কিন্তু, আমরা কোন দিকে?
BJP

কোনও রাজনৈতিক দলই শেষ পর্যন্ত শিল্পীদের পক্ষে থাকে না

ভারতের বিজেপি-বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির উচিত, সমস্ত জটিলতা ও মোহভঙ্গ করে নির্মোহ ভাবে ইতিহাসের পাঠ নেওয়া।

Advertisement

কৌশিক সেন

শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০২১ ০৫:৪০
Share:

জোসেফ স্তালিনের জমানায় লেখা ম্যাক্সিম গোর্কির এক অসামান্য প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল: “হে সংস্কৃতির প্রভুরা, আপনারা কোন দিকে?” লেখক, চিত্রকর, সঙ্গীতশিল্পী, অভিনেতা— আপনারা কোন দিকে? এটা স্পষ্ট করুন। এই ছিল ওই অসামান্য প্রবন্ধটির মূল কথা। গোর্কি প্রশ্ন করেছিলেন, “আপনারা কি পার্টি তথা জনগণের পক্ষে, না কি তার বিপক্ষে?” যদিও স্তালিন জমানায় অগুনতি গুপ্তহত্যা, শ্রেণিশত্রু নিধনের নামে অসংখ্য মানুষের নিপীড়নের যে করুণ ইতিহাস, সে সব পরবর্তী কালে জানার পর বুঝতে অসুবিধা হয় না, ওই সময়ে সোভিয়েট ইউনিয়নে খুব কম সাংস্কৃতিক কর্মীই ছিলেন যাঁরা আনুগত্য স্বীকার করেননি। স্তালিনের ভয়ে বেশির ভাগ শিল্পীই তাঁদের সমর্থন ও আনুগত্য সঁপে দিয়েছিলেন পার্টির কাছে। কত প্রতিভাবান নাট্যশিল্পী খুন হয়েছেন, কত সাংস্কৃতিক কর্মী, লেখক, কবি দেশছাড়া হয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। ঠিক যেমন বের্টোল্ট ব্রেশটকে পালাতে হয়েছিল হিটলারের গুপ্তবাহিনীর তাড়া খেয়ে এক দেশ থেকে আর এক দেশে।

Advertisement

প্রখ্যাত নির্দেশক ও অভিনেতা কনস্তান্তিন সের্গেইভিচ স্তানিস্লাভস্কি (১৮৬৩-১৯৩৮), যিনি না থাকলে গোটা পৃথিবীর অভিনেতা-নির্দেশকরা জানতেই পারতেন না, কী ভাবে পরিকল্পিত ভাবে, সুশৃঙ্খল এবং আশ্চর্য কল্পনাশক্তির সমন্বয়ে তৈরি হতে পারে এক জন অভিনেতার শরীর ও মন। অভিনয়ের স্বাভাবিকতা, তার পর সেই স্বাভাবিকতাকে পার হয়ে আরও অসীম সম্ভাবনার মধ্যে এক দল অভিনেতার যাত্রা, যা আজও গোটা পৃথিবী জুড়ে নানা পরিবর্তন ও ভাঙচুরের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে। সেই যাত্রা শুরুই হত না স্তানিস্লাভস্কির নেতৃত্বে রাশিয়ায় ‘মস্কো আর্ট থিয়েটার’ তৈরি না হলে।

পরবর্তী কালে স্তানিস্লাভস্কির এক অবিস্মরণীয় ছাত্র মায়ারহোল্ড, তাঁর শিক্ষকের থেকে অর্জিত বিদ্যার উপর ভিত্তি করে, বা তাকে অতিক্রম করে তৈরি করেন এক ভিন্ন ধারার অভিনয় পদ্ধতি। তাঁর পদ্ধতি, সৃষ্টির গভীর প্রভাব পড়ে গোটা বিশ্বের নাট্যচর্চায়। ১৯৩০ সালের গোড়া থেকে জোসেফ স্তালিন এক অভূতপূর্ব পরিবেশ এবং পরিমণ্ডল তৈরি করলেন সোভিয়েট ইউনিয়নে। অচিরেই মায়ারহোল্ডের থিয়েটার নিয়ে যাবতীয় পরীক্ষাকে সন্দেহের চোখে দেখা শুরু হল এবং তাঁকে এবং তাঁর নাট্যচর্চাকে দাগিয়ে দেওয়া হল জনবিরোধী, সামাজিক বাস্তবতা বহির্ভূত এক আঙ্গিকসর্বস্ব কর্মকাণ্ড হিসেবে। সরকারি নির্দেশে বন্ধ হল তাঁর থিয়েটার এবং অবশেষে ২৩ জুন ১৯৩৯ সালে গ্রেফতার করা হল মায়ারহোল্ডকে। হিটলারের জার্মানি ছেড়ে ব্রেশট পালাতে পেরেছিলেন। বহু দেশ ঘুরে আমেরিকায় এসে উঠেছিলেন। সে দেশেও তৎকালীন সরকার তাঁকে আন-আমেরিকান অ্যাক্টিভিটিজ় কমিটির তদন্তের মুখে ফেলে, তাঁকে কমিউনিস্ট হওয়ার অপরাধে চূড়ান্ত হেনস্থা করে। মায়ারহোল্ডের ভাগ্য শুধুমাত্র গ্রেফতারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। তাঁর উপর স্তালিনের পুলিশবাহিনী অকথ্য অত্যাচার চালায় এবং অবশেষে তাঁকে গুলি করে মারা হয় ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৪০ সালে।

Advertisement

জগদ্বিখ্যাত স্প্যানিশ কবি ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকাকে হত্যা করে দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিস্ট শক্তি। লোরকার ব্যক্তিগত জীবন, তাঁর বামপন্থী রাজনৈতিক মতাদর্শ— এই সব কিছুই ছিল শাসকদের কাছে সন্দেহজনক, বিপজ্জনক এবং জনগণ তথা দেশের বিরোধী।

এই মুহূর্তে আমাদের দেশে যে বিজেপি সরকার শাসন করছে, তাদের চোখেও যে সব শিল্পী ও সাংস্কৃতিক কর্মী সরকারের বিরুদ্ধে গান গাইবেন, কবিতা লিখবেন, সিনেমা বানাবেন বা নাটক করবেন— তাঁরা শত্রু এবং দেশদ্রোহী।

এই রকম একটি শক্তির বিরুদ্ধে একত্রিত হতে গেলে দেশের সমস্ত সাংস্কৃতিক কর্মীকে সবার আগে বুঝতে হবে যে, আমাদের আসলে কোনও পক্ষ বা অবলম্বন নেই। অর্থাৎ, কোনও রাজনৈতিক দলই শেষ পর্যন্ত আমাদের, অর্থাৎ শিল্পীদের পক্ষে নেই; থাকার কথাও নয়। আমাদের অবলম্বন সাধারণ মানুষের সমর্থন এবং আমাদের নিজস্ব শিল্পকর্ম।

সিপিআইএমের রাজ্যসভার সদস্য বিকাশ ভট্টাচার্য মহাশয়ের সমাজমাধ্যমে একটি লেখা নিয়ে বাম-কংগ্রেসের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। কংগ্রেসের ক্ষিপ্ত হওয়ার কারণটা বুঝতে পারি, বামনেতারা এত সতর্ক বা লজ্জিত কেন? ইতিহাস তো সত্যি কথাই বলবে। গৌরবের হোক বা লজ্জার, ইতিহাসের কাছে ফিরে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণই তো ইতিহাসের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করা, কোনটা করব বা কোনটা করব না— তার পাঠ নেওয়া। বরং, ইতিহাসকে জোর করে মাটি চাপা দিয়ে রাখার অর্থ, ঘরের মধ্যে বিপজ্জনক বিস্ফোরক মজুত রাখার মতো ছেলেমানুষি। মোদী সরকার এই মুহূর্তে খানিকটা কোণঠাসা গোটা দেশেই। ছলে বলে কৌশলে তারা আপ্রাণ চেষ্টা করবে হারানো জমি ফিরে পেতে। গোটা দেশের মানুষের কাছে যদি মোদী-শাহের আসল চেহারাটা উন্মুক্ত করতে হয়, তা হলে ভারতের বিজেপি-বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির উচিত, সমস্ত জটিলতা ও মোহভঙ্গ করে নির্মোহ ভাবে ইতিহাসের পাঠ নেওয়া।

নিজেদের সাফল্য ও গৌরবের ইতিহাস যেমন স্মরণযোগ্য, নিজেদের করা অন্যায়, অনৈতিক কাজগুলো স্মরণ করাও অবশ্যকর্তব্য। এতে কংগ্রেস নেতৃত্ব ক্ষুব্ধ হলেও কিছু করার নেই বা বাম নেতাদের লজ্জিত হওয়ারও কোনও যৌক্তিকতা নেই। পশ্চিমবঙ্গে এবং গোটা ভারতে এমন বহু নাট্যশিল্পী আছেন, যাঁরা আজও এই বিধানসভা নির্বাচনের সময়েও জোট এবং বামপ্রার্থীদের হয়ে অক্লান্ত প্রচার করেছেন। তাঁদের যদি বলা হয়, সফদর হাশমিকে ভুলে যান, বা কংগ্রেসি আমলে যত নাট্যশিল্পী খুন হয়েছেন বা জেলে গিয়েছেন বা অত্যাচারিত হয়েছেন, তাঁদের নামগুলো মাটির গভীরে চাপা দিয়ে দিন, তা হলে তা হবে আত্মহত্যার শামিল। উল্টো দিকে, এক জন একনিষ্ঠ দায়িত্ববান কংগ্রেস কর্মীরও ভোলা উচিত নয় বাম জমানায় নেমে আসা তাঁদের উপর অত্যাচারের ইতিহাস। কলঙ্কিত এই সব অধ্যায়ের মুখোমুখি হওয়ার সাহস অর্জনের মধ্যেই লুকিয়ে আছে বাম-কংগ্রেসের জোটের ভবিষ্যৎ, ২০২৪-এ মোদী সরকারের মতো জনবিরোধী শক্তিকে সরাতে যা কাজে লাগবে।

যদিও এই নৈতিক শক্তি ভারতের কোনও রাজনৈতিক দলেরই আছে কি না, তা নিয়ে অবশ্যই প্রশ্ন তোলা যায়। বিধানসভা নির্বাচনের ফলে এবং পরে এক শ্রেণির সুবিধাবাদী রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীরা যে ভাবে ভোগবাদীর মতো রূপ পাল্টাচ্ছেন, তাতে তাঁরা অচিরেই নৈতিক শক্তির বলে বলীয়ান হয়ে এই ফ্যাসিস্ট ভারতীয় জনতা পার্টির বিরুদ্ধে বুকটান করে একত্রিত হবেন, এমন স্বপ্ন দেখা বোধ হয় অন্যায়।

তবু মানুষ স্বপ্ন দেখে। কারণ, সে জানে স্বপ্নকে অলীক বলে আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করাটা একটা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র। কল্পনাশক্তিকে খাটো করে দেখানো, অবাস্তব বলে ব্যঙ্গ করা অথবা জনবিরোধী বলে দেগে দিয়ে একঘরে করে দিয়ে তাকে অপাঙ্‌ক্তেয় করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র। যে কোনও রঙের ক্ষমতা সেটাই করে। ইতিহাস তা-ই বলে। ২০২৪ সালে যদি এই ভয়ঙ্কর শক্তির হাত থেকে রক্ষা পেতে হয়, অন্তত একটা সদর্থক উদ্যোগ করতে হয়, তা হলে রাজনৈতিক দলগুলি কতটা তাদের তৈরি করা স্বার্থের চূড়া থেকে নেমে আসতে পারবে, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। কিন্তু আমাদের সাংস্কৃতিক কর্মীদের যদি গোর্কির মতো কেউ ডাক দিয়ে বলেন: “মহাশয়, আপনারা কোন দিকে?” আমরা বিজেপি-বিরোধী, কোনও রাজনৈতিক দলের ছাতা না-ধরা সাংস্কৃতিক কর্মীরা যেন স্বার্থ ভুলে এক সঙ্গে বলতে পারি: “যে বলেছে আজও এই প্লাবনে সংক্ষোভে মেঘে আমার সমস্ত জ্ঞান চাই/ সে বড়ো প্রত্যক্ষ চোখে আপন শরীর নিয়ে বাঁধ দিতে গিয়েছিল জলে—”

আমরা হতেই পারি আরুণির মতো, জলপ্রবাহ রোধ করতে শুয়ে পড়তে পারি আলের ধারে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement