মানসিক স্বাস্থ্য আর শ্রমের বাজারের মধ্যে সম্পর্কটা গোলমেলে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যার কারণে সারা দুনিয়ায় প্রতি বছর ১২০০ কোটি শ্রমদিন নষ্ট হয়। একটি অসরকারি সংস্থার সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারতে প্রতি বছর, মানসিক অসুস্থতার কারণে উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতার যে ঘাটতি হয়, তার পরিমাণ এক লক্ষ দশ হাজার কোটি টাকা। সুতরাং কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যের সুরক্ষার বিষয়টা কর্তৃপক্ষের কাছে কেবল নৈতিক প্রশ্ন নয়, অর্থনৈতিকও বটে। সমীক্ষাটি বলছে, কোভিড-পরবর্তী সময়ে আশি শতাংশ শ্রমিক-কর্মচারী কাজের জায়গায় কোনও না কোনও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার কথা জানিয়েছেন। পরিষেবা ক্ষেত্রে নিযুক্ত অফিস-কর্মচারীরা উদ্বেগ কমাতে নানা ধরনের ওষুধ খাচ্ছেন, ‘অ্যাংজ়াইটি পিল’-এর বাজার বেড়েই চলেছে। কল-কারখানার শ্রমিক, অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মীরা কী ভাবে মনের সমস্যার মোকাবিলা করছেন, সেটা আমরা এখনও জানি না।
তবে কিছু প্রশ্ন ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। উৎপাদন ও ডেলিভারির সময়সীমার চাপ (ডেডলাইন), একটানা দশ-বারো ঘণ্টার শিফটে কাজ, কাজের পরিবেশে নানা প্রতিকূলতা (অতিরিক্ত গরম, শৌচাগারের অভাব, সহকর্মীদের দুর্ব্যবহার) ইত্যাদির কারণে মানসিক স্বাস্থ্য কী ভাবে, কতটা ব্যাহত হচ্ছে? কত মানুষ ওষুধের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন? সে জন্য আরও কত স্বাস্থ্য-সমস্যা তৈরি হচ্ছে? বিদেশে দেখা যাচ্ছে, কিছু সংস্থা এ বিষয়ে সজাগ হয়েছে। নিয়োগকারীরা কাজের জায়গায় ঘুম, বিনোদনের বন্দোবস্ত করছেন। যেমন, এ বছর এপ্রিলে চিনের একটি বৃহৎ রিটেল সংস্থা ঘোষণা করে, কর্মীদের প্রাপ্য ছুটি ছাড়াও বছরে আরও দশ দিন মিলবে ‘মন খারাপের ছুটি’। মন ভাল রাখা যে জরুরি, তা কর্তৃপক্ষ বুঝেছেন।
তবে এমন উদ্যোগ ব্যতিক্রম। দুনিয়া জুড়ে বৃহৎ সংস্থাগুলির দাপট বাড়ছে, দুর্বল হচ্ছে শ্রমিক আন্দোলন। তার উপর ভারতের মতো দেশে কর্মহীনতা তীব্র হওয়ায় শ্রমিক উদ্বৃত্ত। এই অবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্যে সমস্যা হলে শ্রমের বাজার থেকে বাতিল হয়ে যান কর্মীরা। সরকারি তথ্য (সেন্ট্রাল স্ট্যাটিস্টিক্যাল অর্গানাইজ়েশন) অনুযায়ী, মানসিক স্বাস্থ্যের কোনও সমস্যায় ভুগেছেন, তাঁদের দশ জনে আট জনই কাজ পান না। আইনে মানসিক স্বাস্থ্যের অধিকার থাকলেও, কর্মক্ষেত্রে তা মান্য করা হয় না বলে কাজের অধিকার হারানো, বা কাজের অধিকার না পাওয়া মানুষ বেড়েই চলেছে। কর্মহীনতার জন্য মানসিক সমস্যা, আর মানসিক সমস্যার জন্য কর্মহীনতা, এই দুষ্টচক্র চলছেই।
এর কিছু কারণ প্রশাসনিক নিয়মকানুনেই রয়েছে। সেরে-ওঠা মনোরোগীদের মধ্যে যাঁরা কর্মক্ষম ও কাজ করতে সম্মত, তাঁদের জন্য উপার্জনের সুযোগ তৈরি করার একটি উদ্যোগ করা হয়েছে এ রাজ্যে, রাজ্য সরকার এবং অসরকারি সংস্থার যৌথ উদ্যোগে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, পরিবার-পরিত্যক্ত মনোরোগীদের অনেকের কাছে কোনও পরিচয়পত্র নেই। কী ভাবে এই ধরনের মানুষদের পরিচয়পত্র তৈরি করা সম্ভব, তার কোনও বিধি-ব্যবস্থাও তৈরি নেই। অথচ, পরিচয়পত্র তৈরি না হলে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা যাচ্ছে না, কাজ পাওয়াও সম্ভব হচ্ছে না।
কিন্তু আরও বড় সঙ্কট কর্মক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের মনোভাব। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবিটিসের মতো অসুখ সারে না, নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। মানসিক স্বাস্থ্যও তাই। নিয়মিত চিকিৎসা ও কাউন্সেলিং-এ থাকলে স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা বজায় রাখতে সমস্যা হয় না। অথচ, বহু কর্মী কাজ থেকে খারিজ হয়ে যাওয়ার ভয়ে, অথবা কর্মক্ষেত্রে কোণঠাসা হওয়ার ভয়ে, নিজের মনোরোগের কথা জানাতে পারেন না কাজের জায়গায়। দেশ-বিদেশের বহু কৃতী, বিখ্যাত মানুষেরা জানিয়েছেন, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার মোকাবিলা করে তাঁরা নিজের ক্ষেত্রে শীর্ষে উঠেছেন। মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলার নানা উদ্যোগ করেছেন অনেকেই, যেমন অভিনেত্রী দীপিকা পাড়ুকোন। প্যারিস অলিম্পিক্সে আমেরিকার জিমন্যাস্ট সিমোন বাইলস নিজেকে ‘সর্বকালের শ্রেষ্ঠ’ বলে প্রতিষ্ঠা করলেন। তিনি চার বছর আগে অসুস্থতার কারণে টোকিয়ো অলিম্পিক্স থেকে সরে আসতে বাধ্য হন। তার পর দু’বছর সময় নিয়েছিলেন মানসিক সুস্থতার জন্য। প্রতিভায় হয়তো তাঁরা ব্যতিক্রমী, কিন্তু মনোরোগের মোকাবিলা যে কমবেশি সকলকেই করতে হয়, অতি কুশলী, অতি সফলরাও ব্যতিক্রম নন, সে কথাটাও তাঁদের দেখলে বোঝা যায়। সকলেরই অধিকার রয়েছে মনোরোগের চিকিৎসা পাওয়ার, নিজের পছন্দের কাজের সুযোগ পাওয়ার।
এই অধিকারের পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছে এক ধরনের অনমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি, যা নির্দিষ্ট করে দিতে চায় কে ‘সক্ষম’, সে ‘স্বাভাবিক’। ‘তোমাকে আমার সংজ্ঞা মোতাবেকই পারতে হবে, তুমি যদি না পারো সে দায় তোমার’— আপাদমস্তক পুরুষতান্ত্রিক এই দাবি মানসিক স্বাস্থ্যের অধিকার, কাজের অধিকারের পরিপন্থী। আক্ষেপ, নিয়োগকারীর এই মনোভাবের বিপরীতে শ্রমিক আন্দোলনও সে ভাবে অবস্থান নেয়নি। শ্রমিক সংগঠন, নাগরিক সংগঠনগুলি পেশাগত রোগ নিয়ে যেটুকু কথা বলে, তার মধ্যেও সে ভাবে উঠে আসে না মনোরোগের কথা। কাজের পরিবেশকে যে শারীরিক স্বাচ্ছন্দ্যের পাশাপাশি মানসিক সুস্থতারও অনুকূল থাকতে হবে, তাতে কর্মীর দক্ষতা এবং উৎপাদনশীলতা দুটোই বাড়বে, এ কথাটা বোঝার সময় এসেছে।