তা হলে এ ভাবেও শুরু করা যায়। এক মাস আগেও কি আমরা ভাবতে পারতাম একটি ঘটনার প্রভাব এতটা বিস্তৃত হতে পারে! এই যে আজ প্রায় এক মাস ধরে কোনও রাজনৈতিক দলের স্পষ্ট আশ্রয় ছাড়াই প্রতিবাদের ধারা অব্যাহত রয়েছে, বৃষ্টি-রোদ-যানজট উপেক্ষা করে শান্তিপূর্ণ মিছিলে-পোস্টারে স্লোগানে মানুষ ভরিয়ে দিচ্ছেন জনপথ, এ সব কি গল্পের মতো নয়? এই যে গোটা দিনরাত জুড়ে ডাক্তারেরা রাস্তায় বসে থাকলেন, তাঁদের জন্য খাবার-জল-চা নিয়ে এগিয়ে এলেন সাধারণ মানুষ, ছোট্ট দোকানের মালিক (এক পুলিশকর্মীও), এ সব তা হলে আমাদের জীবনেই ছিল! শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের চাপে শেষ অবধি সরে যাচ্ছে ৯ ফুট উঁচু লোহার ব্যারিকেড, জনগণমন গাইতে গাইতে ফুল-মালা নিয়ে ঢুকে যাচ্ছেন প্রতিবাদীরা, এই দৃশ্যও আমাদের দেখার কথা ছিল!
মনে পড়ে যাচ্ছে কয়েক বছর আগেকার ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনের কথা যার শুরুতেও ছিল একটি করুণ মৃত্যু। সে দিন এই মৃত্যু সাদা-কালো নির্বিশেষে সমাজের সমস্ত ধাপের মানুষকে ঝাঁকিয়ে দিয়েছিল; এক সঙ্গে তাঁদের সকলের মনে হয়েছিল এই ঘটনাকে মেনে নেওয়া যায় না। আজ এখানেও একটি মেয়ের নিগ্রহ, এক জন ডাক্তারের মৃত্যুকে মানুষ নানা ভাবে নিজের জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখছেন। আজ অবধি প্রতি দিন যে সব মিছিল হচ্ছে, তার অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সব ধরনের রাজনৈতিক বিশ্বাসের মানুষ নিশ্চয়ই আছেন, তবু তাঁরা এক সঙ্গে পা মিলিয়েছেন তার কারণ সবাই বুঝতে পারছেন বিপদ ক্রমাগত নিজের বৃত্তের মধ্যে ঢুকে পড়ছে; আর চুপ করে থাকা যায় না। এই বিষয়ে বলে ফেলা অনেক কথার পাশে একটি প্রশ্ন, একটি সংশয় ও একটি কর্তব্যের কথা এখানে আলাদা করে উল্লেখ করতে চাই।
প্রশ্নটা হল, আমরা এত দিন কেন জেগে উঠিনি? যখন বছরের পর বছর এসএসসি/টেট পাশ করা ছাত্ররা রাস্তায় বসে থেকেছেন, দুর্নীতির চাপে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের চাকরি পাওয়ার পথগুলো বন্ধ হয়ে গেছে, তখন কেন আমরা এই ভাবে জ্বলে উঠতে পারিনি? না কি পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বাতাসেরও একটা জ্বলনাঙ্কে পৌঁছতে হয়, যার আগে এতটা প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না? আফসোস হয়, এই সিস্টেমের মধ্যে যাঁরা দীর্ঘ দিন আছেন, তাঁরা কেউ কেউ যদি বিভিন্ন দুর্নীতির বিরুদ্ধে আগে মুখ খুলতেন, আমরাও যদি একটু আগে জেগে উঠতে পারতাম, তা হলে হয়তো এই মেয়েটিকে হারাতে হত না।
সংশয়টা হল, এই ক্ষেত্রে ঘটনাপ্রবাহ যে ভাবে চলছে, তাতে প্রতিবাদের লক্ষ্য প্রতি দিন বদলে যাচ্ছে। যেমন, ঘটনাটি জানার পর প্রথমেই মনে হয়েছিল এটা একটি মেয়ের উপর আঘাত; আমরা স্বাধীনতা দিবসের সূচনায় রাতের দখল নেওয়ার অভিযানে দলে দলে বেরিয়ে এলাম সুখী গৃহকোণ ছেড়ে। কিন্তু প্রশ্নটা তো স্বাধীনতার নয়, প্রশ্নটা ছিল নিরাপত্তার। একটি মেয়ে নিগৃহীত ও খুন হয়েছেন, কোথায়? তাঁর নিজের কর্মস্থলে, যেখানে তিনি স্বাধীন তো বটেই, নিজেকে সম্পূর্ণ নিরাপদও ভেবেছিলেন। আমরা রাস্তায়-কর্মস্থলে এবং বাড়িতে মেয়েদের সার্বিক নিরাপত্তা নিয়ে সরব হলাম। কিন্তু এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সেই দাবিও শেষ কথা বলল না। জানা গেল এটা সুপরিকল্পিত খুন, কিছু জেনে ফেলার দোষে বা কিছু ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে স্রেফ সরিয়ে দেওয়া। হয়তো এখানে মেয়ে হওয়াটা নেহাতই সমাপতন, যৌন নিগ্রহটা স্রেফ নজর ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য। এইখানে এসে আমাদের পথ হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনা। বারে বারে ধর্ষণের দিকে নজর ঘুরিয়ে দেওয়া চেষ্টা, ধর্ষণ প্রমাণিত হলে সাত দিনের মধ্যে বিচার শেষ করে ফাঁসির নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি, এ সব সরিয়ে রেখে জানতে চাইতে হবে, লড়তে হবে আসল শত্রু— সার্বিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে।
প্রথমে ভেবেছিলাম অপরাধ একটা নয় দুটো; একটা হল খুন আর একটা হল খুনিকে আড়াল করা। যত দিন যাচ্ছে মনে হচ্ছে অপরাধ অজস্র, আড়ালে রাখার মতো অপরাধীও অজস্র। তাই কোথাকার জল কোথায় গড়াবে আন্দাজ করা শক্ত। তাই হাতে-গরম একটি মাপমতো অপরাধী আর তার যেন তেন প্রকারেণ একটা শাস্তি পেলেই খুশি হওয়ার দিন আর নেই, যার প্রমাণ হল এই লাগাতার আন্দোলন। এই জাগরণ আমাদের বিশ্বাস ফিরিয়ে দিয়েছে যে, মানুষ সত্যিই অন্য মানুষের জন্য রাস্তায় নামতে পারে, আর তথাকথিত অরাজনৈতিক ভাবেও সরকারকে চাপে ফেলা যায়।
এই আগুন যেন এই ঘটনার পরই নিবে না যায়; এমনকি যদি আশানুরূপ ফল নাও পাওয়া যায়, বিচার ও জবাব চাওয়ার সদ্যজাগ্রত সংস্কৃতি যেন অব্যাহত থাকে। নিজেদের বৃত্তের মধ্যেকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে সজাগ ও সরব থাকলেই ‘আর জি কর’ গড়ে ওঠার সুযোগ পাবে না। এটাই হোক শপথ।
হুজুগে, আবেগপ্রবণ, অলস বাঙালির সঙ্গে এই মুহূর্তে জেগে উঠেছে সচেতন, বুদ্ধিমান ও প্রতিবাদী বাঙালি। চলে যাওয়া মেধাবী, সংবেদনশীল চিকিৎসক মেয়েটি যেন আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে, প্রতিবাদ করতে শিখিয়ে দিয়ে গেলেন, শুধু বদলে গেল তাঁর নিজের মা-বাবার জীবন।