খবরে যাকে বলা হয় ‘অতিবৃষ্টি’ কিংবা ‘ভারী বৃষ্টি,’ হিঙ্গলগঞ্জের মানুষ তাকে বলেন ‘আকাশবন্যা’। ইয়াস ঘূর্ণিঝড়ের ঝাপটা না সামলাতেই গর্জে এল মেঘভাঙা জল। “যেন এক সঙ্গে দশটা মেশিন চলছে,” বললেন মাধবকাঠি গ্রামের মনোরঞ্জন মিস্ত্রি। তাঁর সেচ পাম্পের গভীরতা ৬৭০ ফুট, নইলে মিষ্টি জল মেলে না, কেবল নোনাজল ওঠে। সেই মহার্ঘ মিঠে জল অভিশাপের মতো নেমে এসে দ্বিতীয়বার-বোনা বীজতলা ডুবিয়ে দিল। তার পরেও বৃষ্টি চলছেই। ভাদ্রেও বহু বাড়িতে এক কোমর জল, পুকুরে ছাড়া ট্যাংরা-জাপানি পুঁটি ধানখেতে খেলে বেড়াচ্ছে। চাষের জমিতে মুখ দেখছে আকাশ। কিছু চাষি ফের বীজতলা তৈরি করছেন। যোগেশগঞ্জের এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কাছে লবণসহিষ্ণু ধানবীজ নিতে এসেছিলেন টুম্পা সর্দার। এখন বীজতলা করলে কতটুকু ধান হবে? “খড় তো হবে। বাড়িতে পাঁচটা গরু,” বললেন টুম্পা।
এক ফসলি গ্রামে খড়ের আশায় ধানচাষ— বিপন্নতার এই ছবি আসে না সংবাদে। জলের ক্ষত কত গভীর, কে খোঁজ করে? কাগজে-চ্যানেলে সুন্দরবনের জায়গা নিয়েছে আফগানিস্তান। অথচ সুন্দরবনও তো এক ফ্রন্টিয়ার, একবিংশের মহাযুদ্ধের— জলবায়ু পরিবর্তন বনাম মানুষ। ঝঞ্ঝা, বন্যা, অতিবৃষ্টির ‘শক অ্যান্ড অ’ শুধু নয়, বিপক্ষ অদৃশ্য অস্ত্র রেখে যায়— নুন। টিপকলের জলে নুন, সেচের জলে নুন, খেতের মাটিতে নুন। লেবুখালির মেয়েরা বেশি চিনি দিয়ে চা করে দিলেন, তবু সে চা নোনতা। নুনের জন্য ঘর ছাড়ছেন মানুষ। লেবুখালির মতো প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্নাটক, তামিলনাড়ুর উদ্দেশে বাস ছাড়ছে। আয়লার পর তিন বছর লেগেছিল জমির নুন সরতে, তাই গোদাবরী উপত্যকায় খেতমজুরিতে রওনা দিচ্ছেন বাংলার চাষি। আরও বেশি লোক যাচ্ছেন কারখানায়, নির্মাণকাজে। সুন্দরবনের কত পুরুষ-মহিলা ঘর ছেড়েছেন? কেউ জানে না।
সুন্দরবনের কত মেয়ে গর্ভাশয় খুইয়েছেন? কেউ জানে না। কিন্তু দুর্যোগ-পরবর্তী গণপ্রস্থানের মতোই মেয়েদের প্রজননতন্ত্রে নুনের ক্ষতও জলবায়ুর সঙ্গে যুদ্ধের পরিণাম। পরিযায়ীদের জন্য তবু তৈরি হয়েছে নথিভুক্তির পোর্টাল। মেয়েদের রোগের তথ্য কোথাও নেই। নোনা নদীতে মীন ধরে, নোনা পুকুরে চান করে, বানভাসি ঘরে কোমরজলে দাঁড়িয়ে দিনের পর দিন কাটে মেয়েদের। পরিণাম, প্রতি মাসে অপরিমিত রক্তক্ষরণ। যৌনমিলন হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যথা সহ্যের পরীক্ষা, প্রস্রাবের জ্বালা সইতে হয় দাঁত চিপে। আশাকর্মী কোমল মিস্ত্রি বললেন, “নদীর ধারে যারা বাস করছে, জাল ফেলছে, তারা এ সব রোগ এড়াতে পারছে না।” কালিন্দি, রায়মঙ্গল, গোসাবা, বিদ্যাধরী— সুন্দরবনে নদীর তীর-ঘেঁষা গ্রামগুলোর অন্তত হাজার পঞ্চাশেক মেয়ে সারা বছর দিনে পাঁচ-ছ’ঘণ্টা কাটান নোনা নদীতে। দুর্যোগ আরও বেশি মেয়েকে বাধ্য করছে মীন ধরতে। মাধবকাঠির দ্রৌপদী সর্দার দু’শো টাকায় হাজার মীন কিনে তিনশো টাকায় বেচেন ব্যবসায়ীকে। বললেন, আগে গরিব মেয়েরাই এ কাজ করত। এখন যাদের পুরুষ বাইরে কাজে গিয়েছে, সেই মেয়েরাও ‘টেম্পু’ জাল টানছে। স্থানীয়রা জানালেন, অনেকে দাদন নিয়ে রেখেছে, মীন বেচে শোধ করে। হাজার মীন ধরতে চার-পাঁচ দিনও লাগে। সাপে কামড়ায়, নদীতে ফেলে-দেওয়া মদের বোতলের ভাঙা কাচে পা কাটে, স্রোত ঠেলে হেঁটে কোমর ব্যথায় ছিঁড়ে যায়, গর্ভাশয় স্থানচ্যুত (প্রোল্যাপ্স) হয়।
কিন্তু সব চাইতে অসহায় করে ‘পেলভিক ইনফ্লামেশন’— প্রজননতন্ত্রে সংক্রমণ। নোনাজল থেকে যৌনপথে ছত্রাকের আক্রমণ, চুলকানি, জ্বালা, শ্বেতস্রাব, অনিয়মিত বা অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ। আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ শ্যামল চক্রবর্তী আমপানের পর থেকে নিয়মিত মেডিক্যাল ক্যাম্প করেন সন্দেশখালি, মিনাখাঁ, হিঙ্গলগঞ্জের বানভাসি গ্রামে। “যোনি, গর্ভাশয়ে সংক্রমণ এখানে প্রচুর মেলে। খোঁজ করে দেখছি, শুধু পরিচ্ছন্নতার অভাবই কারণ নয়। লিটারে প্রায় ২০ গ্রাম নুন রয়েছে এখানকার জলে। এই ‘হাইপারটনিক স্যালাইন’ যোনিপথের স্বাভাবিক রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ধ্বংস করে দেয়, সংক্রমণ সহজে ছড়ায়। স্বতঃস্ফূর্ত গর্ভপাতের কেসও পাচ্ছি।” মুশকিল হল, স্থানীয় চিকিৎসকদের (অধিকাংশ ডিগ্রিহীন) কাছে মেয়েরা এ সব সমস্যা নিয়ে গেলে তাঁরা অনেকেই বলেন, “ইউটেরাসে টিউমার হয়েছে।” ‘টিউমার’ শুনেই ভয় পান মেয়েরা। যোগেশগঞ্জের মতো ছোট দ্বীপের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে মাসে পাঁচ-সাতটা গর্ভাশয় বাদ দেওয়া হচ্ছে, জানালেন ক্লিনিকের মালিক। তবে অধিকাংশ যাচ্ছেন নার্সিংহোমে। সরকারি চিকিৎসক ফারুক হাসান বসিরহাটে স্বেচ্ছাসেবক। দেখছেন, ‘স্বাস্থ্যসাথী’ কার্যকর হওয়ার পরে গর্ভাশয় বাদ দেওয়ার অস্ত্রোপচার (হিস্টরেকটমি) অন্তত তিনগুণ বেড়ে গিয়েছে বসিরহাটের নার্সিংহোমগুলোতে। এর কতটা চিকিৎসা, কতটা দুর্নীতি, দেখছে কে? ছাব্বিশ বা ছত্রিশ বছরের তরুণীরও গর্ভাশয় বাদ যাচ্ছে, খরচ দিচ্ছে রাজ্য সরকার।
অথচ সরকার খবর রাখে না, কত গর্ভাশয় (অনেকের ডিম্বাশয়সুদ্ধ) বাদ পড়ছে। প্রসূতিমৃত্যু বা সিজ়ারিয়ান অস্ত্রোপচারে সরকারি তথ্য রাখার কড়াকড়ি আছে, নেই হিস্টরেকটমির। বহু চিকিৎসক একান্তে বলছেন, স্বাস্থ্যসাথী কার্যকর হওয়ার পরে হিস্টরেকটমি বেড়েছে। সুন্দরবনে তা যেন মাত্রা ছাড়িয়েছে— নোনাজলের সংস্পর্শ থাকলে এ রোগ এড়ানোর উপায় নেই, আর নোনাজল এড়ানোর উপায় নেই মেয়েদের। তবে নোনাজল-মাটিকে স্থানীয় চিকিৎসকরা তেমন গুরুত্ব দেন না। তাঁদের আক্ষেপ, মেয়েরা ‘হাইজিন’ বোঝে না। পুকুরে চান, নোংরা জলে ঋতুকালের কাপড় ধোয়া, অসুরক্ষিত সঙ্গম— ভুগবে না তো কী? অন্তত কলের জলে চান করতে পারে। আর মেয়েরা বলেন, মিঠে জলের কল তো গ্রামেই নেই। লেবুখালির গ্রাম থেকে তেমন টিপকল দু’কিলোমিটার দূরে। “যে মেয়েরা সাইকেল চালায়, তারা একবারে দু’ব্যারেল জল আনতে পারে। অন্যদের কলসি নিয়ে দু’বেলা যেতে হয়। ওই জলে চান, কাপড় কাচা?” সরকারি চিকিৎসা মানে স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে ছত্রাকনাশক ক্রিম আর বড়ি।
বাংলাদেশে বিষয়টা কিছু গুরুত্ব পেয়েছে। অসরকারি সংস্থা ‘লিডার্স-বাংলাদেশ’ একটি গবেষণার রিপোর্টে লিখছে, সুন্দরবনে লবণাক্ত জলে মাছ ধরা, চান, কাপড় কাচার জন্য নানা উপসর্গ দেখা দিচ্ছে, যার অন্যতম যৌনপথে সংক্রমণ। গর্ভাশয়ের প্রদাহ এবং ক্ষত (আলসার) হচ্ছে, যা ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। একটি আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় ধরা পড়েছে, উপকূলের ২০ কিলোমিটারের মধ্যে বসবাসরত মেয়েদের গর্ভ নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি বেশি। সাংবাদিকদের কাছেও সাতক্ষীরা জেলার চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ও মহিলারা জানিয়েছেন, লবণাক্ত জল ব্যবহারে চর্মরোগ থেকে শুরু করে প্রজননতন্ত্রের প্রদাহের যন্ত্রণা, এবং তার পরিণামে অপ্রত্যাশিত মাত্রায় গর্ভাশয় বাদ দেওয়ার কথা। বহু তরুণী স্বামী-পরিত্যক্ত হচ্ছেন।
পশ্চিমবঙ্গে এখনও এমন বড় মাপের সমীক্ষা হয়নি, স্পষ্ট হয়নি এই স্বাস্থ্যসঙ্কটের বিস্তার বা তীব্রতা। বোঝা হয়নি, মেয়েদের এই নিত্যযন্ত্রণার কতটা প্রতিরোধযোগ্য, প্রতিকারই বা কী। চিংড়ির মালাইকারি, কাঁকড়ার ঝালের মতো সুখাদ্যের পিছনে বেদনাদীর্ণ জীবনগুলি নজরে আসে না কারও। সুন্দরবন বাঁচানো মানে ম্যানগ্রোভ রোপণ, বাঘ-কুমির বাঁচানোর ব্যবস্থা তো নয়; উপকূল-কন্যাদের বিপন্নতাও বোঝা চাই, সাড়া দেওয়া চাই তাঁদের সঙ্কুচিত, নীরব আবেদনে।