ধর্মান্তরণ করাতে জেলাশাসকের কাছে দরখাস্ত করুন।’ কাফকার কাহিনি নয়, আবোল-তাবোল’এর একুশে আইন নয়, ভারতের একাধিক রাজ্যে আজ এটাই বিধি। প্রতিযোগিতা বেধেছে, কোন রাজ্য কত জবরদস্ত আইন করে বাকিদের টেক্কা দেবে।
এটুকু লিখে আটকে গেলাম। লিখতে যাচ্ছিলাম, ধর্ম আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। কী দিয়ে ভাত মাখব তা যেমন সরকার বলে দেবে না, কোন ধর্ম মানব তাও নয়। কিন্তু সত্যি তো, বাংলায় বসে বোঝা মুশকিল, দেশের অন্যত্র খাওয়াদাওয়ার কত বিধিনিষেধ। অতএব ধর্মের মতো গুরুতর বিষয়ে হাকিমের হুকুম আশ্চর্যের কী?
বাদ সাধছে সংবিধানে ধর্মীয় স্বাধীনতার একটা বেয়াড়া ধারা। তাই সাফাই গাইতে হচ্ছে, নিষেধ কেবল জোর করে ধর্মান্তরণে। শাসিয়ে ভয় দেখিয়ে ধর্মান্তরণের কতটা অবকাশ তা স্পষ্ট নয়; তা ছাড়া বলপ্রয়োগ, ভীতিপ্রদর্শন, ব্ল্যাকমেল ইত্যাদির বিরুদ্ধে তো এমনিতেই আইন আছে। প্রলোভনের প্রশ্ন হয়তো উঠতে পারে। কোনও ধর্মীয় সংগঠন ভাল স্কুল বা হাসপাতাল চালায়, সুশিক্ষা বা সুচিকিৎসার টোপ ফেলে ধর্মান্তরণ অসম্ভব নয়, কিংবা চাকরি দিয়ে। প্রশ্ন একটাই: সরকার কি সমমানের স্কুল বা হাসপাতাল চালাতে পারে না? পারে না কর্মসংস্থান করতে? এগুলোই তো সরকারের কাজ বলে জানতাম। বলা হয়, দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে ধর্মান্তরণ ঘটছে। সে ক্ষেত্রে ধর্মান্তরণ বন্ধের চেয়ে দারিদ্র লাঘব করাই জরুরি নয় কি?
আরও প্রশ্ন আছে। ধর্মে পরকালের চিন্তা ওঠে। স্বর্গসুখও কি প্রলোভন? সংসারসুখ প্রেম ভালবাসা তো অবশ্যই। অন্তত একটি রাজ্যের আইনে বিয়ের প্রস্তাবও প্রলোভন। তর্ক উঠলে বলা হয়, আপত্তি কেবল প্রতারণা বা ব্যভিচারের ক্ষেত্রে। আইনে কিন্তু সেটা স্পষ্ট নয়। তা ছাড়া প্রতারণা দ্বিবিবাহ ইত্যাদির বিরুদ্ধে অন্য আইন আছে, স্বধর্মের পরিধিতেও এমন অপরাধ বিলক্ষণ ঘটে। নতুন আইনের আসল লক্ষ্য, ভিনধর্মে বিয়ে কার্যত অসম্ভব করে তোলা। ‘লাভ জেহাদ’ নামক বায়বীয় অপরাধ নিয়ে যতই আসর গরম হোক, আইনগ্রাহ্য তথ্যপ্রমাণের অভাব দেখা যায়। অতএব সহজ সমাধান, অমন বিয়ে মাত্রেই আইনবলে বরবাদ করে দাও।
এমন আইনে দেশব্যাপী সাংবিধানিক শাসনের সঙ্গে দায়িত্বহীন খণ্ডস্বার্থের সম্পর্কটা উল্টে যাচ্ছে। গোষ্ঠীবিশেষ অনেক কিছু চায় যা সংবিধান তথা মানবাধিকার লঙ্ঘন করে। আইনের কাজ সেই দাবিগুলি নিয়ন্ত্রণ করা। এ ক্ষেত্রে কিন্তু দেখা যাচ্ছে, কোনও স্বৈরাচারী গোষ্ঠী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, অপর কিছু মানুষের স্পষ্টত ক্ষতিসাধন করে। আইন সেই অনাচারের রাশ টানছে না, বরং ন্যূনতম দূরত্ব বজায় রেখে অনুমোদন করছে; ফলে আইনকে শিখণ্ডী রেখে অনাচার মান্যতা পাচ্ছে। অন্যায় যাচ্ছে আগে পথ দেখিয়ে, ন্যায় তার পিছনে তল্পিবাহক হয়ে।
‘জাতীয়তাবিরোধী’, ‘শহুরে নকশাল’, ‘লাভ জেহাদ’ প্রভৃতি শব্দের সংজ্ঞা আইনে দূরস্থান, সাধারণ যুক্তিতথ্যের বিচারেও অসার। কিন্তু অবিরাম দক্ষ প্রচার করে আওড়ে জনতাকে খেপিয়ে তোলা যায়। এই হিংসা আর বিদ্বেষের চাষে আইনকে শামিল করলে তার ভাব আর বয়ান দুটোই পাল্টাতে হয়। সর্বোচ্চ বিচারপতি থেকে শুরু করে অনেকে অনুযোগ করেছেন, এই আইনগুলির ভাষা এত অস্বচ্ছ ও সর্বগ্রাসী যে, তাতে যে-কাউকে ফাঁসিয়ে দেওয়া যায়। আরও কিছু ভয়াবহ প্রবণতা মাথাচাড়া দিয়েছে। আইনশাস্ত্রের নীতি বলে, অভিযুক্ত ব্যক্তি দণ্ডিত না হওয়া অবধি নির্দোষ গণ্য হবে; অর্থাৎ অপরাধ যে ঘটেছে, অভিযোগকারীকে তা প্রমাণ করতে হবে। একটার পর একটা নতুন আইন কিন্তু শুরুতেই ধরে নিচ্ছে যে অভিযুক্ত ব্যক্তি অপরাধী: নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের দায় তার উপর। আটক, জামিন ইত্যাদির প্রচলিত বিধি বলে-কয়ে পরিহার হচ্ছে কোনও কোনও আইনে। বা বিস্ময়কর ভাবে বলা হচ্ছে, আইনটা আদালতের এক্তিয়ারের বাইরে!
অর্থাৎ আইনকে স্বধর্মচ্যুত করে ‘অ-ন্যায়’ আত্মঘাতী ভূমিকায় নামানো হচ্ছে, তাতেও না কুলোলে স্রেফ নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হচ্ছে। বাড়তে বাড়তে এই প্রবণতার সম্প্রতি এমন অবিশ্বাস্য নজির ঘটেছে যে নয়-নয় করেও কিছু ধিক্কার প্রতিবাদ শোনা যাচ্ছে, ফল যদিও শূন্য।
বিশেষ নিশানায় দুটো ঘটনা, হরিদ্বারে আর দিল্লিতে। সেখানে দুই সমাবেশে কিছু সাম্প্রদায়িক নেতা আহ্বান জানিয়েছেন, দেশ জুড়ে মুসলমানদের নির্বংশ করতে। অন্যথায় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এমন আন্দোলনের হুমকি দিয়েছেন, যা ১৮৫৭-র অভ্যুত্থানকে ছাড়িয়ে যাবে।
মুসলিমদের উদ্দেশে বহু কাল, এবং উত্তরোত্তর খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধেও, জঘন্য বিষোদ্গিরণ আজ ডালভাত। ওই সমাবেশের উক্তিগুলি সেই মামুলি ‘হেট স্পিচ’কে বহু যোজন ছাড়িয়ে রীতিমতো জাতিনিধন বা জেনোসাইডের ডাক দিচ্ছে, আক্ষরিক ভাবেই করছে ‘দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা’। আজকের ভারতে একটা স্লোগান বা কৌতুকের দৌলতে, পরিবেশ আন্দোলন করা মায় মুমূর্ষু রোগীর জন্য অক্সিজেন খোঁজার ফলে সন্ত্রাস ও রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে পড়তে হয়। হরিদ্বার-দিল্লির অপরাধীরা কিন্তু অশেষ প্রশ্রয়ভোগী, যেমন আইনের হাতে, তেমনই আমাদের পরম প্রগল্ভ নেতাদের নীরবতায়। একমাত্র উপরাষ্ট্রপতি ধিক্কার জানিয়েছেন, তাও সরাসরি নয়। শাসক শিবির যে নির্বিকার, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। বিরোধী দলগুলি তাদের মৌনের লজ্জা কোথায় ঢাকবে তারাই জানে, যদি লজ্জাবোধ আদৌ অবশিষ্ট থাকে।
মোক্ষম প্রশ্নটা কিন্তু আমাদের নিজেদের প্রতি। স্বীকার করতেই হয়, অনেকে বুক ফুলিয়ে করবেন— সমাজের এক ক্রমবর্ধমান অংশ আজকের হিংসা-বৈরিতা-অপরায়ণের উৎসবে সোৎসাহে অংশ নিচ্ছে। বাংলার অপেক্ষাকৃত উদার আবহেও যে বিদ্বেষ আর আস্ফালন নিত্য দেখা যাচ্ছে, বিশ বছর আগে তা মনে পুষলেও লোকে মুখে আনত না, মনে পুষতও হয়তো কম। দুই প্রজন্ম বাদে দেশভাগের ক্ষতগুলো অনেকটা শুকিয়ে এসেছিল, আবার খুঁচিয়ে তোলা হচ্ছে। এমন উদ্যোগ সর্বত্র: গুরুগ্রামে শিখ সম্প্রদায় যখন মুসলিমদের নমাজ পড়ার জায়গা দিতে উদ্যত, হিন্দুত্ববাদীরা রীতিমতো বই ছাপিয়ে বিলি করল, কয়েক শতক আগে মোগলদের হাতে শিখদের উৎপীড়ন স্মরণ করিয়ে।
আমরা কি সত্যিই লাগাতার বিদ্বেষ-বিভাজন-হিংসার মধ্যে জীবন কাটাতে চাই, সন্তানকুলকেও সেই গহ্বরে নিক্ষেপ করতে চাই? অনেকে বলবেন, একশো বার— শেষ দেখে, শেষ করে ছাড়ব। শেষ কিন্তু হয় না কোনও দিন। খাঁচা থেকে বাঘ বেরোলে শুধু পড়শির গরু-ছাগল মারে না, মারে আমাদেরগুলোও, শেষে আমাদেরও। ইতিহাসের অমোঘ শিক্ষা, কোনও রাজত্ব হিংসা-বিদ্বেষের আবর্তে একবার ঢুকলে বেরোতে পারে না। সেটাই তাদের চালিকাশক্তি, অস্তিত্বের মূলমন্ত্র। একটা শিকার নিঃশেষ হলে তাই আর একটা খুঁজতে হয়, নিজের লোকও রেহাই পায় না। বেশি অতীতে যাবার দরকার নেই, একশো বছরেই যথেষ্ট নজির মিলবে।
ভাবতে পারি, আচারবিশ্বাসে ধর্মপালনে আমরা এই জমানার আদর্শ প্রজা, এত কাণ্ড তো আমাদেরই মঙ্গলার্থে। আজ নাহয় কিছু এলোমেলো ব্যাপার ঘটছে, ন্যায়নীতি ঘেঁটে যাচ্ছে; মহৎ কাজে অমন এক-আধটু হয়ে থাকে, দেখো শেষে কেমন স্বর্ণযুগ আসে। ভাল কথা। সেই সোনা আরও নিখাদ করার নিরন্তর চেষ্টায় আমরা শামিল হতে পারব তো? আমাদের দেশ বিশাল ও বৈচিত্রময়, বহুত্ব রক্ষা করেই টিকে আছে। বঙ্গভূমি তো বিশেষ করেই ভিন্ন, স্বকীয়। রাষ্ট্রশক্তি যদি আমাদের জীবনের দখল নিতে চায়, মনুষ্যত্ব বজায় রেখে কত দূর মানতে পারব? উদ্ভট বা ভয়াবহ কিছু কল্পনার দরকার নেই, দুটো অপেক্ষাকৃত সংযত নির্দোষ প্রস্তাবের কথা ভাবা যাক। ধরুন যদি সব রকম আমিষ আহার ত্যাগ করতে বলা হয়? বা সমাজে প্রশাসনে সর্বত্র হিন্দি ব্যবহার করতে? খোলা মনে মেনে নেব তো? দুটোই কিন্তু বাস্তব সম্ভাবনা, আজ না হলে পরশু।
‘আমরাই আদর্শ, আর সকলকে হটিয়ে পিটিয়ে আমরাই শান্তিতে বিরাজ করব’, এমন বলায় তাই বিরাট বিপদ। ‘আমরা’ দলে ভারী হলে বিপদ কমে না, বাড়ে: দফায় দফায় ‘আমরাতর’রা আবির্ভূত হয়, ঝাঁপিয়ে পড়ে বাকিদের হটাতে। যে ‘আমরা’র পরিপূরক কোনও ‘ওরা’, তার অবস্থান চিরকাল অস্থির। কোনও রাশেই তা শান্ত হওয়ার নয়, রাষ্ট্রের বাঁধন যত শক্ত তত আলগা প্রমাণ হয়। রবীন্দ্রনাথ এমন একটা কথা বলেছিলেন বিদেশি শাসকদের স্বৈরাচার সম্বন্ধে। সব স্বৈরাচারেরই কিন্তু চরিত্র এক। খানিক অন্য ভাবে কথাটা আমাদের যুগেও খাটে।