ganga

বিপন্ন নদীর পরিত্রাণ করবে কে

দরিদ্র, অনাথ, পরিত্যক্ত জীবের দেহ ভারতের নদী বহন করছে যুগ যুগ ধরে। নদী মানেই পতিতপাবনী। কিন্তু নদীর পরিত্রাণ করবে কে?

Advertisement

সুপ্রতিম কর্মকার

শেষ আপডেট: ১৮ জুন ২০২১ ০৫:৪২
Share:

অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউ থিতিয়ে আসছে, এ বার হয়তো একটু স্বস্তি পাবে মালদহের পুলিশ। উত্তরপ্রদেশ, বিহার থেকে করোনা-মৃতদের দেহ ভেসে এই ভাটির দেশ বাংলায় এল কি না, তা দেখার জন্য নদীর ধারে টহল, নজরদারি থেকে মুক্তি মিলবে। এমন দুটো দেহ ভেসে এসেছিল ভূতনির ঘাটে। দেশের নানা রাজ্য থেকে এসেছে গঙ্গায় ভেসে-যাওয়া মৃতদেহের ছবি। সৎকারের লোকবল, অর্থবল যাঁদের নেই, তাঁরা নিকটজনের মৃতদেহ ভাসিয়ে দিয়েছেন নদীতে। মে মাসে উত্তরপ্রদেশের বলরামপুরে এক কোভিড রোগীর দেহ তাঁর পরিচিতদের রাপ্তী নদীর সেতুর উপর থেকে জলে ফেলতে দেখা গিয়েছিল। উত্তরপ্রদেশ পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর অভিযুক্ত পরিবারের সদস্যরা স্বীকার করেছিলেন, তাঁদের আর্থিক ক্ষমতা নেই দাহ করার। এই অক্ষমতার সামনে গঙ্গা আর রাপ্তীর কোনও পার্থক্য নেই। উপযুক্ত সৎকার, নদীর দূষণ, অতিমারি আইনের চোখরাঙানি, সব কিছু দারিদ্রের সামনে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে।

Advertisement

কালের ধারার সঙ্গেই বয়ে চলেছে শববাহনা নদীর ধারা। উনিশ শতকে স্যানিটারি কমিশনের নানা নথিপত্র ঘাঁটলেই খোঁজ মিলবে, কলেরা, প্লেগ, ইনফ্লুয়েঞ্জা— প্রতিটি মহামারির পরে ভারতের নানা নদীতে ভেসে আসতে দেখা গিয়েছে মৃতদেহ। দাহ করার মতো জ্বালানি, কবর দেওয়ার মতো জমি যারা জোটাতে পারে না, নদীই তাদের শেষ আশ্রয়। উত্তরবঙ্গে একটা নদীর নাম ‘মড়াখাওয়া’। ময়নাগুড়ি বাসস্ট্যান্ড থেকে যে রাস্তা পেটকাটি মায়ের মন্দিরে যাচ্ছে, সেই পথেই পড়ে এই নদী। মিশেছে জরদা নদীর সঙ্গে। অতীতে রাজবংশী মানুষেরা মৃত্যুর পর আধপোড়া শরীরটাকে এই নদীতে ভাসিয়ে দিত। আর নদীর ধারে জ্ঞাতি-বন্ধুদের খাওয়ানো হত।

এই রীতিকে কেন্দ্র করেই নদীর নাম হল ‘মড়াখাওয়া’। এখনও নদীর পাশে গেলে দেখা মিলবে বহু পুরনো শ্মশানের।

Advertisement

আরও এক নদী উত্তরবঙ্গেই আছে। গয়েরকাটা, ধূপগুড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যায় আংরাভাসা নদী। এই নদীর ধারে রয়েছে কয়েকটা শ্মশান। আগে রাজবংশীরা মৃতদেহ পুড়িয়ে আধপোড়া কাঠ বা আংরা-সহ পোড়া শরীরটাকে ভাসিয়ে দিত নদীর জলে। তার থেকেই নদীর নাম হল ‘আংরাভাসা’। গত বছরও সাকোয়াঝোরা-১ গ্রাম পঞ্চায়েতের সাজনাপাড়াতে একটা দেহ ভেসে এসেছিল, আংরাভাসার ঢেউয়ে। মড়াখাওয়া আর আংরাভাসা নদীর এই ইতিহাস শোনা যায় লোকসংস্কৃতির প্রবীণ গবেষকদের থেকে।

দক্ষিণবঙ্গেও উদাহরণ আছে। নদিয়ার চাপড়া ব্লকে বড় একটা হাঁসুলি বাঁক রয়েছে, জলঙ্গি নদীর বুকে। হাটচাপড়া গ্রামের প্রবীণ মানুষদের মুখে জানা যায়, দু’দশক আগেও রাতের অন্ধকারে জলঙ্গি নদীর ওই বাঁক থেকে দেহ ভাসানো হত। এই অঞ্চলের সাপের বিষে মৃতদের দেহ কিছু দিন আগেও শ্মশানে যেত না। ভাসানো হত নদীর জলে। নদীর জলে ভেসে পরপারে যাত্রা সমাজচিন্তায় গভীর ছাপ ফেলে গিয়েছে। জীবন-মরণের সীমানা নির্দিষ্ট করছে এক নদী— বৈতরণি। বেহুলা-লখিন্দরের যাত্রা বস্তুত মানুষের মৃত্যু-উত্তীর্ণ হওয়ার স্বপ্ন, লৌকিক থেকে অলৌকিকের যাত্রা। আর তার জন্যেও ভেলা ভাসাতে হয় বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে-চলা নদীতে।

এই সনাতন চিন্তার সঙ্গে আধুনিক ভারতে যোগ করা হয়েছিল চিন্তার অন্য এক মাত্রা, যখন উত্তরাখণ্ড হাই কোর্ট গঙ্গা এবং যমুনা নদীকে ‘জীবিত সত্তা’র অধিকার দিয়েছিল। ২০১৭ সালের মার্চ মাসে এই ব্যতিক্রমী রায়ের ভিত্তি ছিল এই ধারণা যে, গঙ্গাকে ‘মানবসত্তা’ বলে স্বীকার করলে তার মানবাধিকার বজায় রাখার দায় বর্তাবে রাষ্ট্রের উপর। ভারতীয় সংবিধানের ২১ নম্বর ধারা জীবনের অধিকারের কথা বলে। সে ক্ষেত্রে গঙ্গাকে দূষিত করলে তা কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ হবে। শেষ অবধি অবশ্য তা হয়নি। উত্তরাখণ্ড রাজ্য সরকার ওই রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন করলে সুপ্রিম কোর্ট জুন মাসে তা খারিজ করে দিয়েছিল। যুক্তি ছিল, নদীকে ‘জীবিত সত্তা’ বলে ধরে নিলে অনেক রকম আইনি জটিলতা দেখা দেবে। তা সত্ত্বেও এই বিতর্কের মূলে রয়েছে যে ভাবনা, যা নদীর দেহকে মানবদেহের সমান মর্যাদা দিতে চায়, যা নদীকে মানবজীবনের মতোই সুরক্ষা ও যত্নের অধিকারী বলে মনে করে, তার শক্তি কমেনি। গঙ্গার কলুষমুক্তির দাবিতে ১১২ দিন অনশনের পর প্রাণত্যাগ করেছিলেন পরিবেশ আন্দোলনকারী গুরুদাস আগরওয়াল, ২০১৮ সালে। গঙ্গার উপর বাঁধ তৈরি, বালি খননের প্রতিবাদ করে বার বার আমৃত্যু অনশনে বসেছেন সন্ন্যাসীরা। এ বছরও কুম্ভমেলা চলাকালীন দু’জন সন্ন্যাসী অনশনরত ছিলেন। নদীর নবজীবন দাবি করে মৃত্যুবরণ করতে এগিয়ে এসেছেন এমন অনেক মানুষ।

দরিদ্র, অনাথ, পরিত্যক্ত জীবের দেহ ভারতের নদী বহন করছে যুগ যুগ ধরে। নদী মানেই পতিতপাবনী। কিন্তু নদীর পরিত্রাণ করবে কে? এই বাংলার কত নদী যে নিঃসাড়ে মরে যাচ্ছে, লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে স্মৃতি থেকে, তার খবর কত জন রাখে?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement