঘোষিত সুসমাচারে নিরাপত্তার নববিধানগুলি শুনে কেবল ক্রোধ নয়, বিবমিষার উদ্রেক হয়। চিনে নিতে ভুল হয় না এই বিধানের উৎসটিকে। তার নাম পিতৃতন্ত্র। পূজার ছলে, ক্ষমতার বলে কিংবা নিরাপত্তা বিধানের কৌশলে মেয়েদের আড়ালে রাখার, বেঁধে রাখার, পিছিয়ে রাখার সেই তন্ত্রটি রাজা রানি মন্ত্রী সান্ত্রি উজির নাজির পারিষদবর্গের মজ্জায় মজ্জায় ঢুকে বসে আছে, ব্যক্তিপরিচয়ে তাঁরা পুরুষ না হয়ে নারী হলেও কিস্সু যায় আসে না।
এই শাসনতন্ত্রের মুখের উপরেই তো বিরাশি সিক্কার একটি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল সেই মধ্যরাত্রির ঘোষণা: মেয়েরা রাত দখল করো। প্রথমে হয়তো আমরা অনেকেই তার মর্মার্থ পুরোপুরি বুঝতে পারিনি, ভেবেছি— ৮-৯ অগস্টের পিশাচলীলাটি তো নিছক কর্মী-মেয়েদের নিরাপত্তার ব্যাপার নয়, একটি বিশেষ কর্মক্ষেত্রের নিজস্ব বিভীষিকার ফল, হয়তো বা ওই ধর্ষণ এবং হত্যা এক বিপুল দুর্নীতি এবং গভীর চক্রান্তের পরিণাম। কিন্তু দেখতে দেখতে সমাজের বুক থেকে গর্জে ওঠা ওই আহ্বানে আদিগন্ত সাড়া দিয়ে এই রাজ্যের অগণন নারী এবং তাঁদের সঙ্গী পুরুষেরা বুঝিয়ে দিলেন, নির্দিষ্ট একটি ঘটনার সীমা অতিক্রম করে একটা গোটা সমাজ এবং তার আশ্রিত রাজনীতিকে প্রতিস্পর্ধার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে সেই সমাজ নিজেই। নারীকে কেবল আপন ভাগ্য নয়, সমাজজীবনের প্রতিটি পরিসরে আপন সমানাধিকার এবং সমমর্যাদা জয় করে নেওয়ার অধিকার দিতে হবে— এটাই সেই প্রতিস্পর্ধার সারাৎসার।
আর ঠিক সেই কারণেই এই আহ্বানকে প্রসারিত করা দরকার তার ব্যাপ্তিতে এবং গভীরতায়, আড়ে ও বহরে। এক দিকে, রাত দখলের প্রতীকী অর্থে সীমিত না থেকে অধিকারের দাবিকে প্রসারিত করা চাই জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে, অর্ধেক আকাশের অসীম ভুবনে— আকাশ সীমাহীন হলে অঙ্কের নিয়মেই তার অর্ধেকও কিন্তু সীমাহীন! আর অন্য দিকে, এবং এটাই সবচেয়ে বড় কাজ, নাগরিক সমাজের সীমিত পরিসর ছেড়ে সমান অধিকার ও মর্যাদার দাবিকে নিয়ে যাওয়া চাই সমস্ত শ্রমজীবী মেয়ের দৈনন্দিন জীবনে ও জীবিকায়। শ্রমজীবী মেয়েরা যে এই অভিযানের শরিক হতে প্রস্তুত ও আগ্রহী, তার নানা প্রমাণ ১৪-১৫ অগস্টের মধ্যরাত্রি থেকেই আমাদের চোখের সামনে বারংবার উন্মোচিত হয়েছে। নাগরিক সমাজ যদি তাঁদের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় এবং তাঁদের সংগ্রামের সঙ্গে নিজেদের কর্মকাণ্ডকে জড়িয়ে নেয়, তাঁদের দৈনন্দিন থেকে উঠে আসা দাবিগুলিকে সেই কর্মকাণ্ডের সামনে নিয়ে আসতে পারে, তা হলে এই আন্দোলন এক অ-পূর্ব জোর পাবে। নাগরিক সমাজের জনজাগরণ যদি লোকসমাজের গণজাগরণে পরিণত হয়, তাকে দমিয়ে দেওয়ার সাধ্য হবে না কোনও সামাজিক বা সরকারি পিতৃতন্ত্রের এবং তার মহানায়ক কিংবা মহানায়িকাদের। একটি মর্মান্তিক এবং ভয়াবহ ঘটনাকে উপলক্ষ করে যে নতুন অভিযান শুরু হয়েছে, তার যথার্থ গন্তব্য তাই আমাদের স্বভূমির প্রতিটি বিন্দুতে প্রসারিত। যেমন মধ্যরাত্রির ক্যানিং স্টেশনে, তেমনই অন্য সময়েও, অন্যত্রও। সর্বদা, সর্বত্র।