রানি দ্বিতীয় এলিজ়াবেথ।
তখন দ্বিতীয় এলিজ়াবেথ ছোট্ট লিলিবেট। মুকুট মাথায় আসার কথা দূরতম কল্পনাতেও নেই। কারণ, তিনি সিংহাসনের দৌড়ে দূরে, তৃতীয় স্থানে। তাঁর জ্যেঠু অষ্টম এডওয়ার্ড সিংহাসনের দাবিদার, বাবা অ্যালবার্ট স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে চিন্তাহীন রাজকীয় জীবন কাটাচ্ছেন। তখন থেকেই শান্ত লিলিবেটকে কিছুটা যেন আড়াল করে দিতেন বোন মার্গারেট। মার্গারেট বেশি সুন্দরী, ছটফটে, যেখানে যান আলো কেড়ে নেন। কিন্তু অজান্তে-অলক্ষ্যে আদর্শ আলফা-নারীর ছাঁচে গড়ে উঠছিলেন কম কথার লিলিবেট। দুটো গুণ তাঁর সঙ্গেই বেড়ে উঠছিল। কর্তৃত্বের জিন। আর ভাগ্য। ভাগ্যবশে, রাজা হওয়ার বছরেই ডিভোর্সি ওয়ালিস সিম্পসনের হাত চিরতরে ধরতে চেয়ে সিংহাসন ত্যাগ করলেন অষ্টম এডওয়ার্ড। ষষ্ঠ জর্জ নাম নিয়ে তাঁর বাবা সিংহাসনে বসার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত আলো এসে পড়ল লিলিবেটের মুখে। সেই ভবিষ্যতের রানি।
এ দিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী পৃথিবীর যা মতিগতি, স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছিল যে খুব নিকট ভবিষ্যতেই রাজতন্ত্রের হয়তো আর তত গুরুত্ব থাকবে না। সেই অবস্থান থেকে একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দুই দশক পর্যন্ত রাজমুকুটকে প্রাসঙ্গিক রেখে গিয়েছেন দ্বিতীয় এলিজ়াবেথ। ১৯৫৩ সাল থেকে দীর্ঘতম শাসনকালের হিসাবনিকাশের ঊর্ধ্বে এটাই হয়তো তাঁর মহা-কৃতিত্ব! এবং তার জন্য দায়ী তাঁর সেই নেতৃত্বের সহজাত ক্ষমতা এবং ক্ষুরধার বুদ্ধি। যে বুদ্ধির বলে, সেই ছোটবেলার মতোই, যত বার তিনি কোনও তুখড় রাজনীতিবিদ বা জনমোহিনী ব্যক্তিত্বের আড়ালে ঢাকা পড়েছেন, তত বার দাপটের সঙ্গে বেরিয়ে এসেছেন— উইনস্টন চার্চিল, মার্গারেট থ্যাচার, হৃদয়ের রানি ডায়না। নামগুলির ওজন বা উচ্চতা কম নয়। এভাবেই নাম বদলেছে, পৃথিবী ভোল পাল্টেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এসেছে, ভারত-সহ সমস্ত উপনিবেশ হাতের মুঠো গলে বেরিয়ে গিয়েছে। ব্রেক্সিট হয়েছে, রাজপরিবারের উপর একের পর এক কলঙ্কের পাহাড় চড়েছে, বার্লিনের প্রাচীর উঠেছে ও ভেঙেছে— তবু রানি ধ্রুবতারার মতো একই থেকে গিয়েছেন।
বহু বার বলা হয়েছে যে ব্রিটিশ পার্লামেন্টই প্রধান শক্তি, রানির ক্ষমতা শুধু প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কয়েক মিনিটের আলোচনায় সীমাবদ্ধ। তাঁর সেখানে তেমন কোনও বক্তব্য রাখার ক্ষমতা কই? আর তিনি কোথায়ই বা সিদ্ধান্ত নেন? পরামর্শ দেওয়ারও লোক আছে অজস্র। কিন্তু তা সত্ত্বেও অনস্বীকার্য, সব বিষয়ে তাঁর অপরিহার্য ভূমিকা থাকে। সারা বিশ্বের প্রেক্ষাপটে তিনি নারীশক্তির প্রতীক। আর একই সঙ্গে এ মাত্র এই মুকুটধারীই হয়তো প্রকৃত অর্থে ‘আধুনিক পৃথিবীর শাসক’ হয়ে উঠেছেন। ৭০ বছরের শাসনকালে ১২৯টা দেশে ৩০০ বার রাজসফরে গিয়েছেন তিনি। হাজারের উপর বক্তৃতা দিয়েছেন। জনসংযোগ করেছেন দুর্দান্ত। ভুললে চলবে না, চার্চিলের কথা না শুনে, তিনিই প্রথম নিজের রাজ্যাভিষেক মানুষকে সরাসরি টিভিতে দেখার ব্যবস্থা করেছেন। রাজপরিবারের জীবন টিভিতে দেখাতে অনুমতি দিয়েছেন, বাকিংহাম প্রাসাদের ওয়েবসাইট তৈরি করেছেন, মানুষ ঢোকার অনুমতি দিয়েছেন প্রাসাদে। জনতার নাড়ি বুঝতে তাঁর জুড়ি নেই। নইলে ডায়নার মৃত্যুর পরের প্রবল বিরোধিতাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হত না।
নিজেকে বেশি সিরিয়াসলি নিতে নেই— এই কথাটা বারে বারে বলে থাকতেন রানি। সঙ্গে দুষ্টু হাসি। এই রসবোধ, তার সঙ্গেই ‘কেয়ারফ্রি হাবভাব’ আর বয়সকে উড়িয়ে রঙিন পোশাকও তাঁকে জনপ্রিয় করেছিল। ৭৫ বছর বয়সে মসজিদে প্রবেশ করে কেমন যেন বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, যতটা মনে করা হয়, ততটাও গোঁড়া নই। তাঁর আমলেই তো ব্রিটেনে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য সবচেয়ে প্রকট ভাবে দেখা দিয়েছে। তাই, রাজপরিবারের অন্যদের নিয়ে আলোচনা বেশি হলেও, জনমোহিনী ব্যক্তিত্বটি আসলে তাঁরই ছিল। করের টাকাতেই রাজপরিবারের সমৃদ্ধি, এ কথা স্বীকার করে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। শিশুমহলে তাঁর ভাবমূর্তি মিষ্টি দিদিমার— প্যাডিংটন ভালুকের সঙ্গে তাঁর অভিনয় সুপারহিট হওয়া থেকেই বোঝা যায়।
প্রথম যখন রানি হয়েছেন, মার কাছে গিয়ে বলেছিলেন, এই সিংহাসনটার কি আমি যোগ্য মা? আমার চারপাশে যাঁরা আছেন, তাঁরা বিশ্লেষণমূলক কথাবার্তা বলেন। আমি চুপ করে থাকি। তাঁর মা নাকি বলেছিলেন, ছোট থেকে তোমার রাজনৈতিক চেতনা বিকশিত করা হয়েছে ঠিক পথেই। তাই তুমি চুপ করে থাকতে জানো। জানো যে, কখনও কখনও চুপ করে থাকাই রাজনীতির শ্রেষ্ঠ চাল।
হয়তো শুধু নীরবতা নয়, নিজেকে পাল্টে নেওয়ার খেলাটা জানতেন দুর্দান্ত। তাই একুশ শতকেও রাজমুকুটের গরিমা ধরে রাখলেন। সামাল দিতে পারতেন সব রকমের ঝড়ঝাপটা, পরিবর্তন। শুধু সেই ১৩ বছর বয়সের ভালবাসা ফিলিপের পৃথিবী থেকে বিদায়ের জ্বালাটাই কি সইতে পারলেন না? তিনি এক বার বলেছিলেন, “মাঝে মধ্যে মুখে জোর করে হাসি ধরে রাখি নইলে আমার মুখের গঠন এমন হয়ে যায় যে সকলে দেখলে দূরে পালায়।” শুনে ফিসফাস হয়েছিল, ‘‘রানি জোর করে হাসেন?’’ কেউ কেউ বলতেন, আসলে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে জানেন রানি। কমনওয়েলথ নিয়ে ৫২টি দেশের প্রধানার কি নিজের জীবন, দাম্পত্য, সন্তান প্রতিপালন নিয়ে দুঃখ ছিল?
না কি, সে সব দূরে সরিয়ে রেখে তিনি সত্যিই ‘জাতির জননী’ হয়ে উঠতে পারলেন?