অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদের মতোই বঙ্গ রাজনীতিতে বহুকাল হল কিছু বাক্যাংশ প্রায় আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। ‘মানুষই শেষ কথা বলবে’ অথবা ‘আইন আইনের পথে চলবে’-এর মতোই বঙ্গ রাজনীতিতে আর একটি বাক্যাংশ বহুব্যবহৃত। তা হল— ‘যে কোনও মৃত্যুই দুঃখজনক। মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি করবেন না।’ বিশেষত যখন কোনও রাজনৈতিক কর্মীর মৃত্যু ঘটে এবং সেই মৃতদেহ নিয়ে চলে মিছিলের রাজনীতি, তখন এই বাক্যাংশ উচ্চারিত হয়। কিন্তু কোনও মৃত্যুই কি আদতে অরাজনৈতিক? মৃত্যুর কি কোনও নিজস্ব রাজনীতি নেই? অবশ্যই আছে। মৃত্যু চিরকালই অনেক গভীর বিতর্কের ইতি টেনে দেয়। ধরুন দুই চিন্তকের মধ্যে বৌদ্ধিক বিতর্ক চলছে, এক জন মারা গেলে, এক পক্ষ কিছুটা এগিয়ে নিয়ে গেলেও অপর পক্ষে যে হেতু সাড়া মেলে না অতএব অনিবার্য পরিণতিতে বিতর্ক থেমে যায়।
আলোকপ্রাপ্তি, যুক্তি ব্যবহারের স্পর্ধার সীমানা এবং কর্তৃত্বের কাছে আনুগত্য বিষয়ে রাজা ফ্রেডরিক এবং ইমানুয়েল কান্টের বিতর্ক শেষ হয় রাজা ফ্রেডরিকের মৃত্যুতে। আবার মৃত্যু অনেক সময় প্রতিশ্রুতির বন্ধন থেকে রক্ষা করে। যে রকম রক্ষা পেয়েছিলেন কান্ট। রাজা ফ্রেডরিকের মৃত্যুর পর তাঁকে দেওয়া কথার আর কোনও মূল্য থাকে না— এই যুক্তিতে কান্ট আবার তাঁর মতবাদ পুস্তক আকারে প্রকাশ ও প্রচার করেন।
মৃত্যু মানুষকে কিছুটা মহৎ ও মহান করে তোলে। যিনি মারা গেলেন, তিনি যেন কিছু না করেই এক প্রকার মহান হয়ে ওঠেন তাঁর সদ্য অর্জিত মৃত্যুর জন্য। তাঁর কাজের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ঋণাত্মক দিকগুলিকে যেন সরিয়ে রাখতে পারলেই ভাল হয়। চায়ের দোকানে, ক্লাবে, চণ্ডীমণ্ডপে বা সমাজমাধ্যমের যে কোনও আড্ডায় সদ্যমৃত কোনও মানুষের কাজের অনুপুঙ্খ বিচারের আলাপ-আলোচনা সামান্য ঋণাত্মক দিকে এগোতেই আপনি এমন কাউকে নিশ্চয়ই পাবেন যিনি বলে উঠবেন— ‘আজ অন্তত এই সব কথা থাক!’ স্মরণসভায় সচরাচর কাউকে মৃত ব্যক্তির চিন্তা বা কর্মকাণ্ডের তুল্যমূল্য আলোচনা করতে বা বিশেষত খামতির দিক নিয়ে কথা বলতে দেখা যায় না।
এই গেল মৃত্যুর ক্ষমতার দিক, অর্থাৎ মৃত্যুর নিজস্ব রাজনীতির দিক। এ বার একটু বুঝে নেওয়া যাক মৃত্যু ঠিক কতখানি রাজনৈতিক। অর্থাৎ, মৃত্যুর সঙ্গে রাষ্ট্র ঠিক কতখানি জড়িত। প্রথমেই এটা বলা যায়, যে কোনও মৃত্যুর পরে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আমাদের নিকটতম রাষ্ট্রের স্থানীয় কর্তৃত্বের কাছে খবর করতে হয়। অন্যথায় শংসাপত্র পাওয়া যায় না। আর তা না থাকলে, রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কাছে এটা প্রমাণ করা যাবে না সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি মৃত। জন্ম, গৃহ ও সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয়, বিবাহ, সন্তান গ্রহণ এমনকি চূড়ান্ত ব্যক্তিগত মুহূর্তে কোনটা সম্মতি আর কোনটা নয় তা রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ঠিক করে দেওয়ার ফলে সেইগুলি যতখানি রাজনৈতিক, মৃত্যুও ঠিক ততখানিই রাজনৈতিক।
যে ভাবে রাষ্ট্র ঠিক করে লাঞ্ছনার প্রকৃত সংজ্ঞা এই মুহূর্তে কী হবে, সমলিঙ্গের মানুষ ঘর বাঁধতে পারবেন কি না, তেমনই সে স্থির করে কোন রোগে মৃত্যু বেশি গুরুত্বপূর্ণ— যক্ষ্মা না কোভিড? সেই অর্থেও মৃত্যু রাজনৈতিক হয়ে পড়ে। রাষ্ট্র কোন মতবাদ অনুমোদন করে আর কোন মতবাদ করে না তার উপর নির্ভর করে কাদের হাতে হাতকড়া পড়বে আর সেই হাতকড়ার চাবি কাদের পকেটে থাকবে, কারা কাদের বিচার করবে এবং সেই বিচারের রায় কী ভাবে এবং কতখানি কার্যকর হবে। নির্ভর করে বুলেট কার বুকে গিয়ে বসবে আর ট্রিগারে আঙুল কার থাকবে। কোন মৃত্যু বিপুল মর্যাদায় উদ্যাপিত হবে আর কোন মৃত্যু ঘাস, মাটি আর ফাইলে চাপা পড়ে যাবে, তা নির্ধারণ করে দেয় রাষ্ট্র। দেশ-কাল ভেদে সর্বত্র এই নিয়ম চলে আসছে।
আত্মহত্যা, সে-ও কি রাজনৈতিক? আত্মহত্যারও একটি নিজস্ব রাজনীতি আছে। সমস্ত রকম মৃত্যুর মধ্যে এই মৃত্যুকে বেছে নেওয়া মানুষই সবচেয়ে বেশি করুণা পেয়ে থাকেন। মনে করা হয়ে থাকে, আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষেরা অত্যন্ত মেধাবী এবং কুশাগ্রবুদ্ধিসম্পন্ন হন। ইতিহাসে অবশ্য তার বিস্তর নজির আছে। স্যর বার্ট্রান্ড রাসেল আত্মহত্যার পরিকল্পনা স্থগিত রেখে দুই খণ্ড প্রিন্সিপিয়া ম্যাথামেটিকা লিখে ফেলেছিলেন। আর তিনিই তাঁর স্মৃতিচারণায় লিখে গেছেন তাঁর কৃতী ছাত্র ভিটগেনস্টাইন ঠিক কতখানি আত্মহত্যাপ্রবণ ছিলেন। আত্মহত্যার ভিতরেও কি তা হলে রাষ্ট্র আছে? ভীষণ ভাবেই আছে। পর পর দু’বছর খরা সহ্য করা বিদর্ভের ঋণগ্রস্ত কৃষকের ঋণ কী ভাবে মকুব হবে সে বিষয়ে রাষ্ট্র উদাসীন থাকলে, কর্মসংস্থান, ক্ষুধা, অপুষ্টি, দারিদ্রের মতো বিষয়ে রাষ্ট্রের কোনও মাথাব্যথা না থাকলে আত্মহত্যাই শেষ উপায়। এমিল ডুর্খেইম তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছিলেন, যুদ্ধের মতো সঙ্কটে মানুষের আত্মহত্যার প্রবণতা কমে যায়। ফলে, শেষ বিচারে মৃত্যুও এক রাজনৈতিক বিষয় হয়েই দাঁড়ায়।