মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে রাজ্যের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য করা নিয়ে কয়েক দিন ধরে প্রচুর আলোড়ন চলছে। এই ধরনের কোনও সিদ্ধান্ত কখনও সর্বসম্মত হতে পারে না। বিরোধিতা, সমালোচনা, কটাক্ষ সবই স্বাভাবিক। এখন যেটা হচ্ছে।
আর লড়াই যেখানে যুক্তির, সেখানে ঠিক-বেঠিকের মাপকাঠিরও অনড় অবস্থান থাকা অসম্ভব। তার উপর প্রেক্ষাপটে রাজনীতি। ফলে বিরোধের পরিসরটি আরও উন্মুক্ত।
যদিও সবাই জানি, বিষয়টি মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদিত হওয়ার পরে এ বার শাসক দলের গরিষ্ঠতায় বিল এনে সহজেই বিধানসভায় তা পাশ করানো যাবে। তবে সেই বিলটি আইনে প্রণয়নের ক্ষেত্রে রাজ্যপাল যে কিছু সমস্যা তুলতে চাইবেন, সেটাও অব্যর্থ অনুমান। সে সব অবশ্য পরের কথা।
সাম্প্রতিক আচার্য-বিতর্কের মূলত দু’টি অভিমুখ লক্ষ করা যাচ্ছে। এক, রাজ্যপালকে আচার্য পদ থেকে সরানো। দুই, সেই পদে মুখ্যমন্ত্রী অর্থাৎ মমতাকে বসানো। আগেই বলেছি, সিদ্ধান্তটি ঘোরতর রাজনৈতিক। যেখানে মমতাকে আচার্য করার থেকে বরং বেশি ‘প্রয়োজনীয়’ হয়েছে রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়কে আচার্য না-রাখা। যার প্রেক্ষাপট তৈরি হচ্ছিল বেশ কিছু দিন ধরে।
যত দূর জানি, মন্ত্রিসভার বৈঠকে যে প্রস্তাবটি এসেছিল সেখানেও রাজ্যপালকে আচার্য না রাখার কথাই ছিল। তা নিয়ে আলোচনার সময় মুখ্যমন্ত্রী, মানে মমতাকে ওই পদে বসানোর বিষয়টি ওঠে এবং সর্বসম্মতিক্রমে তা গৃহীত হয়।
‘আচার্য’ বলতে আমরা সাধারণ ভাবে ‘গুরু’ বুঝি। যেমন, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ-এ আচার্য বলতে যাঁদের বোঝানো হয়েছে, তাঁরা এক কথায় অধ্যাপক, ধর্মের উপদেশক, শাস্ত্র-শিক্ষক ইত্যাদি। ব্রাহ্মণকে যিনি উপনয়ন দেন, দীক্ষাগুরু হিসাবে তাঁকেও ‘আচার্য’ বলা হয়।
পাণ্ডিত্যের তকমা হয়তো আজ প্রায় কোনও মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়। একই ভাবে রাজ্যপাল মাত্রেই বিদ্যায়, বৈদগ্ধে হরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের মতো কৃতবিদ্য নন। বস্তুত কোনও রাজনৈতিক পদেই এগুলি বিবেচ্য হয় না। তার প্রয়োজনও নেই। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘আচার্য’ নামক পদটির ওজনের সঙ্গে কেউ এখন পাণ্ডিত্যের ছাপ খুঁজতে চাইলে সেটা বাস্তবানুগ হবে না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে অনেক সময় মালিকপক্ষের কেউ আচার্য হন। সেগুলিও পুরোদস্তুর বিশ্ববিদ্যালয়।
সুতরাং কোনও মুখ্যমন্ত্রীর আচার্য হওয়া বা কোনও রাজ্যপালের আচার্য থাকার মধ্যে গুণগত, মানগত, শিক্ষাগত প্রভেদ থাকতে পারে বলে মনে করি না। প্রকৃতপক্ষে সমস্যার বীজ অন্যত্র। সেটা হল, ক্ষমতার টানাপড়েন। এর এক দিকে রাজ্যপালেরা আচার্য হিসাবে যে অধিকার ভোগ করে থাকেন, সেটা ছাড়ার অনীহা। অন্য দিকে ‘বিরোধী’ মনোভাবাপন্ন রাজ্যপালের ক্ষমতা ‘কমিয়ে’ দিতে রাজ্য সরকারের উদ্যোগ।
প্রথাগত ভাবে রাজ্যপালেরা বিভিন্ন রাজ্যে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য হয়ে আসছেন ঠিকই। তবে এটি তাঁরা ‘ভোগ’ করছেন মাত্র। এর কোনও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা নেই। সংশ্লিষ্ট রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়-পরিচালনবিধি অনুযায়ী এটা স্থির হয়। অতএব পশ্চিমবঙ্গ বা তামিলনাড়ু যদি আজ স্থির করে তারা আইন বদল করে রাজ্যপালকে আচার্য রাখবে না, তা হলে সেই অধিকার তাদের থাকবে না, বিষয়টি তেমন নয়।
এ বার কেউ যদি মনে করেন, শিক্ষাক্ষেত্রকে ‘রাজনীতিমুক্ত’ রাখার উদ্দেশ্য থেকেই রাজ্যপালদের আচার্য করার এই প্রথা চলে আসছে, তা হলেও বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে সেটা অতিসরলীকরণ হবে। কারণ রাজ্যপাল পদটি দিনে দিনে আগাপাছতলা রাজনৈতিক হয়ে উঠেছে। এ নিয়ে কোনও দ্বিমত থাকার কথা নয়।
মুখ্যমন্ত্রীরা ঘোষিত ভাবেই রাজনীতির লোক। রাজ্যপালেরা আপাত-নিরপেক্ষতার আড়ালে থাকা রাজনীতিক। তফাত এটুকুই। সুতরাং রাজ্যপালেরা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য হলেই শিক্ষাঙ্গন রাজনীতির কলুষমুক্ত হবে, এটা ভাবার কোনও যুক্তি নেই। বরং তা যে হয় না, সেই প্রমাণ আছে অজস্র।
সরকারি সব বিশ্ববিদ্যালয়ে আচার্য-রাজ্যপালের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হল উপাচার্য নিয়োগ করা। বিরোধের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্রও এটি। কতিপয় রাজ্যপাল মনে করেন, আচার্য হিসাবে তিনি একক ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। আবার অনেক রাজ্যে বলা আছে, সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করে এগোবেন রাজ্যপাল। তবে বাছাই পদ্ধতি যা-ই হোক, মতভেদ হামেশাই হয়ে থাকে।
এ কথা ঠিক যে, শাসকরা সব জায়গায় নিজেদের ‘পছন্দ’-এর উপাচার্য নিয়োগ করতে চান। এ-রাজ্য, সে-রাজ্য, এই আমল, সেই আমল সব সময়ই এটা স্বতঃসিদ্ধ। কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতেও এটাই উপাচার্যদের নিয়োগের অলিখিত ‘নীতি’।
সিপিএম, বিজেপি সবার এখন অভিযোগ, মমতার সরকার তার ‘অনুগত’দের উপাচার্য পদে বসাচ্ছে। ঠিক। কিন্তু বাংলায় বাম আমলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য পদে সিপিএম-অনুগত রমেন্দ্রকুমার পোদ্দারকে দ্বিতীয় বারের জন্য বসাতে না পারার পরিণতি কী হয়েছিল, ভুললে চলবে কেন!
তৎকালীন আচার্য-রাজ্যপাল অনন্তপ্রসাদ শর্মা প্যানেল থেকে রমেনবাবুর বদলে সন্তোষ ভট্টাচার্যকে বেছে নেওয়ার প্রতিবাদে শাসক সিপিএম টানা পাঁচ বছর ধরে আন্দোলন চালিয়েছিল। পুরো কার্যকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসে বসে সুস্থ ভাবে কাজ করতে দেওয়া হয়নি সন্তোষবাবুকে। তাঁর ‘অপরাধ’, তিনি সিপিএমের ‘বশংবদ’ ছিলেন না। এই উদ্যোগে প্রকাশ্য মদত ছিল আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের। পুরোভাগে অনিল বিশ্বাস।
এর জেরে রাজ্যপাল শর্মাকেও সরকারি ভাবে ‘বয়কট’ করা হয়েছিল। জ্যোতি বসু বা তাঁর মন্ত্রীরা কেউ তাঁর কাছে যেতেন না। অচিরে রাজ্য ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল ওই রাজ্যপালকে। তাঁকে বিদায় জানাতেও মন্ত্রীরা কেউ যাননি।
রাজ্যের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতেও বামফ্রন্ট আমলে যাঁরা উপাচার্য হয়েছিলেন, শিক্ষাগত যোগ্যতার বাইরে তাঁদের রাজনৈতিক ‘আনুগত্য’ ছিল প্রশ্নাতীত।
একই ছবি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতেও। জেএনইউ, দিল্লি, হায়দরাবাদ, বিশ্বভারতী কোনটা ছেড়ে কোনটার কথা বলব? রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতীতে প্রধানমন্ত্রী আচার্য হন। সেখানেও আচার্যের ‘রাজনীতি’ দেখতে হয়েছে। আম্রকুঞ্জের সমাবর্তন উৎসবে অভ্যাগতদের ভিড় থেকে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি ওঠার পরেও আজকের আচার্য-প্রধানমন্ত্রী মোদী ‘অবিচল’ ছিলেন। অনুষ্ঠানের মর্যাদা মেনে স্লোগানকারীদের চুপ করতে পর্যন্ত বলেননি! প্রশ্ন উঠেছিল, এটা কি কার্যত প্রশ্রয় জোগানো?
ধনখড় এখানে রাজ্যপাল হয়ে আসার পরে আচার্য হিসাবে তাঁর প্রথম সক্রিয় পদক্ষেপ ছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-বিক্ষোভ থেকে তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়কে ‘উদ্ধার’ করতে ছুটে যাওয়া। বাবুল তখন বিজেপি-তে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ ডাকতে না চাওয়ায় আচার্য হিসাবে উপাচার্যকে হুঁশিয়ারিও দিয়েছিলেন ধনখড়।
তাঁর চাহিদা ছিল, রাজভবনে তিনি আলাদা ভাবে ‘আচার্যের দফতর’ খুলবেন এবং সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির কাজকর্ম ‘দেখবেন’। সরকার রাজি হয়নি। বস্তুত আচার্য যাতে উপাচার্যদের সরাসরি ডাকতে না-পারেন, সবটাই যাতে শিক্ষা দফতরের মাধ্যমে হয়, সেই মর্মে কিছু দিন আগে আইন সংশোধনও করেছে বর্তমান সরকার। কে কার অলঙ্কার!
নির্মম সত্যটি হল, রাজ্যের শিক্ষা-প্রশাসনে রাজনীতির পাঞ্জা কষা কোনও আকস্মিক, গোপন বা অভিনব ঘটনা নয়। যা ছিল, তা আছে এবং সেটাই ভবিতব্য হয়ে থেকেও যাবে। রাতারাতি কোনও ম্যাজিকে বদলাবে না।
ফলে কি আচার্য, কি বা উপাচার্য, শেষ পর্যন্ত সব একাকার! এক-এক রাজ্যে বা শিক্ষাঙ্গনে তার প্রকাশ এক-এক রকম। কিন্তু মোটের উপর এই ব্যবস্থায় ‘অরাজনৈতিক’ বলে কিছু হয় না। হতে পারে না। এ সব ভাবনা সোনার পাথরবাটি।
গোড়ার কথায় ফিরে আবার বলি, বিতর্ক থাকলেও আচার্য হওয়ার জন্য মমতার খেলা তাই সোজা ব্যাটে। রাজনীতির মুখ আড়াল করার অপচেষ্টা অন্তত তাতে নেই। রাজভবনের রাজনীতি ‘নিরপেক্ষতা’র মুখোশে ঢাকা। সেটা আরও অবাঞ্ছিত।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।