অর্পিতার বাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া টাকার পাহাড়। ফাইল চিত্র ।
অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের দু’টি ফ্ল্যাটে নোটের পাহাড় দেখে কথাগুলো মনে পড়ল।
নোটবাতিলের সময়ে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের কথা সবারই মনে আছে। প্রতিটি ব্যাঙ্কের সামনে লম্বা লাইন! সেই লাইনে দাঁড়িয়ে মৃত্যু হয়েছিল প্রায় ১০০ জনের। কেন্দ্রের শাসকদল অবশ্য বলেছিল, ‘‘কই সিনেমার টিকিটের লাইনে তো কেউ মরে না!’’ তখন মনে হয়েছিল, এই অযথা দুর্ভোগ এড়ানো যেত। সরকারের উচিত ছিল ঢাকঢোল না পিটিয়ে, কালো টাকার কারবারিদের সতর্ক না করে, এক দিন ২,০০০ টাকার নোট বাজারে ছেড়ে দেওয়া। ছ’মাস পরে আবার চুপিসারে ৫০০ টাকার নোট। বছর ঘুরতেই দেখা যেত, দুটো নোটই চলে গিয়েছে কালোবাজারিদের হাতে। তখন নিশ্চিন্তে শুধু সেগুলি বাতিল করা যেত! সাধারণ মানুষের কোনও অসুবিধা হত না।
মনে আছে, মোদীর নোটবাতিল কিছু গণ্ডমূর্খ ছাড়া কেউ পছন্দ করেনি দেখে প্রচার শুরু হয়েছিল, প্রতিটি ২,০০০ টাকার নোটে একটা ট্রান্সমিটার আছে। কেউ দেখুক না নোট জমিয়ে! পুলিশ ঠিক জানতে পারবে কত নোট, কোন বাড়ির, কোন ঘরে রাখা আছে। মনে রাখতে হবে, সেই সময়ে কালো টাকা উদ্ধার করাই ছিল প্রধান লক্ষ্য। আর পাঁচটা উন্নত দেশের মতো আমাদেরও নোট-নির্ভরতা কমাতে হবে, তা তো আমরা পরে জানলাম। ভাবনাটা খারাপ ছিল না। এখন যেমন সরকার চোর ধরতে গিয়ে আমার-আপনার মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে, পুরো ব্যাপারটা ডিজিটাল হয়ে গেলে তা আর হত না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ না করেও চুরির টাকা উদ্ধার করা যেত।
নোটবাতিলের সময় ব্যাঙ্কের লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে মৃত্যু হয়েছিল প্রায় ১০০ জনের।
কালো টাকা ছাড়া ‘পলিটিক্স’ হয় না। পাঁচ বছর অন্তর নির্বাচনের বিরাট খরচা আসবে কোথা থেকে? সাদা টাকা থাকলেও তো খরচ দেখাতে পারব না। নির্বাচনী আইনে আটকাবে। তাই মাঝেমধ্যেই দেখা যাবে কোনও নেতা বা মন্ত্রী প্রচুর নগদ-সমেত ধরা পড়ছেন। প্রথমেই মনে আসে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুখরামের কথা। তাঁর ঠাকুরঘরে ‘কলা’ নয়, পাওয়া গিয়েছিল কয়েক কোটি টাকা। অফিসারদের কথা আলাদা। বিশেষত আইএএস অফিসার। তাঁদের তো নির্বাচনের ঝামেলা নেই। মাইনেকড়িও ভাল। গর্বের বিষয় যে, চুরির অভিযোগ সামান্য সংখ্যক অফিসারের নামেই উঠেছে। সুখরামের মতো এক আইএএস অফিসারের বাড়িতেও অবশ্য পাওয়া গিয়েছিল নগদ এবং সম্পত্তি মিলিয়ে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা! তাঁর স্ত্রীও অফিসার ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এই টাকার ব্যাপারে কিছুই জানতেন না। কারণ, ওই ঘর বন্ধ থাকত। তবে কি না, ‘‘আমি জানতাম না’’, কথাটা সত্যি হলেই বলা যায় না। দেখতে হয়, বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে কি না।
অফিসারদের যেমন সুনাম ছিল, তেমনই সুনাম ছিল বাংলার। বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দের কথা নয় ছেড়েই দিলাম। বাংলার রাজনীতি নিজে হাতে গড়েছেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, দেশবন্ধু, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুরা। অন্য রাজ্যে যা হচ্ছে হোক, আমাদের রাজ্যের নেতা-মন্ত্রী অন্তত চটি-ধুতি ছেড়ে লাখ টাকার স্যুটের পিছনে ছুটবেন না। শিক্ষক নিয়োগে কেলেঙ্কারি কি আগে হয়নি? হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী ওমপ্রকাশ চৌটালাকে জেল খাটতে হচ্ছে। মধ্যপ্রদেশের ব্যাপম কেলেঙ্কারিতে ১০০ জন সাক্ষীর অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল। তদন্ত হয়েছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক। কিছুই পাওয়া যায়নি।
আনন্দে ছিলাম যে, আমাদের রাজ্যে ও রকম কিছু হবে না। হল যখন, এমনই হল? পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ঘটনায় অতিরিক্ত মাত্রা যোগ করেছেন মডেল-অভিনেত্রী অর্পিতা। নগদে কোটি কোটি টাকা পাওয়া গিয়েছে তাঁর দু’টি ফ্ল্যাটে। তিনি বলেছেন, টাকা তাঁর নয়। তাঁর অত টাকা থাকার কথাও নয়। এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) তাই সন্দেহ করেছে পার্থকেই। পার্থ শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালীন শিক্ষক নিয়োগে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে বলে অভিযোগ। সবাই তো পরেশ অধিকারী (প্রাক্তন শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী, যাঁর মেয়েকে শিক্ষক পদ থেকে বরখাস্ত করেছে হাই কোর্ট) নন। অন্যদের নিশ্চয়ই টাকা খরচ করতে হয়েছে। মন্ত্রীমশাইয়ের সুযোগ ছিল ওই টাকা আত্মসাৎ করার। সত্যি মিথ্যে বোঝা যাবে তদন্তের পরে।
পার্থ চট্টোপাধ্যায়-অর্পিতা মুখোপাধ্যায়
মির্জা গালিব তাঁর বান্ধবীকে বলেছিলেন, ‘‘দেখো আমাকে যেন তোমার বাড়ির কাছে কবর দিও না। দুনিয়াসুদ্ধ লোক আসবে আমার মাজার দেখতে। আমি চাই না তারা তোমার হদিস পাক।’’ পার্থবাবুর সে দুশ্চিন্তা ছিল বলে মনে হয় না। সংবাদমাধ্যম অনায়াসেই পেয়েছে চার বান্ধবীর ঠিকানা। সাবাশ বাংলার পুরুষতন্ত্র! মুখ্যমন্ত্রীর মুখেও শুনলাম ‘নারীঘটিত’ ব্যাপারের কথা।
কিন্তু সমস্যা তো অফিসার বা বাংলাকে নিয়ে নয়। গোটা দেশ দুর্নীতির কবলে। নির্বাচনে জয়লাভের অনিশ্চয়তা ছেড়ে ‘রেডিমেড’ বিধায়ক কেনার প্রবণতা বাড়ছে। দুর্নীতির মোকাবিলায় কোনও অস্ত্র আছে আমাদের হাতে? আমরা কত দূর প্রস্তুত? অস্ত্র বলতে তো আমাদের আছে সিবিআই এবং ইডি। আদালতই সিবিআইয়ের নাম দিয়েছিল ‘খাঁচার পাখি’। এখন তার শেখানো বুলিও বন্ধ। অনেক রাজ্যে তার প্রবেশ নিষেধ। তাই ইডি হয়ে উঠেছে কেন্দ্রের প্রধান আয়ুধ। আমাদের রাজ্যে সিবিআই নিজেকে প্রমাণ করতে পারেনি। সারদা-নারদে শূন্য পেয়েছে। তা-ও আমাদের বিশ্বাস উচ্চ আদালতের তদারকি থাকলে তারা উচিত মতো তদন্ত করবে। কিন্তু আদালতের অন্য কাজ আছে। তারা কত মামলায় তদারকি করবে?
(লেখক রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যসচিব। মতামত নিজস্ব)