সাহিত্য আর সিনেমার প্রতি তাঁর প্রেম সবাই জানে। ক্রিকেটেরও পোকা ছিলেন। ক্রিকেট থেকেই অবসরের নীতিটা নিয়েছিলেন সম্ভবত— যেতে হলে এমন সময়ে যাও, যখন লোকে বলবে, এখনই কেন? এমন সময় অবধি থেকে যেয়ো না, যখন লোকে বলবে, এখনও নয় কেন?
প্রশ্ন উঠতে পারে, নিজের শেষ নির্বাচনে তিনি তো পরাস্ত হয়েছিলেন। তা হলে আর স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়ানো কোথায়? কিন্তু ওই ২০১১ সালের পরেও আরও জীবন ছিল। সিপিএমের কাছে বুদ্ধদেবের কোনও বিকল্প ছিল না। কিন্তু তিনি প্যাড-গ্লাভস তুলে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন। দলের পলিটব্যুরো এবং কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন প্রথমে। দলের চাপে রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীতে আরও কিছু দিন থেকে গেলেও শেষ পর্যন্ত সেই পদও ছেড়ে দিয়েছেন। জীবনের শেষ দশকটা লোকচক্ষুর অন্তরালেই কাটালেন।
পরিবার বাংলাদেশের হলেও ছোটবেলা কেটেছে উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুরে। শৈলেন্দ্র সরকার বিদ্যালয়ের ছাত্র। পরে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতক। ষাটের দশকে খাদ্য আন্দোলনে অংশগ্রহণ। বলতে গেলে রাজনীতিতে হাতেখড়ি সেটাই। কমিউনিস্ট পার্টির যুব সংগঠনে তার পরে যোগদান। ষাটের দশকে ছাত্র আন্দোলনের চার মূর্তি বিমান বসু, শ্যামল চক্রবর্তী, দীনেশ মজুমদার ও সুভাষ চক্রবর্তী বুদ্ধদেবকে যুব সংগঠনের দায়িত্বে নিয়ে আসতে তৎপর হয়েছিলেন। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন প্রমোদ দাশগুপ্ত। তখন থেকেই আমৃত্যু প্রমোদবাবুর প্রিয় শিষ্য ছিলেন বুদ্ধদেব।
মাথার উপরে ছিলেন জ্যোতি বসু। বুদ্ধদেবের নিজের কথায়, “সব কিছুতে হয়তো একমত ছিলাম না। কিন্তু সরকার কী ভাবে চালাতে হয়, মন্ত্রিসভায় কী ভাবে কাজ করতে হয়, এ সব ব্যাপার জ্যোতিবাবু আমাকে হাতে ধরে শিখিয়েছেন।” সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে কথা উঠলে মুখ্যমন্ত্রী বসু অনায়াসে বলতেন, “ও সব বুদ্ধ বোঝে!” কাশীপুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে জিতে তরুণ বুদ্ধ তথ্য ও জনসংযোগ দফতরের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। পরের বার কাশীপুরে পরাজিত। কেন্দ্র বদলে যাদবপুর থেকে ১৯৮৭ সালে ফের জিতে মন্ত্রিসভায় ফেরত। যাদবপুরেরই বিধায়ক ছিলেন টানা ২৪ বছর, ২০১১ অবধি। তথ্য ও সংস্কৃতি প্রিয় দফতর হলেও মাঝে কিছু দিন পুরমন্ত্রীর দায়িত্বও সামলেছেন।
কর্মসংস্কৃতি, শিল্প, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান— এ সব ভাবনায় নজর দিয়ে বুদ্ধদেবের রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা নতুন শতাব্দীর গোড়ায় এসে। ২৩ বছরের সরকারে তখন স্থবিরতা এসেছে। সিপিএমকে ‘বঙ্গোপসাগরে ছুড়ে ফেলা’র ডাক দিয়ে জোট বাঁধছেন বিরোধীরা। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাস বিধানসভা ভোটের কয়েক মাস আগে আস্তিনের তাস হিসাবে বার করে আনলেন তাঁর ঘনিষ্ঠতম বন্ধুকেই। দুই বন্ধু বুদ্ধ-অনিলের জন্মদিন এক দিন আগে-পরে, সেই জুটিই ২০০১ সালের কঠিন নির্বাচন পার করিয়ে দিল সিপিএমকে। মুখ্যমন্ত্রী হয়ে ‘ডু ইট নাও’ মন্ত্র নিয়ে নতুন যাত্রা শুরু করলেন বুদ্ধদেব।
তাঁর নেতৃত্বে সরকার স্থবিরতা ভেঙে এগোনোর চেষ্টা শুরু করল। সরকারি কর্মীদের একাংশ বা দলেরই শ্রমিক ইউনিয়ন— বিরূপ প্রতিক্রিয়াও ছিল কিছু। তবে যত ক্ষণ ভোটে জয় আসছে, তত ক্ষণ কোনও বাধাই বাধা হয়নি। শুধু তত্ত্ব আওড়ানো নয়, নতুন প্রজন্মের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে, এই সহজ কথা বলতে বলতেই ২০০৬ সালের বিধানসভা ভোট বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পার করে দিলেন বুদ্ধদেব। ভোটে জয়ের পরেই সিঙ্গুরে ছোট গাড়ির কারখানায় বিনিয়োগের ঘোষণা রতন টাটার তরফে। সপ্তম বামফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে পাশ সিঙ্গুর-সিদ্ধান্ত।
সেই সময়ে ‘ব্র্যান্ড বুদ্ধ’ ভাবমূর্তি শিল্প ও বণিক মহলের কাছে আস্থাভাজন হতে শুরু করল। বুদ্ধদেব ধর্মঘটের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেন, রাজ্যে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজ়েড) চালু করার চেষ্টা করলেন, সাবেক বামপন্থী মহলের আপত্তির সুরও উঠতে শুরু করল। কৃষিজমিতে কেন শিল্প হবে, এই বিতর্কেরও সূত্রপাত হল। শিল্পায়নের রথ ছোটানোর লড়াইটা তখন যেন অনেকটাই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও তাঁর শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেনের। দলের শ্রমিক বা কৃষক সংগঠনকে সামনে রেখে দলের একাংশ তখনও ভিন্ন অবস্থানে। পরে জমি-বিতর্কের জল গড়িয়ে পুরোদস্তুর রাজনৈতিক লড়াইয়ের চেহারা নেওয়ার পরে গোটা দলই ময়দানে নেমেছে। কিন্তু তত দিনে ভিন্নধর্মী ব্যক্তিত্ব হিসাবে বুদ্ধদেবের পরিচয় বঙ্গসমাজের কাছে তৈরি হয়ে গিয়েছে। তাঁর সঙ্গে দেং জিয়াও পিঙের তুলনা হচ্ছে।
ক্রমে তাঁর গলায় দম্ভের সুর, আচরণে উন্নাসিকতার চিহ্নও ফুটে উঠল। কৃষিজমির আন্দোলন দানা বাঁধল, বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাশ ধরে নিলেন। বিরোধীরা তো বটেই, বাম মহল থেকেও সমালোচনা প্রখর হতে লাগল— বামপন্থী সরকার কৃষক, খেতমজুরদের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে কর্পোরেট পুঁজির দাস হয়ে উঠবে কেন? সিঙ্গুরের প্রকল্প বাস্তবায়িত করার প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন বুদ্ধদেব। কিন্তু তাতে জল ঢেলে দিল নন্দীগ্রাম। ২০০৭ সালের ১৪ মার্চে পুলিশের গুলি চলল, ঘটনার ‘দায়’ নিলেন মুখ্যমন্ত্রী। পঞ্চায়েত নির্বাচনে জমি-আন্দোলনের ধাক্কা এসে লাগল সিপিএমের ভোটবাক্সে। আরও শক্তি সঞ্চয় করলেন মমতা। ২০০৯ সালে লোকসভা ভোটে বিরোধীরা ২৭ আর বামফ্রন্ট ১৫। ইস্তফা দিতে চাইলে দল বলল, মাঝপথে ময়দান ছেড়ে দেওয়া যাবে না। বুদ্ধদেবই নেতৃত্ব দিলেন ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটে। কিন্তু ঘরে-বাইরে সর্বত্র নানা বিরূপতায় কোণঠাসা হয়ে তাঁর সরকার ছিল নখদন্তহীন, ‘লেম ডাক’ হয়ে।
২০১১ সালের ১৩ মে। বামফ্রন্ট সরকারের আনুষ্ঠানিক পতন ঘোষণা হল, মুখ্যমন্ত্রী নিজে হারলেন যাদবপুরে। আলিমুদ্দিনে বসে চিঠি লিখলেন প্রকাশ কারাটকে, দলের সব পদ ছেড়ে দিতে চেয়ে। মন্ত্রিসভার সতীর্থ রেজ্জাক মোল্লার ‘হেলে ধরতে পারে না, কেউটে ধরতে গিয়েছে’ জাতীয় সংলাপ তখন জানান দিয়ে দিয়েছে, বুদ্ধদেবের জমানা শেষ। নিজের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন মমতা। এসেছিলেন বুদ্ধদেব।
মহাকরণের কাজ সেরে নন্দনে সন্ধ্যা কাটাতে ভালবাসতেন। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেনদের কাছে অবাধ যাতায়াত ছিল। নীরেন চক্রবর্তী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর সুহৃদ ছিলেন। মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলতে পারতেন, রবীন্দ্রনাথকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে তাঁর রাজনৈতিক অগ্রজেরা ‘বামন হয়ে চাঁদে হাত দিতে’ গিয়েছিলেন!
বলতেন, রাজ্যে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়ের কর্মসংস্থানের জন্য শিল্প দরকার। বুঝেছিলেন, পদ্ধতিতে ভুল হয়েছে। কিন্তু তাঁর উদ্দেশ্য নিয়েও কি সংশয় ছিল বঙ্গবাসীর মনে? ভেবে হয়তো অভিমান জমেছিল তাঁর মনে। সে অভিমান সঙ্গে নিয়েই বিদায় নিলেন তিনি।