ভাবের ভাষা আর শব্দের ব্যবহার নিয়ে সাহিত্য থেকে রাজনীতির আঙিনা সতত উত্তাল। রবীন্দ্রনাথের ‘শ্রেষ্ঠ ভিক্ষা’ কবিতা পড়ে এক বিজ্ঞ ধার্মিক খ্যাতিমান লোক লজ্জা পেয়েছিলেন; অভিযোগ করেছিলেন, এ ছেলেমেয়েদের পাঠযোগ্য কবিতা নয়। সাহিত্যে এমন অভিযোগ অনেক ভাষাতেই আছে। লেখকের ভাবনা প্রকাশের সঙ্গে সংস্কারাচ্ছন্ন সাধারণ মানুষের ভাবনার অমিল প্রায়ই লক্ষ করা যায়। রাজনীতিতে ভাষা প্রায়ই কুকথা ও অসাংবিধানিকতার পর্যায়ে চলে যায়। ক্ষমতার দম্ভ প্রকাশে শব্দের প্রয়োগ হয়ে ওঠে বিকৃত। প্রতিটি শব্দের যে অর্থ ও ব্যঞ্জনা, যথার্থ প্রয়োগের অক্ষমতা ও অসংযম সেই শব্দ ও ভাষাকে কলুষিত করে।
মৌখিক ভাষা মার্জিত হতে হতে বইয়ের ভাষায় উন্নীত হলে শব্দ নিয়ে সমস্যা কম হয়। বাংলায় বইয়ের ভাষা আর মৌখিক ভাষা আলাদা ছিল, সংস্কৃত ও প্রাকৃতের সঙ্গে প্রচলিত শব্দ মিশে শুরু হয়েছিল লেখার ভাষা। চট্টগ্রাম থেকে বাঁকুড়া-পুরুলিয়া, বিস্তীর্ণ বাংলায় কথার ভাষার বৈচিত্র কিন্তু লেখায় দেখা যায় না, সে ভাষা মার্জিত, নাগরিক।
শব্দের পরিচয় তার ব্যবহারে। পারিবারিক কিছু সম্পর্ক-শব্দ— যেমন ‘শ্যালক’— কথ্য ভাষাসূত্রে শহুরে নাগরিকের কাছে কুশব্দ হিসেবে ব্যবহার হতে লাগল, আধুনিক লেখাতেও চলে এল। একই ভাবে ‘ভগ্নীপতি’ সম্পর্ক নিয়েও কথ্য গালি রয়েছে, তার ব্যবহার সচরাচর লেখায় দেখা যায় না, কিছু জনজাতির মানুষ আজও সে ভাষারই পরিচয় বহন করেন। ইদানীং শিক্ষিত ভদ্রসমাজে হিন্দি বা বাংলা ‘স্ল্যাং’-এর বদলে তার ইংরেজি প্রতিশব্দ ব্যবহারের প্রচলন বেড়েছে। ব্যবহারের উদ্দেশ্য সম্মানজনক বা অসম্মানজনক হতে পারে। কিছু শব্দ প্রতীক রূপে কাজ করে, কিছু সরাসরি গালাগালি রূপে। বাড়িতে, রাস্তাঘাটে, হাটে বাজারে, কাজের জায়গায় বহু অসম্মানজনক শব্দের ব্যবহার হয়ে থাকে, বহুলপ্রয়োগের ফলে যা সহজ সাধারণ বলে মনে হয়। অতিব্যবহারে অনেক গালাগালিও আর রাগ বা অপমানের উদ্রেক করে না তেমন। তার উপর শহর ও গ্রামের ভৌগোলিক দূরত্ব যত কমেছে, দুইয়ের ভাষা ও সংস্কৃতিও কাছে এসেছে। গ্রামের অনেক ‘মেঠো’ কথা ‘নাগরিক’ হয়ে গেল, কারণ গ্রামই এখন শহুরে হয়েছে। আবার বাংলা ছাড়া অন্য ভাষার, যেমন হিন্দিতে বহুব্যবহৃত অনেক শব্দ— যা বাংলাভাষীর কাছে নিন্দনীয় বা গালাগালি— অনায়াসে বাংলা শব্দভান্ডারে স্থান পেল। এই ‘খিচুড়ি বাংলা ভাষা’ও আজ সমাজ ও রাজনীতিতে নানা সমস্যার উৎস।
কিছু শব্দ আছে, যা কোনও ব্যক্তিকে অপমানের উদ্দেশ্যে বলা হলেও তা একটা বিশেষ গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে। সমাজ সেই গোষ্ঠীর মানুষের ক্ষেত্রে সংবেদনশীল হয়ে যায়, নাগরিকসমাজ থেকে প্রতিবাদও আসে। আপাত ভাবে সে সব শব্দ হয়তো খুব সাধারণ কিন্তু তাদের ব্যবহার নিন্দাসূচক, অপমানজনক। সাহিত্যে, মুখের কথাতেও ‘বেশ্যা’ শব্দের অসম্মানজনক প্রয়োগ বহু কাল চলে আসছে, কিন্তু আধুনিক সমাজের একাংশ এই জীবন ও জীবিকাকে সম্মান করতে পারায় তাঁদের মধ্যে সে সম্মানবোধ স্ফুট হয়েছে। সিনেমা, সাহিত্য ও মুখের কথায় আকছার এমন কিছু শব্দ ব্যবহার করা হয়ে থাকে শারীরিক বা মানসিক ভাবে অপূর্ণ বা অসুস্থ ব্যক্তির ক্ষেত্রে যা প্রযোজ্য। ‘কানা’, ‘কালা’, ‘বোবা’, ‘ল্যাংড়া’, ‘খোঁড়া’, ‘পাগলা’ ইত্যাদি শব্দ বলা হয় তথাকথিত সাধারণ ব্যক্তিকে উদ্দেশ করেও, রাজনীতির মঞ্চ থেকে তো উচ্চৈঃস্বরে। মানুষের নানা প্রতিবন্ধকতাকে ব্যঙ্গ ও আঘাত করে এমন শব্দের উচ্চারণ একটা গোটা গোষ্ঠীকে অপমান করছে, আইনত যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কোনও দুর্বৃত্তের উদ্দেশে এ সব শব্দ বলা হলেও, এ-হেন প্রয়োগে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত গোষ্ঠীর মানুষেরাও বিনা অপরাধে ওই সব শব্দের দ্বারা চিহ্নিত হয়ে যান; বিষণ্ণ, অবসন্ন হন। রাজনীতির কারবারিদের এই নিম্নরুচির তীব্র প্রতিবাদ উঠে আসা উচিত সমাজ থেকে, এ ধরনের শব্দপ্রয়োগ হলে আইনানুগ পদক্ষেপ প্রয়োজন। রাজনীতিকরা অনেক ক্ষেত্রে বিকৃত স্বরপ্রক্ষেপণও বেছে নেন, সেও অত্যন্ত নিম্নরুচির পরিচয়।
সম্প্রতি দিল্লির ‘রাজপথ’ নাম পাল্টে গেল। প্রধানমন্ত্রী বললেন, রাজার দিন গিয়েছে, এখন আর রাজা নেই— তাই রাজপথও থাকবে না। এখন শুধু কাজ, তাই রাস্তার নাম হল ‘কর্তব্য পথ’। তা হলে অন্য যে সব শব্দের আগে ‘রাজ’ উপপদ বসে আছে, তাদের সবারই কি পরিবর্তন দরকার— কর্তব্যধানী, কর্তব্য ভবন, কর্তব্য ভাষা ইত্যাদি? অথচ রবীন্দ্রনাথ ‘রাজা’ শব্দটিকে কী সুন্দর করে ব্যবহার করেছিলেন, গণতন্ত্রের মূল মন্ত্র স্বীকার করে সবাইকে রাজা করে তুলেছিলেন— ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে’। গণতান্ত্রিক দেশের শাসক কেন এ ভাবে ভাববেন না, অন্যদের ভাবতে শেখাবেন না! শব্দের প্রয়োগ, গ্রহণ বা বর্জনের মধ্য দিয়ে দ্বন্দ্ব ও দ্বেষের রাজনীতি আজ সারা দেশের মানুষকে বিভাজিত করছে, হিংস্র করে তুলছে। শব্দ ব্যবহারের আগে ভাবা উচিত তার প্রয়োগের যথার্থতা— সে সাহিত্যেই হোক বা মুখের কথায়, পথেই হোক বা রাজনীতির মঞ্চে। শব্দ যেন শব্দবাণ হয়ে কাউকে তীব্র আঘাত না করে। তার চেয়ে চুপ করে থাকা, শব্দহীন হওয়া ঢের ভাল।a