আজকাল প্রায়শই শোনা যায় বণ্টন-বৈষম্যের কথা। কোভিড-এর টিকা, ত্রাণ-প্যাকেজ, সরকারি অনুদান— সর্বত্র এক আলোচনা। সম্পদ ও পরিষেবা যখন দুর্লভ, সর্বক্ষেত্রে তার ন্যায্য বণ্টন সাধারণত হয় না। মানুষ বলেন, “এটা কিন্তু সুবিচার হল না।” এই সুবিচারের ধারণা মূলত নৈতিক এবং সামাজিক সম্মতির উপর প্রতিষ্ঠিত। আমেরিকান দার্শনিক জন রলস তাঁর বিখ্যাত বই, আ থিয়োরি অব জাস্টিস-এ উপস্থাপনা করেন বিতরণে ন্যায়ের এক রূপরেখা, যা ‘ডিফারেন্স প্রিন্সিপল’ বলে পরিচিত। মনে রাখা দরকার, সমতা ও ন্যায্যতার ফারাক। সুযোগের সমতা ও পছন্দের স্বাধীনতা গণতান্ত্রিক আদর্শের বুনিয়াদ। কিন্তু পিছিয়ে পড়া মানুষের উন্নতির জন্য নেওয়া সিদ্ধান্ত অনেক সময় অসমান লাগলেও, প্রকৃতপক্ষে তা হয়ে ওঠে ন্যায্য। অধিকাংশ অনুদানের নীতির জন্ম এই ভাবনা থেকে। এখানেই প্রয়োজন সরকারের স্থির প্রত্যয় ও মানসিকতা, যা হতে হবে সামাজিক, অর্থনৈতিক, ভৌগোলিক এবং রাজনৈতিক স্তর ও বিভাজনের ঊর্ধ্বে। নির্ধারণ করতে হবে ন্যায্য নীতি, একুইটি ও ন্যায়ের ধারণাকে কেন্দ্র করে, নাগরিকের বর্তমান অবস্থার উন্নতির প্রয়াসে।
প্রতিটি রাজনৈতিক দল নিজস্ব কর্মসূচি ও প্রতিশ্রুতিকে সামনে রেখে নির্বাচনে লড়াই করে। অবশ্য অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, সরকার গঠনের পর তাদের নীতিগত দিশা বেশ কিছুটা বদলে গিয়েছে। আবার কখনও চোখে পড়ে এক মৌলিক সমস্যা— যখন সরকার দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠতে পারে না। পালন হয় না ‘রাষ্ট্রধর্ম’। বার বার দেখা গিয়েছে, কাগজকলমে সরকারি নীতি এক, আর তার রূপায়ণ অন্য। পার্থক্যটা তা হলে কোথায় তৈরি হয়— ভুল নীতিতে, না কি তার বাস্তবায়নে? বিশেষত অন্যায্য বণ্টন এই প্রশ্নের সম্মুখীন করে।
বস্তুত, ভাবাদর্শের আঙ্গিকে তৈরি হয় নীতি। কিন্তু পরিস্থিতির চাপে মূলনীতি রূপায়িত হয় পরিবর্তিত ভাবে। এই রূপান্তর ও রূপায়ণের মধ্যেই প্রকাশ পায় সরকারের বিচারবুদ্ধি বা মানসিকতা, যাকে ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো বলেছিলেন ‘গভর্নমেন্টালিটি’। বাস্তবতা থেকেই সৃষ্টি এই মানসিকতার। আবার বাস্তবকে সামাল দিতে বিভিন্ন কৌশলেরও জন্ম এই মানসিকতা থেকে। বণ্টনের রাজনীতির মূলে আছে গভর্নমেন্টালিটি। এর বহিঃপ্রকাশ যে সব সময় এক হবে, তা নয়। বরং তার কৌশলগত নমনীয়তা সাহায্য করে বণ্টনের রাজনীতিকে। ইতিহাস দেখলে বোঝা যায়, বাস্তব পরিস্থিতির পরিবর্তনে ‘ওয়ার্ল্ড-ভিউ’ বদলে যায় অনেক সমাজে। সংশোধিত হয় আদর্শ। শুরু হয় নতুন নীতি। এ ভাবেই কল্যাণের আদর্শ থেকে সরে নব্য-উদারনীতির পথ বেছে নেয় কোনও রাষ্ট্র।
সংবাদমাধ্যম অনুসারে, ১ মে থেকে ১২ মে পর্যন্ত প্রায় ৩৪.৬৬ লক্ষ ১৮-৪৪ বছরের নাগরিকের টিকাদান হয়েছিল। কেন্দ্রের নীতি ছিল, প্রতি রাজ্যের ১৮-৪৪ বছরের জনসংখ্যার নিরিখে রাজ্যভিত্তিক টিকার কোটা নির্ধারণ হবে। বাস্তবে এই নীতি ফলপ্রসূ হয়নি। শুধু ভারতে নয়, কোভিড টিকাবণ্টন স্পষ্ট করেছে বিশ্বব্যাপী বৈষম্যের আর্থ-ভৌগোলিক উন্নয়নগত বিন্যাস। তাই, এক দেশে টিকাকরণ শুরুই হয় না অথচ, অন্য এক দেশে তা প্রায় সমাপ্তির মুখে।
সচরাচর দেখা গিয়েছে, বণ্টন রাজনীতির পিছনে আছে চার প্রধান কারণ। প্রথমত, সরকারের বাছাই করার কৌশল। অর্থাৎ, কিছু বিশেষ জায়গা ও শ্রেণিকে আনুকূল্য প্রদানের সিদ্ধান্ত। আবার কখনও দেখা যায় এই কৌশল নেওয়া হয় বিশেষ সময়কালের জন্য। ভোটের রাজনীতি ও প্রতিশ্রুতি প্রায় সেই রকম। দ্বিতীয়ত, স্থান-ভিত্তিক বিতরণের সিদ্ধান্ত। স্থানীয় জায়গায় বিশেষ সুবিধার প্রয়োজনে, কোনও প্রভাবশালী গোষ্ঠী একজোট হয়ে প্রশাসনের উপর চাপ সৃষ্টি করায় যা প্রকাশ পায়। তৃতীয়ত, বৃদ্ধি-কেন্দ্রিক বিতরণের সিদ্ধান্ত, যা প্রাথমিক ভাবে সুযোগ-ভিত্তিক। এই পরিস্থিতির সূত্রপাত হয় এক জোটগঠনের মধ্য দিয়ে, তাতে থাকতে পারেন শীর্ষ শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও প্রতিপত্তিশালী মানুষজন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থিতি অনেকটা এক শোনালেও সূক্ষ্ম ফারাক আছে। দু’টি ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভোক্তার স্বার্থান্বেষণ। মনে রাখা দরকার, প্রথম অবস্থানের পিছনে কাজ করে বণ্টনকারীর দৃষ্টিভঙ্গি, যা ভোক্তার থেকে আলাদা। তাই তার গুরুত্ব বেশি। চতুর্থ কারণ রাজনৈতিক ও আইনি ব্যাখ্যার সংমিশ্রণে সৃষ্ট এক পরিস্থিতি, যা ইটালীয় দার্শনিক জর্জিয়ো আগামবেন-এর মতে, ‘ব্যতিক্রমী পরিস্থিতি’। প্রয়োজনের খাতিরে তৈরি এক কৌশল, বিশেষ লোক বা শ্রেণির জন্য। আইনের গণ্ডি যেখানে শিথিল।
প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মোকাবিলায় সরকার ত্রাণ প্যাকেজ দেয়। কিন্তু এমনও দেখা যায়, রাজ্যগুলি ভিন্ন পরিমাণে সাহায্য পাচ্ছে। এর সঙ্গে চলে আসে দুর্লভ সম্পদ বণ্টনের কৌশল ও তার রাজনীতি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যা একুইটি ও জাস্টিস-এর মতাদর্শ থেকে দূরে। উপেক্ষিত হয় প্ল্যানিং, পলিসি।
মনে রাখতে হবে, সরকার সবার। তাই শাসকের সিদ্ধান্ত ও কার্যপ্রণালী হতে হবে নাগরিক স্বার্থের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। তবেই প্রকাশ পাবে শাসকের যথার্থ মানসিকতা।