কিন্তু আদালত রাজনীতির বিকল্প হতে পারে না
Kanwar Yatra

আগে বলো কী তোমার নাম

নতুন একটি ছলের নাম ‘কাঁওয়ার যাত্রা’। ফি বছর শ্রাবণ মাসে ভোলেনাথ ওরফে শিবের মাথায় জল ঢালার জন্য ‘কাঁওয়ার’ অর্থাৎ পুষ্পশোভিত বাঁক কাঁধে নিয়ে উত্তর ভারতের নানা অঞ্চলের কয়েক কোটি মানুষ এই অভিযানে শরিক হন।

Advertisement

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ৩০ জুলাই ২০২৪ ০৯:০২
Share:

অভিযান: কাঁওয়ার যাত্রার পথের ধারে নামাবলি সম্বলিত দোকানপাট। মুজফ্ফরনগর, ২০ জুলাই, ২০২৪। ছবি: পিটিআই।

দুরাত্মার সত্যিই ছলের অভাব হয় না। নতুন একটি ছলের নাম ‘কাঁওয়ার যাত্রা’। ফি বছর শ্রাবণ মাসে ভোলেনাথ ওরফে শিবের মাথায় জল ঢালার জন্য ‘কাঁওয়ার’ অর্থাৎ পুষ্পশোভিত বাঁক কাঁধে নিয়ে উত্তর ভারতের নানা অঞ্চলের কয়েক কোটি মানুষ এই অভিযানে শরিক হন। হরিদ্বার এই যাত্রাপথের প্রধান লক্ষ্য, প্রায় এক মাস ধরে সেই পথে কয়েক কোটি অভিযাত্রীর চলাচল এবং তাকে কেন্দ্র করে বিরাট অর্থনীতি, দুই-ই বছরে বছরে বাড়ছে। বাবা তারকনাথ ইত্যাদির কল্যাণে এ-জিনিস আমাদেরও অচেনা নয়, তবে উত্তরে এর জাঁক বহুগুণ।

Advertisement

সম্প্রতি, কাঁওয়ার যাত্রার সূচনাপর্বে মুজফ্ফরনগর-সহ উত্তরপ্রদেশ এবং উত্তরাখণ্ডের কিছু এলাকায় স্থানীয় পুলিশ নির্দেশ দিয়েছিল, যাত্রাপথে যে সব ভোজনালয় পড়ে, সেগুলির প্রত্যেকটির সামনে তাদের মালিক ও কর্মীদের নামের তালিকা টাঙিয়ে রাখতে হবে। কোথায় কী খাবার পাওয়া যায় তার তালিকা তো সচরাচর সর্বত্রই টাঙানো থাকে, যাতে যে যার রুচি পছন্দ এবং ধর্মীয় বা অন্যবিধ বিচার অনুসারে নিজের নিজের গন্তব্য বেছে নিতে পারেন। কিন্তু তাই বলে নামধাম, ঠিকানা-কুলজি? স্পষ্টতই, তীর্থযাত্রীদের সাহায্য করার সদিচ্ছা নয়, ধর্মপরিচয় দিয়ে ‘আমাদের’ থেকে ‘ওদের’ আলাদা করার কুবুদ্ধিই এই আদেশের পিছনে কাজ করেছে। আলাদা করতে পারলে ভাতে মারার ব্যবস্থাও করা যায়— তীর্থযাত্রার এই মরসুমে পথের ধারে খাবারের দোকানগুলির প্রচুর ব্যবসা হয়, সেই সুযোগ থেকে অ-হিন্দুদের বঞ্চিত করার এ এক নতুন ছল। এই উপদ্রবের পিছনে কাদের গূঢ় অঙ্ক কাজ করছে, সেটা বুঝিয়ে বলার দরকার নেই। স্থানীয় পুলিশ কাদের হুকুম-বরদার হিসাবে কাজ করে, সে বিষয়ে কী উত্তরপ্রদেশ, কী পশ্চিমবঙ্গ, সর্বত্রই নাগরিকদের পরিষ্কার ধারণা আছে।

গত কয়েক বছর ধরেই এই উপদ্রব চলছে, ক্রমশ তার মাত্রা বাড়ছে, যেমনটা সর্বদাই হয়ে থাকে আর কী। কিন্তু এ-বার এই অন্যায় নির্দেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেন দেশের কিছু সচেতন রাজনীতিক, সমাজকর্মী, শিক্ষাব্রতী প্রমুখ। সর্বোচ্চ আদালত দ্রুত তাতে সাড়া দিয়ে পুলিশের ওই নির্দেশ নাকচ করে দিয়েছে। মধ্যপ্রদেশের মতো অন্য কোথাও কোথাও অনুরূপ নাম টাঙানোর জবরদস্তি শুরু হয়েছিল, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের ফলে সেগুলিও সম্ভবত এ-যাত্রায় কিছুটা আটকানো যাবে। তবে আশঙ্কা হয়, তালিকা টাঙানো হোক বা না হোক, এই মহান দেশের, বিশেষত মহত্তর উত্তর ভারতের, অগণন তীর্থযাত্রাপথে— এবং তার মহতী অনুপ্রেরণায় অন্য নানা পরিসরেও— ভোজনালয়ের সামনে উত্তরোত্তর নিক্ষিপ্ত হবে ওই অমোঘ প্রশ্ন: ‘আগে বলো কী তোমার নাম’। সাম্প্রদায়িকতার গরল এক বার বোতলের বাইরে এলে বিষক্রিয়া কত দূর প্রতিহত করা যাবে, বলা শক্ত।

Advertisement

কাঁওয়ার-যাত্রার পৌরাণিক কাহিনিতেও অবশ্য গরলের ভূমিকাই প্রধান। সেই গরলও অতি মারাত্মক। কিন্তু সে-কাহিনি বিদ্বেষের নয়, ভালবাসার। সেই ভালবাসা ঘরের মানুষের, আবার বিশ্বমানবেরও। সমুদ্রমন্থনে উত্থিত হলাহল পানের পরে নীলকণ্ঠের শরীরে সেই বিষের প্রভাবকে প্রশমিত করতে পার্বতী তাঁকে গঙ্গাজল সেবন করিয়েছিলেন। সেই থেকেই শ্রাবণ মাসে বর্ষণপুষ্ট জাহ্নবীবারিতে তাঁকে সিঞ্চিত করার এই বার্ষিক আচার। বিষক্রিয়ায় কাতর দেবাদিদেবের শুশ্রূষা করতে কোটি কোটি মানুষ কাঁধে বাঁক নিয়ে ছুটে চলেছেন, এ-দৃশ্যের গভীরে ভালবাসা আছে বইকি! এবং, যুগ যুগ ধরে এই পুরাণকথা নানান শাখাপ্রশাখা ছড়িয়েছে, তৈরি হয়েছে রকমারি লোককাহিনি। তার একটি উপকথা বলে যে, শিবের এক পরম ভক্ত তাঁর জ্বালা দূর করতে গঙ্গা থেকে জল নিয়ে গিয়ে শিবলিঙ্গকে স্নান করিয়েছিলেন। সেই ভক্তের নাম রাবণ। হবেই তো! সর্বক্ষণ রামরাবণের যুদ্ধ করতে গিয়ে আমরা ভুলেই যাই যে রাবণ ছিলেন পরম ভক্তিমান এক শৈব রাজপুরুষ। তিনি আপন আরাধ্য দেবতার যন্ত্রণা প্রশমনে তৎপর হবেন না?

পুরনো ভারতবর্ষে এ নিয়ে কোনও গোল ছিল না, সেখানে তেঁতুলপাতায় রাম রাবণ শিব বিষ্ণু জগাই মাধাই বেয়াই বোনাই সকলের জায়গা হত, মাঝে মাঝে চুলোচুলি, হাতাহাতি, এমনকি কাটাকাটি করেও সহাবস্থান চলত। কিন্তু হালের এই রসকষবর্জিত কুলিশকঠোর নাগপুরি হিন্দুত্বওয়ালারা ও-সব বোঝেন না। হর হর মহাদেবের ভক্তদের তীর্থযাত্রা প্রসঙ্গে রাবণের নাম শুনে তাঁরা ঠুলি-আঁটা চোখে আগুন ছুটিয়ে তিরস্কার করে বলবেন: ‘ও সব গল্পকথা, প্রক্ষিপ্ত কাহিনি, জ্যায় শ্রীরাম’। তবে কিনা, তাঁরাও তো মনে মনে জানেন— রাম হোক, রাবণ হোক, সবই আসলে গল্পকথা, কিন্তু হাজার হাজার বছরের লোকবিশ্বাস থেকে তাকে ওড়ায় কার সাধ্য? অতএব, পবিত্র কাঁওয়ার-যাত্রার সঙ্গে রাবণের মহিমা জড়িয়ে আছে, এইটুকু ভেবেই শখের প্রাণে এক চিলতে ফুরফুরে হাওয়া খেলে গেল। এই দম-বন্ধ-করা অমৃতকালে সেটুকুই বা কম কী?

এই বার্ষিক জলযাত্রার অন্য এক তাৎপর্যও আছে, যা কেবল গভীর নয়, আমাদের পক্ষে অত্যন্ত মূল্যবান। বহু পৌরাণিক কাহিনি আর লোকাচারের সঙ্গেই জড়িয়ে থাকে লোকজীবনের ঐতিহ্য, প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে নিজেদের জীবনকে মিলিয়ে নিয়ে, মানিয়ে নিয়ে চলার লৌকিক প্রকল্প। উত্তর ভারতের কাঁওয়ার যাত্রায়, এবং দেশের অন্য নানা অঞ্চলে প্রচলিত একই ধরনের নানা জলবাহী অভিযানেও, তার নিদর্শন আছে। বিশাল দেশে জলের বণ্টন তো কোনও কালেই সুষম নয়, কোথাও তার অস্বাভাবিক প্রাচুর্য, কোথাও ঘোর অনটন। এই অসাম্যের মোকাবিলা করতেই কি দূরদূরান্তরের মানুষ অনেক পথ হেঁটে পৌঁছতেন সুজলা অঞ্চলে, দু’কূলপ্লাবী নদীর জল সংগ্রহ করে নিয়ে যেতেন নিজের নিজের তৃষ্ণার্ত বাসভূমিতে? এ ভাবে জলের বৈষম্য কতটুকু কমানো যায়, সেই প্রশ্ন এখানে সম্পূর্ণ অবান্তর। লোকসমাজের বাসিন্দারা চিরটাকাল এ ভাবেই চলে এসেছেন। তাঁরা তো আজকের মহাশক্তিধর রাষ্ট্রযন্ত্রী নন যে, দুর্বিনীত প্রযুক্তির বলে নদীর খাত ঘুরিয়ে দিয়ে কিংবা পাহাড়পর্বত বিদীর্ণ করে জল সরবরাহের মানচিত্র বদলে দিতে চাইবেন! তাঁদের হল কাঠবিড়ালির ধর্ম: দুই কাঁধে ঝুলিয়ে রাখা দুই বাঁকে যতটুকু জল নিয়ে যাওয়া যায়, যেতে হবে।

ক্রমে ক্রমে লোকধর্ম এবং তার এই বার্ষিক উৎসব, আর পাঁচটা উৎসবের মতোই, আচারসর্বস্ব অনুষ্ঠানে পর্যবসিত হয়েছে, তার পরে তা নাগরিক হুল্লোড়ের রূপ নিয়েছে, যে হুল্লোড় উত্তরোত্তর মুনাফাসন্ধানী পুঁজির কুক্ষিগত বাজারের দ্বারা চালিত হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগের যে সামাজিক উদ্যোগটি তার মধ্যে আজও অন্তঃসলিলা হয়ে আছে, তাকে যত্ন করে খুঁজে এবং চিনে নিতে পারলে আমাদেরই মঙ্গল হত। শ্রাবণ মাসের এই সময়টিতেই আমরা দেশ জুড়ে এক চেতনা জাগানোর উৎসব যাপন করতে পারতাম। জলের প্রতি, প্রকৃতির প্রতি, পরিবেশের প্রতি আমাদের দায়িত্ব সম্পর্কে পরস্পরকে সচেতন করতে পারতাম। আজকের এই বিপন্ন পৃথিবীতে সেই দায়িত্ব আক্ষরিক অর্থে সর্বজনীন। জল না হলে তো শিব বিষ্ণু হিন্দু মুসলমান রাম রাবণ কারও চলে না।

কিন্তু, বিভাজন আর বিদ্বেষ যাদের রাজনীতির বড় হাতিয়ার, তাদের কাছে এ-সব কথার কোনও অর্থই নেই। ‘ওদের’ আরও আরও কোণঠাসা করতে হবে, ব্যস। বছরের সবচেয়ে বড় ব্যবসার মরসুমে অ-হিন্দু মালিকের ধাবা বা রেস্তরাঁ বন্ধ থাকলে বহু হিন্দু কর্মচারী এবং আনাজওয়ালা, দুধওয়ালা ইত্যাদি নানা বর্গের মানুষজনেরও যে বড় ক্ষতি হবে, এতেও তাদের কিছু যায় আসে না— ক্ষমতার ফসল তোলার অভিযানে কিছু হিন্দুর স্বার্থ বিপন্ন হতেই পারে, সেটা নিতান্তই কারবার চালানোর খরচ, কিংবা বড়জোর ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’। তা ছাড়া, হিন্দু হয়ে অ-হিন্দুর কাছে কাজ করবেই বা কেন, ধৈর্য ধরো, কষ্ট সহ্য করো, সব হিন্দু হো জায়েগা।

জনজীবনের স্বাভাবিক পরিসর থেকে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে মুসলমানকে সরিয়ে দেওয়ার এবং তফাতে রাখার যে ষড়যন্ত্র গোটা দেশ জুড়েই সক্রিয়, কাঁওয়ার-যাত্রাকে ঘিরে গড়ে ওঠা নতুন গল্প তারই অঙ্গ। পুরাণ এবং পুরনো ইতিহাসের পথ ছেড়ে আধুনিক হিন্দুরাষ্ট্রের নির্দেশনায় গল্পটা যে ভাবে গরলসমুদ্র মন্থন করে চলেছে, আদালতের নির্দেশে তা কিছুটা থমকে যেতে পারে, কিন্তু শেষরক্ষা হবে কি? ইতিহাসকে যদি ঘোরাতে হয়, তবে এই অন্যায়, অনৈতিক এবং ষোলো আনা অসাংবিধানিক বিভাজনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করা দরকার: ‘নো পাসারান’। সেটা রাজনীতির কাজ। রাজনীতিরই কাজ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement