Bengali

লোকধর্ম কিন্তু বাংলার গভীরে

লোকসংস্কৃতির শিকড় বাংলার মাটিতে এতই চারিয়ে গিয়েছে যে, আগে লোকসম্পর্কের দৃঢ়বদ্ধ শেকড়কে ছিঁড়তে পারলে তবেই হিন্দু-মুসলিম বিভেদের স্বার্থসিদ্ধি হবে। বাঙালি তা হতে দেবে কি?

Advertisement

প্রণব সরকার

শেষ আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০২১ ০৪:৪১
Share:

সমন্বয়ধর্মিতাই বাংলার সমাজের বৈশিষ্ট্য ছিল। ধর্মীয় বিভাজনকে হারিয়ে এখানে বড় হয়ে উঠেছিল লোকায়ত ধর্ম। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সম্প্রীতির বন্ধনকে দৃঢ় করেছিল বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতি, গোঁড়া হিন্দু বা মুসলিম যেখানে দাঁত ফোটাতে ব্যর্থ। বাউলধর্ম এতটা গুরুত্বপূর্ণ বলেই কয়েক বছর আগে মুর্শিদাবাদে বাউলরা আক্রান্ত হয়েছিলেন। বাংলাদেশে চুয়াডাঙায় ২০১৬-র জুলাইয়ে বাউল আখড়ায় আগুন লাগানো হয়, ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত হন অনেকে।

Advertisement

এই লৌকিক চেতনার উন্মেষের পিছনে আছে এক দীর্ঘ ইতিহাস। ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতিকে নিম্নবর্গের বাঙালি কোনও দিনই অন্তর থেকে মানতে পারেনি। লৌকিক পুজো-পার্বণে ব্রাহ্মণের দরকার ছিল না।

আমার ছোটবেলা কেটেছে সুন্দরবনের অজগাঁয়ে। স্কুলে হিন্দু-মুসলমান, জনজাতি-দলিত সব ছেলেমেয়ে এক সঙ্গে পড়েছি। চতুর্থ শ্রেণির ফাইনাল পরীক্ষার সিট পড়ত দূরে। মাটির রাস্তা, বৃষ্টিতে এক হাঁটু কাদা। পরীক্ষার সময় সেন্টারের কাছে থাকতে হত। রান্না করে, খাইয়ে সেন্টারে নিয়ে যেতেন মোহরউদ্দিন স্যর। হিন্দুপ্রধান গ্রামে হাসপাতালের জন্য জমি দিয়েছিলেন সম্পন্ন কৃষক আমিনুদ্দিন। কীৰ্তনের আসরে মঞ্চের ধারে বসতেন, লম্বা দাড়ি, পরনে ফতুয়া-লুঙ্গি, হাতে লাঠি। মুসলমান বন্ধুদের বাড়ির শাদিতে যেতাম। মুসলিম বান্ধবীরা বাড়িতে আসত অবলীলায়, আমরাও মইনুদ্দিন দাদুর বাড়ি যেতাম বিনা বাধায়। রোজ সকালে গণিচাচা আসতেন চা খেতে।

Advertisement

সে গ্রামে হিন্দুদের দুর্গাপূজায় সাহায্য করেন মুসলমানরা। হিন্দুর শবদেহ কাঁধে করে শ্মশানে পৌঁছে দেন। মুসলমানদের উৎসবে যোগ দেন হিন্দুরা, পির-পিরানি, গাজি-বিবির দরগায় মানত করেন। উত্তর ২৪ পরগনার হাড়োয়ায় ১২ ফাল্গুন গোরাচাঁদ পিরের উৎসবে বাড়গোপপুরের কালু ঘোষের পরিবার হাজোত দেন। ঘুটিয়ারি শরিফে গাজি পিরের দরগায় বারুইপুরের রায়চৌধুরী বাড়ির মেয়েরা প্রথম সিন্নি চড়ান, মোমবাতি জ্বালেন। শাকশহরের বামুন পিরের দরগা থেকে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে তেল পড়া নেন চর্মরোগ, কাটা-পোড়ার ওষুধ হিসেবে। লক্ষ্মীকান্তপুর থেকে কুলপির দিকে দয়ারামের কাছাকাছি আছেন বামুন গাজি। সেপাই চেহারার অশ্বারোহী, মুখে দাড়িগোঁফ, হাতে লাগাম, পায়ে মোজা। শনি-মঙ্গলবারে তুমুল ভিড়। হিন্দু রাঢ়ী ব্রাহ্মণ ও মুসলমান দেয়াশি উভয়েই পুজো করেন। বাতাসা ভোগ, মুরগি উৎসর্গের প্রথা আছে। সুন্দরবনে জল-জঙ্গলজীবী হিন্দুদের যিনি বনচণ্ডী বা বনদেবী, তিনিই মুসলমানদের বনবিবি। নরেন্দ্রপুরের কাছে আছেন শিশুদের রক্ত-আমাশার দেবতা— মুসলমানের রক্তাখাঁ, হিন্দুর রতনগাজি। হিন্দুর সত্যনারায়ণ আর মুসলমানের সত্যপির যেন একেরই দুই রূপ।

দেবদেবীর এই বিমিশ্রণ গ্রামজীবনে সম্প্রীতির ভিত তৈরি করেছে। কোন হিন্দু দেবতা কোন পির-গাজিতে রূপান্তরিত, তা আছে ধর্ম ঠাকুরের গাজনে অনুষ্ঠানে ‘ঘর ভাঙার ছড়া’য়: “ধর্ম হৈলা যবনরূপী শিরে পরে কালটুপি, হাতে ধরে ত্রিকচকামান/ ব্রহ্মা হৈলা মহম্মদ বিষ্ণু হৈল পেগম্বর মহৈশ হৈল বাবা আদম।/ গণেশ হৈল কাজী কার্তিক হৈল গাজী ফকির হৈল মুণিগণ।।/ তেজিয়া আপন ভেক নারদ হৈল শেখ পুরন্দর হৈল মৌলানা।/ চন্দ্রসূর্য আদি যত পদাতিক হৈয়া শত উচ্চৈঃস্বরে বাজায় বাজনা।”

বঙ্কিমচন্দ্র ১২৮৭ বঙ্গাব্দে বঙ্গদর্শন-এ লেখেন, “দেশীয় লোকেরা যে স্বধর্ম ত্যাগ করায় মুসলমান হইয়াছে ইহা সিদ্ধ।” পরবর্তী কালেও লোকে ভয়ে, লোভে, ব্রাহ্মণ্যধর্মের অত্যাচারে ধর্মত্যাগ করে মুসলমান হন। কিন্তু নিম্নশ্রেণির হিন্দুরা নিম্নবর্গের মুসলমান বা ‘আতরফ’ থেকে যান; জোলা, মুদ্দাফরাস, তাঁতি, নিকিরি। সৈয়দ-শেখ-পাঠান প্রভৃতি উচ্চশ্রেণির মুসলমান বা ‘আশরাফ’ভুক্ত হননি তাঁরা। মহম্মদ মনসুরউদ্দিনের হারামণি দ্বিতীয় খণ্ডের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ লেখেন: “এদেশে অধিকাংশ মুসলমানই বংশগত জাতিতে হিন্দু, ধর্মগত জাতিতে মুসলমান।” বঙ্গের ইসলাম আরবের শরিয়তি ইসলাম নয়, হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন আচার-সংস্কারে মিলেমিশে তৈরি লৌকিক ইসলাম।

নিম্নবর্গের মানুষ কালক্রমে বহু পেশা গ্রহণ করেছেন। দর্জি বা পোশাকশিল্পীরা সাধারণত মুসলমান, হিন্দুও তা গ্রহণ করেছে। মাছের ব্যবসা মুসলমান নিকিরিরা করেন, বাগদি, তিয়র, জেলে-কৈবর্তরাও। ক্ষৌরকর্ম হিন্দু বৃত্তি হলেও, মুসলমানরাও তাতে খ্যাতি অর্জন করেছেন। মুর্শিদাবাদের মুসলমান রাজমিস্ত্রিদের কদর আছে। লোকশিল্পে সম্প্রদায়-নিরপেক্ষ শিল্পচেতনার ভূরি ভূরি প্রকাশ— নকশা, লোকচিত্র, নৃত্য-গীত, ধাতুশিল্পে। বাংলাদেশের লোকপণ্ডিত আবদুল হাফিজ লেখেন, “হিন্দু বাঙালি তার লক্ষ্মীর পা, ঝাঁপি কিংবা সরায় যে বক্তব্য রাখেন, বাঙালি মুসলমান জায়নামাজ ও মহরমের বিচিত্র মোটিফ-সম্পন্ন পিঠেতেও সেই একই বক্তব্য রাখেন।”

রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য ধর্মে ধর্মে দাঙ্গাহাঙ্গামা বাধাতে চায় অপশক্তি। কিন্তু লোকসংস্কৃতির শিকড় বাংলার মাটিতে এতই চারিয়ে গিয়েছে যে, আগে লোকসম্পর্কের দৃঢ়বদ্ধ শেকড়কে ছিঁড়তে পারলে তবেই হিন্দু-মুসলিম বিভেদের স্বার্থসিদ্ধি হবে। বাঙালি তা হতে দেবে কি?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement