নতুন: জয়োল্লাসীদের শেখ মুজিবের মূর্তি আক্রমণ, ঢাকা, ৫ অগস্ট। ছবি: রয়টার্স।
অগস্ট যেন মাঝেমধ্যেই বাংলার মাটিকে কাঁপিয়ে দেয়। চলমান ইতিহাস যেন অকস্মাৎ ঘোড়ার খুরের মতো বাঁক নেয়। ১৯৪৭ সালের ১৪ অগস্ট পাকিস্তানের জন্মমুহূর্তে আর ১৫ অগস্ট ভারতের জন্মমুহূর্তে বাংলা ভেসে গিয়েছিল হাহাকারে, যার ছায়া বইতে থাকল প্রজন্মের পর প্রজন্ম। তারও এক বছর আগে, ১৯৪৬ সালের ১৬ অগস্ট কলকাতা মহানগর দেখেছিল হিংস্রতার প্রচণ্ড তাণ্ডব, যে কোনও জনগোষ্ঠীর জীবন যা ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারে। দিয়েছিলও। সেই পাতালছায়ার রেশ কি আজও নিহিত নেই, বাংলার সমাজে?
তারও পর। আটাশ বছরের শাসনশৃঙ্খল কাটিয়ে পুব বাংলা (তখন যা পূর্ব পাকিস্তান) ১৯৭১ সালে তখন স্বাধীন বাংলাদেশ। নবজাত দেশের প্রধানমন্ত্রী মুক্তিযুদ্ধের প্রধান কান্ডারি শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশে আর পশ্চিমবঙ্গে তাঁকে বলা হল, সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি রাজনৈতিক নেতা, আর বহির্বিশ্বে তিনি সম্মানিত হলেন নিষ্পেষিত জাতির যোদ্ধা নেতা হিসেবে। অথচ, চার বছরও পুরল না, সেই বিশ্ববরেণ্য নায়ককে সপরিবারে নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করা হল তাঁর নিজেরই দেশে, হত্যাকারীরা তাঁর নিজেরই দেশবাসী। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগস্ট ছিল সেটা।
ওই ঘটনার পরেও পঞ্চাশ বছর হল প্রায়। ২০২৪ সালের জুলাই গড়িয়ে অগস্ট: বাংলার মাটি আবার দেখল অভূতপূর্ব ও অভাবনীয় এক গণঅভ্যুত্থান। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে আকস্মিক ছাত্র-আন্দোলন, তার উত্তরে নিষ্ঠুরতম রাষ্ট্রীয় হিংসা, তার উত্তরে দেশভাসানো অভ্যুত্থান, এবং সব শেষে প্রতিহিংসার প্লাবন। যে আওয়ামী লীগের নাম এত দিন সে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিল, সেই দলের বিরুদ্ধেই এই আন্দোলন যেন আর একটা ‘স্বাধীনতার যুদ্ধ’। ৫ অগস্ট জনতার রোষাগ্নি প্রতিহত করতে না পেরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আক্ষরিক অর্থে পালিয়ে গেলেন। ৯ অগস্ট যখন নতুন সরকার শাসনাসীন হল, বোঝা গেল বাংলাদেশ হাঁটতে শুরু করছে অজানা নতুন অভিমুখে। সেই পথে এখন এক দিকে আশার তরঙ্গ, অন্য দিকে আশঙ্কার স্রোত আবর্ত।
‘আশঙ্কা’ শুনলেই অবশ্য অনেকে রেগে উঠছেন। সীমান্তের এপারে ওপারে, দু’পারেই অনেকে ভাবছেন, আশঙ্কার কথা বলে অভ্যুত্থানের স্বতঃস্ফূর্ততা এবং জনভিত্তির চরিত্রকে লঘু করা হচ্ছে। সেটা কিন্তু ঠিক নয়। আশাকে ছোট করা অসম্ভব। সংরক্ষণের বিরুদ্ধে ছাত্র-আন্দোলন দিয়ে শুরু হলেও যে ভাবে তা বৃহত্তর গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হল, শেখ হাসিনার পনেরো বছরের স্বৈরবাদী শাসনের বিরুদ্ধে, একের পর এক নির্বাচনে সরকারবিরোধী মতামত বা রাজনীতিকে কোনও পরিসর না দিয়ে নাম-কা-ওয়াস্তে ‘গণতন্ত্র’ চালিয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে সে দেশের মানুষ যে ভাবে গর্জে উঠলেন, এই সব দেখার পরে কোনও সংশয় নেই যে, এক অসাধারণ গৌরবের ইতিহাস তৈরি হল আমাদের চোখের সামনে। কিন্তু মানতেই হবে, আশঙ্কাও রয়ে গেল অনেক রকম, রয়ে গেল গভীর উদ্বেগ। আন্দোলন-সাগরে স্পষ্টতই জুড়ে গেছে নানা রক্ষণশীল রাজনীতির ঢেউ, ইসলামি মৌলবাদের অন্ধতা— যাতে আবার এসে মিলেছে ভারতবিরোধিতার ধারাও।
আসলে, ভারতের সঙ্গে শেখ হাসিনার মিত্রতার সম্পর্কটি অনেক দিন ধরেই হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাঁর বিরুদ্ধে বিরাগ-বিক্ষোভের একটা বড় কারণ। এই ভারতবিরোধীদের মধ্যে বাম ও দক্ষিণ দুই পক্ষই আছে। তবে দক্ষিণের রক্ষণশীল ভারতবিরোধিতার জোর অনেক বেশি বাংলাদেশে। ইসলামি রাজনীতি ও পাকিস্তানপন্থী শিবিরের সঙ্গে আওয়ামী লীগ-বিরোধী ও ভারত-বিরোধীদের ঘনিষ্ঠতা সেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ-কাল থেকেই। তাই বোঝা কঠিন নয়, কেন এই আন্দোলনের মধ্যে এত প্রচণ্ড রাগ প্রকাশিত হল মুজিবের উপরেও। শেখ হাসিনা মানেই মুজিব ঐতিহ্য। মুজিব ঐতিহ্য মানেই ভারত-সমর্থন। সব একাকার। ৫ অগস্ট থেকে তাই দেশময় শেখ মুজিবের একের পর এক মূর্তি ভাঙা হল, গণভবনের সঙ্গে মুজিব আর্কাইভসও পুড়ে ছারখার হল। একের পর এক স্থাপত্য-ভাস্কর্য গুঁড়িয়ে গেল, রবীন্দ্রনাথের প্রতি বিদ্বেষ ধ্বনিত হল, সংখ্যালঘুদের উপর উৎপাত হল, মন্দির ভাঙা হল। ক্রুদ্ধ জনতার আচরণের আতিশয্যের কথা মনে রেখেও বলতেই হয়, আমরা শুধু শেখ হাসিনার বিরুদ্ধ রাজনৈতিক আন্দোলনটুকুই দেখলাম না, তার ফাঁক দিয়ে প্রকাশিত হল গণতন্ত্রবিরোধী মৌলবাদী ধর্মমোহের একটি চেনা ধারাও। ফলে যে গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা থেকে ‘দড়ি ধরে মারো টান’ বলে শেখ হাসিনাকে খান-খান করা হল, সেই গণতন্ত্রেরই বিপ্রতীপতার বীজ এই আন্দোলনের অন্তত কিয়দংশে দৃঢ় ভাবে গাঁথা।
এই বাস্তবটা মূল আন্দোলনকারীদেরও দৃষ্টি এড়ায়নি। এড়ায়নি বলেই তাঁদের এক বড় অংশ আজ হতাশায় ও দুঃখে রুখে উঠেছেন, তাঁদের এত রক্ত ও আত্মনিবেদনের মূল্যে লড়া যুদ্ধকে ধসিয়ে দেওয়া যাবে না, এই দাবি তুলে আবার পথে নেমে এসেছেন। গ্রামেগঞ্জে মুসলমান বাসিন্দারা এগিয়ে এসে মন্দির আগলাচ্ছেন। হিন্দু পাড়ায় গিয়ে প্রতিবেশীদের পাহারা দিচ্ছেন। আন্দোলনকারীরা বার বার আশ্বাস দিচ্ছেন যে সে দেশ সকলের, সব ধর্মের সব পরিচিতির মানুষের। এমনও বলেছেন যে, গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ একটি দল তৈরি করা হবে, একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ এবং জামায়াতে-বিএনপির বিপরীতে গিয়ে। বিরাট আশার কথা এ সব। আস্থার কথা। মানবতায় বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার মতো কথা, একাত্তরের মুক্তিতেও।
তবে এখনও এ সব কেবল ‘কথা’। কী হতে চলেছে এখনও তা অজানা। নতুন সরকারে ছাত্রপ্রতিনিধি কিংবা সংখ্যালঘু দেখে খুশি হওয়ার কারণ আছে নিশ্চয়ই, তেমন রক্ষণশীলদের দেখে আতঙ্কিত হওয়ারও কারণ আছে। সর্বোপরি আছে সেনা-শাসনের অতি ভয়ঙ্কর সম্ভাবনা। ভুলে যাওয়া মুশকিল যে, বারংবার এই সেনাশক্তিই বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক স্বপ্নকে হাইজ্যাক করে এসেছে।
সুতরাং আশা আর আশঙ্কাকে এক সঙ্গে নিয়েই চলতে হবে আমাদের— আপাতত। সময়ই বলে দেবে, কে জেতে কে হারে। এক দিকে যাঁরা আশাকে ছোট করছেন, জনশক্তির জোরে স্বৈরতন্ত্রকে নিপাতিত হতে দেখেও সেই শক্তিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না, তাঁরা বুঝছেন না যে— এ ভাবেও ফিরে আসা যায়, মানুষ পারে। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর কোনও সমাজকে চেপে রাখতে চাইলে এক দিন অকেজো প্রেশার কুকারের মতো তার বিস্ফোরণ হয়। এপারেও যে নেতারা আজ ক্ষমতা ও অহমিকার গৈরিক চাদর কিংবা অন্য রঙা আঁচল চাপা দিয়ে মানুষের অসন্তোষকে পাত্তা দিচ্ছেন না, তাঁদের সকলের এর থেকে শিক্ষা নেওয়া জরুরি।
আর অন্য দিকে, যাঁরা আশঙ্কাকে ছোট করছেন, জনশক্তির আড়াল-আবডাল দিয়ে অসহিষ্ণুতার কারবারিদের আরও এক বার ঢুকে-পড়াটা দেখতে চাইছেন না, ইসলামি মৌলবাদের ভয়টাকে আলেয়া ভাবছেন— তাঁরা, যাকে বলে, ‘ডিনায়াল’-এ আছেন। বরাবরের মতো, আবারও, এ বারও, তাঁরা মনে করছেন, অন্ধ হলেই বিপদ বন্ধ হবে। অথচ বাংলাদেশের রাজনীতি চত্বরে এই মৌলবাদী শক্তির জোর যে কত— তা অনেক বার প্রমাণিত। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের মানুষ যখন মৌলবাদের বিপদটাকে কম করে দেখতে ও দেখাতে চান, তখন তাঁদের আত্মরক্ষণাত্মক আবেগ বুঝতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মানুষ যখন এ কাজ করেন, তাঁরা এ দেশকেও বিপদের মধ্যে ডুবিয়ে দেন। ধর্মনিরপেক্ষতার খাতিরে ইসলামি মৌলবাদের ভীষণতাকে ছোট করে দেখাটা কেবল ভুল নয়, আত্মঘাত। শেষ পর্যন্ত যে তা হিন্দু মৌলবাদের হাতও শক্ত করে, এটুকু বোধ এত দিনে হওয়া উচিত ছিল।
রাতের সব তারাই যেমন দিনের আলোর গভীরে থাকে, সব অগস্টের বীজই হয়তো থাকে আগেকার অগস্টসমূহে। ১৫ অগস্টের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে এ কথাটা না ভেবে থাকা যাচ্ছে না। সাতচল্লিশের অগস্ট পারেনি বাংলার হিন্দু-মুসলমান অবিশ্বাস, সন্দেহ ও ঘৃণা দূর করতে। তার মধ্যে থেকেই নাছোড় আশায় ভর করে নতুন দেশের চলা শুরু হয়েছিল। পঁচাত্তরের অগস্ট বুঝিয়ে দিয়েছিল, ভাষাসংস্কৃতির পরিচয় নিয়ে, স্বশাসনের জন্য লড়াই করে উঠে আসা দেশের মধ্যেও থেকে গিয়েছে ধর্ম-রাজনীতির বিষাক্ত ছোবল। আর তাতে প্রোথিত রয়ে গেছে ‘ভারত না পাকিস্তান’ দ্বন্দ্ব। তেমনই আজকের চব্বিশের অগস্ট অভ্যুত্থানও বুঝিয়ে দিচ্ছে, জনশক্তির অসীম সম্ভাবনা, আর তার মধ্যে লুকিয়ে থাকা সঙ্কীর্ণ রাজনীতির অভ্রান্ত পদচিহ্ন কেমন দুই দিকের দুই বাস্তব।
এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে তাই মনে হয়, ইতিহাসের শিক্ষা যদি আমাদের কিছুমাত্র হয়ে থাকে, তবে জনতার শক্তিকে ছোট করে দেখা, এবং জনতার মাঝখান থেকে আড়াআড়ি ভাবে উঠে আসা বিপজ্জনক স্বার্থান্বেষী সাম্প্রদায়িক শক্তিকে ছোট করে দেখা— দুটোই চলবে না। দুই প্রবণতাই আমাদের গভীর সঙ্কটে ঠেলে দিতে পারে: এটা যেন আমরা খোলা চোখে, মুক্ত মনে দেখতে পারি।
এটাই এখন কাজ। কঠিন হলেও— আবশ্যিক, জরুরি, গুরুতর কাজ।