মেয়ে মানেই ঠিকা চাষি।
ওই যে মেয়েটি ঝুঁকে পড়ে খাতায় লেখা হিসাব দেখাচ্ছেন, উনি হলেন পাঁচ জনের এক জন। মানে, কোম্পানির পাঁচ জন ডিরেক্টরের এক জন, স্বর্ণপ্রভা মাহাতো (ছবি)। খাতায় লেখা আছে, কোম্পানির হয়ে যাঁরা খরিদ করেন, সেই ‘প্রোকিয়োরমেন্ট অফিসার’-দের কার কত টার্গেট। চব্বিশ জন ‘পিও’, প্রত্যেককে কুড়ি লক্ষ টাকার ব্যবসা করতে হবে। পারবেন তো? অঞ্জলি সোরেন, মমতা বেসরা, হীরাবতী রানা, প্রভাতী দাসেরা প্রত্যয়ের সঙ্গে মাথা নাড়লেন। তাঁরা এক-একটা গ্রাম সংসদে গিয়ে মেয়েদের স্বনির্ভর গোষ্ঠীকে বুঝিয়ে দেন কত ‘অর্ডার’ রয়েছে; বুঝে নেন, কে কতটা দিতে পারবে। কোম্পানির অন্য চার জন ডিরেক্টর, বাসন্তী সোরেন, কৃষ্ণা ভুঁইয়া, অঞ্জলি মুর্মু আর নমিতা মাহাতো জানালেন, গত বছর বন্যা আর হাতির আক্রমণ পরিকল্পনা বানচাল করে দিয়েছে। আর্থিক বছরের শেষে, অর্থাৎ মার্চ মাস অবধি আয়-ব্যয় ধরলে কিছু ক্ষতিই হয়েছে। তবে জুন অবধি ধরলে লাখখানেক টাকা রয়েছে লাভের ঘরে। বাড়তি লাভ, কিছু ‘করে দেখানোর’ তৃপ্তি। “জানেন, আমাদের চালে তিরুপতির মন্দিরে পায়েস রান্না হয়?”
খড়্গপুর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে চাঁদাবিলা গ্রাম পঞ্চায়েতের পুকুরিয়া গ্রাম। ‘আমন ফার্মার্স প্রোডিউসার্স কোম্পানি’-র মিটিং হচ্ছে অঙ্গনওয়াড়ির ঘরে শতরঞ্চিতে। ছ’টা গ্রাম পঞ্চায়েতের বিরানব্বইটি গ্রামে ছড়িয়ে শেয়ারহোল্ডার, মোট সংখ্যা ২৬৭৭। সকলেই মেয়ে, সকলেই চাষি। প্রধান উৎপাদন ‘কালাভাত’ নামে এক দিশি প্রজাতির কালো ধান, সম্পূর্ণ জৈব পদ্ধতিতে। নিকষ কালো, একটু মোটা, সুগন্ধি এই সেদ্ধ চাল বাঙালি রসুইয়ে পরিচিত নয়। পায়েস থেকে স্যালাড, সবই ভাল হয় এ দিয়ে। পশ্চিমবঙ্গে খুব কম চাষি জৈব ফসলের সার্টিফিকেট পেয়েছেন। দীর্ঘ, দুরূহ সেই প্রক্রিয়া, বৃহৎ এলাকায় চাষিদের সমন্বয়, শৃঙ্খলা চাই। পশ্চিম মেদিনীপুরের নয়াগ্রামের মেয়ে চাষিরা সে পরীক্ষায় পাশ করেছেন। পরিদর্শক সংস্থা প্রতি বছর মাটির নমুনা, চালের নমুনা যে কোনও সদস্যের খেত থেকে সংগ্রহ করে পরীক্ষা করে। কখনও কোনও রাসায়নিক মেলেনি।
মিলবে কী করে? সার মেয়েরা বাড়িতেই বানায়, গোবর, গোচোনা, রসুন, গুড়, বেসন, আর সামান্য কেরোসিন দিয়ে। দিশি ধানে পোকা তেমন লাগে না, দূরে দূরে পুঁতে চাষ হয় বলে মজুর খরচও কম। দাম কিন্তু বেশি। লাল স্বর্ণ যেখানে মেয়েরা বিক্রি করতেন তেরো টাকা কিলো, সেখানে এখন কালাভাত বিক্রি করেন চৌত্রিশ টাকা কিলো দরে। একটি সর্বভারতীয় অসরকারি সংস্থার সাহায্যে অনলাইনে চাল বিক্রি করে ‘আমন’ কোম্পানি। এ বছর জ্যৈষ্ঠ মাসে দু’শো টন কালাভাতের বরাত মিলেছে। আরও আছে হলুদ চাষ, আর শালপাতার থালাবাটি তৈরি। ধান, হলুদ, শালপাতা মেম্বার চাষিদের থেকে ভাল দরে কিনে, খদ্দের খুঁজে বিক্রি করে ‘আমন’। সরকারি মেলাতেও ডাক পায়।
সমস্যা কি নেই? হাজার সমস্যা, লক্ষ ঝামেলা। এক বৃষ্টিহীন শ্রাবণ দিনে সে সব কথা শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, কেন এই মেয়েদের, এবং এদের মতো অগণিত ছোট উদ্যোগপতিদের চাহিদা, হয়রানি, সঙ্কটের কথা জানতে চাইলে ছুটে আসতে হয় গ্রামে? কলকাতা কেন তার খবর রাখে না? সেখানে সরকারি কর্মীর ডিএ, সরকারি চাকরিপ্রার্থীর রোষ, সরকারি সুযোগ-সুবিধে না পাওয়ার ক্ষোভ, সরকারি খয়রাতি নিয়ে বিতর্ক— এমন ক’টা প্রসঙ্গই গণমাধ্যমে ঢেউ তোলে। সারা দিন কোটি কোটি কথা ফেনার মতো বিজবিজ করতে থাকে। অথচ, সরকারি প্রকল্প জনজীবনের কতটুকু স্পর্শ করতে পারে? শহর-গ্রাম-মফস্সলের মানুষদের কর্মজীবনের বেশিটাই হল বাজারের সঙ্গে লেনদেন। তা সত্ত্বেও আজ উন্নয়নের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে— সরকার গরিবকে কী দিচ্ছে? অথচ, অনেক জরুরি প্রশ্ন হল, দরিদ্র, প্রান্তিক মানুষ যখন নিজের শ্রমের শক্তিতে, নিজের সংগঠনের জোরে বাজার ধরে স্বনির্ভর হতে চাইছে, তখন সরকার তার জন্য কী করছে? যদি দেখা যায় তেমন কিছুই করছে না, বরং তাচ্ছিল্য-অবজ্ঞা-ঘুষের দাবি দিয়ে তাকে বাধা দিচ্ছে, তা হলে বোঝা যায় যে সরকার আসলে দারিদ্র তৈরিতে মদত দিচ্ছে। সরকারি প্রকল্প-অনুদান তখন ঠ্যাং ভেঙে দিয়ে ক্রাচ উপহার দেওয়ার শামিল।
নয়াগ্রামের চাষিদের কোম্পানি সরকারি অবজ্ঞার একটা ‘কেস স্টাডি’ হতে পারে। ধরা যাক দুটো দিক। এক, শালপাতার থালাবাটি বানানোর কারখানায় বিদ্যুতের সংযোগ। বহু ধরা-করার পর প্রথম বার পরিদর্শনে এসে রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদের কর্তারা ‘কোটেশন’ দিলেন, জমা দিতে হবে আশি হাজার টাকা। মেয়েদের পক্ষে তা অসম্ভব। আবার কয়েক মাস ধরে কাকুতিমিনতি, আবার পরিদর্শন, এ বার বলা হল পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা। শালপাতার থালা তৈরিও বিদ্যুৎ কোম্পানির খাতায় ‘বাণিজ্যিক উদ্যোগ,’ চাষির সেচ পাম্পের বিদ্যুতের দামও ধার্য হয় বাণিজ্যিক হারে। কারখানায় লাইন এল, তিন-চারটে মেশিন বসল। কিন্তু গোটা গ্রামে দশ কিলো ভোল্টের (কেভি) লাইন, কারখানা টেনে নেয় দু’কেভি, গ্রামের ঘরে আলো নিবুনিবুু হয়, তারা মেয়েদের উপর রেগে ওঠে। আবার চাষিরা সেচ পাম্প চালালে মেয়েদের মেশিন বন্ধ। এ এক দৈনন্দিন বোঝাপড়া। তার পরেও ফ্যাসাদ, ভোল্টেজ এত ওঠা-নামা করে যে, মেশিন বার বার খারাপ হয়ে যায়। স্থানীয় মিস্ত্রি তা সারাতে পারে না, বহু টাকা দিয়ে মিস্ত্রি আনতে হয় কলকাতা থেকে। কেন সাধ্যাতিরিক্ত খরচ করেও ভাল মানের বিদ্যুৎ জোটে না, কেন গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহের এই দশা, কেন ব্লকে ব্লকে আইটিআই থাকলেও প্রশিক্ষিত ইঞ্জিনিয়ার মেলে না, এ প্রশ্নগুলো পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক প্রশ্ন হয়ে ওঠে না। সেই জন্যেই আজ রাজনীতির আলোচনা এত অসার, বিরক্তিকর। বড় বড় কথার চেয়ে ছোট ছোট কাজ অনেক দামি।
তেমন কি হচ্ছে না? হচ্ছে বইকি। কালাভাত ধান ভানাতে নিজেদের চালকল তৈরি করতে হয়েছে মেয়েদের, কারণ সাধারণ চালকলে ভানালে দিশি ধানের স্বাদগন্ধ নষ্ট হয়। তার জন্য আড়াই ডেসিমল মতো জমি লেগেছে। ব্যবস্থা করেছেন কে? বড়খাঁকড়ি পঞ্চায়েত প্রধান ভবেশচন্দ্র মাহাতো। কিন্তু সরকারি খাস জমি থেকে চালকলের জমি আসেনি, এসেছে তাঁর নিজের জমি থেকে। খাসজমি বেদখল, ওঠাতে বাধা পেতে হবে। কোন দল করেন, প্রশ্ন করতে ভবেশবাবু বললেন, “আমি অন্যায়ের প্রতিবাদ করি।” এই আজ গ্রামীণ রাজনীতির পরিচয়। দলীয় সংগঠনের জোরে নেতার অট্টালিকা তৈরি হয়, গরিবের উন্নয়ন হয় ব্যক্তির উদ্যোগে।
বৈষম্যের অনেক পুরনো ধারা আজও বয়ে চলেছে। যেমন, ‘আমন’-এর আড়াই হাজার মেয়ে চাষি, কিন্তু নিজের নামে জমি আছে ক’জনের। ফলে, কৃষিঋণের কোনও ভূমিকা নেই এত বড় উদ্যোগে। তেমনই, কৃষি-উৎপাদনের যন্ত্রশক্তি এখনও মেয়েদের নাগালেন বাইরে। “আমরা কোদাল চালাই, লাঙল চালাই না,” বললেন মেয়েরা। পাওয়ার টিলার বা ট্র্যাক্টরে মেয়েদের মালিকানা নেই, চালানোর প্রচলনও নেই। পরিবারের যত জমিই থাক, মেয়ে মানেই ঠিকা চাষি। এই সব বিধি ভাঙবে কে, রাজনীতি ছাড়া?
কে কবে কী করবে, তা ভেবে মেয়েরা বসে থাকে না, এই যা ভরসা। পাঁচটা মেয়ে জুটলে মনের কথা মুখে ফোটে। পুকুরিয়া গ্রামে আঁকাবাঁকা হরফে সে সব কথা ফুটছে মাটির দেওয়ালে— ‘নতুন সমাজ গড়তে গেলে, সমান ভাগ মেয়ে ছেলে’। কিংবা, ‘দিলে শিক্ষা, নিলে যত্ন, আনবে মেয়ে ভারতরত্ন’। এ-ও কিন্তু রাজনীতির দেওয়াল লিখন।