USSR

ত্রিশ বছর, কেউ কথা রাখেনি

রুশ রাজনীতি এখনও সোভিয়েটের আতশকাচেই বিবেচ্য। ইতিহাসের বিচার, অতএব, এখনও হয়নি।

Advertisement

আবাহন দত্ত

শেষ আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০২২ ০৫:৩২
Share:

সোভিয়েট ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হওয়ার পর নবগঠিত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিনের বিরুদ্ধে সাংবিধানিক আদালতে যান পার্টি সদস্যরা। এর পর, ১৯৯২-এর জুলাই থেকে পাঁচ মাস পার্টির বিরুদ্ধেই এক বিচারপর্ব চলে, তা সরাসরি সম্প্রচারিত হয়, আখ্যা পায় ‘রাশিয়ান নুরেমবার্গ’। এই রাজনৈতিক বিচারে যদিও কারও বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ ছিল না। শেষতম পার্টিপ্রধান মিখাইল গর্বাচভ বলেন, এখানে ‘নির্দিষ্ট ব্যক্তি’র ‘নির্দিষ্ট অপরাধের বিচার’ হচ্ছে না। “যে পার্টি নেতারা সত্যিই অপরাধী তাঁরা প্রয়াত হয়েছেন। কেবলমাত্র ইতিহাসই তাঁদের বিচার করতে পারে।”

Advertisement

আজ সোভিয়েট পতনের ৩০ বছরে ইতিহাসের বিচার যদি দেখি? কথা ছিল, রাশিয়ার সোভিয়েট অতীত থেকে মুক্তি এবং আপাদমস্তক গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রসার। জমানা পতনের অত্যুৎসাহে গোড়াতেই জাতীয় পতাকা বা সঙ্গীতের মতো চিহ্ন পাল্টে যায়, কিন্তু ক্রমশ সোভিয়েট গরিমাতেই আশ্রয় নেয় রুশ রাজনীতি। প্রেসিডেন্ট পুতিন বোঝেন, দেশকে বিশ্বশক্তি বানাতে হলে নস্টালজিয়াই শ্রেষ্ঠ পথ, সেই আমলেই তাঁরা শিখরে পৌঁছন। অতএব, ইতিহাসের কিছু ‘গোলমাল’ স্বীকার করেও তিনি ‘নিজেদের উপর অপরাধবোধের বোঝা চাপতে দিতে’ রাজি নন। স্তালিনের অপরাধের হিসাব না নিয়ে তাঁকে ‘গৌরবোজ্জ্বল সোভিয়েট অতীত’-এর বিপ্রতীপে রাখতে বলেন। ইয়েলৎসিন আমলের উনিশ শতকীয় জাতীয় সঙ্গীত বদলে ৮৭ বছর বয়সি সের্গেই মিখালকোভ-কে (সোভিয়েট জাতীয় সঙ্গীতের সৃষ্টিকর্তা) দিয়েই গান লেখানো হয়। অর্থাৎ যা কথা দেওয়া হয়েছিল, কিছুই রাখা হয়নি।

রাখা হয়নি, না কি রাখা যায়নি? ইতিহাস ঘাঁটলে মালুম হবে, একনায়কতন্ত্রী জমানা থেকে যে গণতন্ত্র জন্ম নেয়, সেখানে সুবিচার হয় তৎক্ষণাৎ আসে, নয়তো আসেই না। কমিউনিস্ট অভিজাতবর্গ ১৯৯১-এর ধাক্কা কাটিয়ে ফেলেছিল, ইয়েলৎসিনের সরকার প্রাক্তন কমিউনিস্টদের নিয়েই গঠিত হয়, আইনি বাধা না থাকায় তাঁদের ক্ষমতায় ফিরে যেতেও অসুবিধা ছিল না। ইয়েলৎসিন নিজেই
কেজিবি-র উত্তরসূরি নজরদার পুলিশবাহিনী গঠন করেন। ১৯৯২-এ পার্টি ও কেজিবি কর্তাদের সরকারি পদে আসীন হওয়া ঠেকাতে বিল আসে, যা খারিজ হয়ে যায় পার্লামেন্টে। তত দিনে রাজনীতি, সংবাদমাধ্যম ও অর্থনীতির উপর আবারও সার্বিক দখলদারি তৈরি করে ফেলেছে ভূতপূর্ব ব্যবস্থা।

Advertisement

কিন্তু, তারা পারল কী করে? গণতন্ত্রের যাঁরা ভিত্তি, সেই জনতার দৈনন্দিনতাতেও সোভিয়েট উত্তরাধিকার প্রবল ভাবে সজীব। ’৯০-এর দশকে নতুন জাতীয় সঙ্গীতের ফলে অনুপ্রেরণার এত অভাব ঘটেছিল, যে খেলার মাঠে অ্যাথলিট-ফুটবলারদের পারফরম্যান্সে অবনতি হতে থাকে! দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছুটির দিনটি ‘বিপ্লব দিবস’ থেকে পাল্টে দেওয়ায় ক্ষুব্ধ হন ৬৭ শতাংশ। কেজিবি-র পুর্বসূরি ‘চেকা’কে ‘জনজীবন ও আইনশৃঙ্খলার রক্ষক’ ভাবেন ৭১ শতাংশ, স্তালিনকে সদর্থক ভাবেন ৬৭ শতাংশ, তাঁর মতো নেতা চান ৪২ শতাংশ। ৭৮ শতাংশ যৌথখামারকে শিল্পায়নে প্রয়োজনীয় মনে করেন, এবং ৯১ শতাংশ জানান হিটলার-স্তালিন চুক্তি যথাযথ, ব্রেজনেভের ‘স্থবির’ জমানা আসলে ‘সম্ভাবনার কাল’, এবং সোভিয়েট পতন ‘জাতীয় বিপর্যয়’। আদালত-পর্বের শেষে ৩০ নভেম্বর যখন কমিউনিস্ট পার্টি অব দ্য রাশিয়ান ফেডারেশন নামে নতুন দল তৈরি হল, তিন মাসে সদস্য-সংখ্যা ছাড়াল পাঁচ লক্ষ— নয়া ‘গণতন্ত্র’-এর সর্ববৃহৎ দল।

জনতাকে কি দোষ দেওয়া যায়? না কি উচিত? বিপ্লব রাশিয়ার মাটিতেই হয়েছিল, লক্ষ লক্ষ নাগরিক পার্টির সদস্য ছিলেন, সকলেই জমানার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছিলেন। যে ইতিহাসবিদরা ‘অত্যাচারিত’-এর স্বর তুলে ধরতে ‘মেমোরিয়াল’ গড়েছিলেন, তাঁরাও অনেকে বলশেভিক নেতা বা গুলাগ আধিকারিকের সন্তান। অপরাধের হিসাব নিয়েছিল যে আদালত, সেখানে তেরোর মধ্যে বারো জন বিচারপতি প্রাক্তন কমিউনিস্ট। এমনকি যে সংবিধান বলবৎ ছিল, তা-ও পার্টি-প্রণীত। এখানে তাই শিকার আর অপরাধীর মধ্যে দাগ টানা কঠিন। বস্তুত, পার্টিকে কাঠগড়ায় তুলতে গেলে শুধু কর্মীদের তুলে লাভ নেই, গোটা জাতিকে তুলতে হয়। এ যেন নিজেরাই নিজেদের বিচার করা।

আর তা-ই যদি হয়, তবে কে কার দিকে আঙুল তুলবে? ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত ইয়েলৎসিন নিজেই প্রাদেশিক পার্টিপ্রধান ছিলেন। যাঁরা সত্তর বছর সোভিয়েট-ব্যবস্থায় দিন কাটিয়েছেন, সোভিয়েট পতনে তাঁদের সব গিয়েছে: সামাজিক সুরক্ষাদায়ী অর্থনীতি, বিশ্বশক্তির তকমা, রাজনৈতিক আদর্শ, জাতীয় পরিচিতি। তার উপর অতীতকেও কাঠগড়ায় তোলা? নেতারা বুঝেছেন, দেশটাকে ধরে রাখার জন্যই তা না করা ভাল।

শতধাবিভক্ত মতামতেও রাশিয়া তাই পুরনো পথেই। এখনও তাদের নজরদার পুলিশ ক্ষমতাবান, নাগরিক সমাজ দুর্বল। জরুরিতর কথা, রুশ রাজনীতি এখনও সোভিয়েটের আতশকাচেই বিবেচ্য। ইতিহাসের বিচার, অতএব, এখনও হয়নি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement