আদালতের রায় সর্বদা মান্য। কোর্টের কোনও নির্দেশ কাউকে খুশি করতে পারে, আবার কেউ তাতে ক্ষুব্ধ কিংবা দুঃখিত হতে পারেন। কিন্তু একটি আদালতের কোনও রায় যদি তার উচ্চতর বিচার-মঞ্চ থেকে স্থগিত বা খারিজ করা না হয়, তবে সেই রায় মেনে চলতেই হবে, উপায় নেই। এটা বাধ্যতা।
এ সব অজানা অথবা অভিনব কিছু নয়। কিন্তু মাঝে মাঝে জানা বিষয়গুলিও ঝালিয়ে নেওয়ার দরকার হয়ে পড়ে। কারণ, এগুলি হল একপ্রকার বিধিসম্মত সতর্কীকরণ।
যেমন, সিগারেটের প্যাকেটে ‘ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর’ লেখা দেখেও আমরা অনেকেই বুকভরা সুখটান দিয়ে মুখ ভরে ধোঁয়া ছাড়ি। অপরিমিত মদ্যপান গর্হিত জেনেও পুলিশের উদাসীনতার সুযোগে হয়তো গাড়িও চালাই। অর্থাৎ, জানি, কিন্তু সর্বদা মানি না।
আদালতের রায়কে ইদানীং বড় বেশি করে রাজনীতির দাঁড়িপাল্লায় মাপা হচ্ছে। কেন এই প্রবণতা বেড়ে উঠল, সেই আলোচনা খুব জটিল, ঝুঁকিপূর্ণও বটে। কিন্তু ঘটনা হল, আদালতের বিবিধ রায়কে রাজনীতির লোকজনেরা এখন হামেশা ‘পক্ষপাতদুষ্ট’, ‘প্রভাবিত’ ইত্যাদি বলে থাকেন। দল-নির্বিশেষে এটা দেখা যায়। কোনও ক্ষেত্রে এ-দল বলে, কোনও ক্ষেত্রে ও-দল।
এখন ফের এই সব চর্চা প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। কারণ সবাই জানি, কলকাতা হাই কোর্ট রাজ্যে ভোট-পরবর্তী হিংসার অভিযোগ অনুসন্ধান করে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে রিপোর্ট দিতে বলেছিল। সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে সিবিআই এবং ‘সিট’-কে দিয়ে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। তাতেই আবার রাজনীতি সরগরম।
আদালতের নির্দেশ নিয়ে কোনও রকম আলোচনার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু পৃথক ভাবে রাজ্যে ভোট পরবর্তী হিংসার অভিযোগ, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ভূমিকা ইত্যাদি বিষয়ে কিছু কথা বলা যেতে পারে।
ভোট-পরবর্তী হিংসার অভিযোগ প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে ভোট-পর্ব থেকে শুরু করা ভাল। রাজ্যে ভোট ‘সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ’ রাখতে নজিরবিহীন বন্দোবস্ত ছিল এই বার। মোতায়েন ছিল রেকর্ড সংখ্যক কেন্দ্রীয় নিরাপত্তাবাহিনী। তবু আট দফার ভোট একেবারে ‘নিরামিষ’ ছিল বললে সত্যের অপলাপ হবে।
ছোটখাটো বিবাদ-বিসম্বাদ, চোখরাঙানি বাদ দিলাম। প্রথমে নন্দীগ্রামে, তার পর কোচবিহারের শীতলখুচিতে ভোটের দিনে যা যা ঘটেছে, তাকে কেউই শান্তিপূর্ণ বলবেন না। এর পিছনে কার কী উস্কানি ছিল, কে নব্বই ভাগ দায়ী, কে দশ ভাগ— সে সব রাজনীতির বিতর্ক থাকবেই।
কিন্তু নন্দীগ্রামে ‘অবাধ’ ভোট না-হওয়ার অভিযোগ তুলে তৃণমূল প্রার্থী স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী একটি বুথে গিয়ে বসে পড়লে তা আর পাঁচটি ঘটনার সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে না। তার জের এখনও গড়াচ্ছে।
অন্য দিকে, শীতলখুচিতে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে ভোটের বয়স না-হওয়া এক কিশোর-সহ মোট পাঁচ জনের মৃত্যুর পরে কেন্দ্রীয় বাহিনীর ভূমিকা গুরুতর প্রশ্নের মুখে পড়ে। তখন নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে ছিল রাজ্যের পুলিশ। অভিযোগ থেকে তারাও তাই মুক্ত নয়।
সেখানে এতটা আগুয়ান হয়ে সরাসরি গুলি চালানোর মতো অবস্থা তৈরি হয়েছিল কি না, তার আগে আর কী কী পদক্ষেপ করা হয়েছিল ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর খোঁজা শেষ হয়নি। তবে অনেকেরই হয়তো মনে আছে, বিজেপির নেতারা ওই সময় দর্পভরে বলেছিলেন, আরও বেশি লোক মরল না কেন! বাহিনীর উচিত, বুক লক্ষ্য করে গুলি চালানো।
মানবাধিকারের চেতনা সে দিন জেগেছিল কি কোথাও? জানা নেই। অন্তত মানবাধিকার রক্ষায় ব্যগ্র ও দায়বদ্ধ কোনও ব্যক্তি বা সংগঠন এই নিয়ে কিছু করেছিলেন বলে স্মরণ হয় না। যা হয়েছিল, সবটাই ছিল রাজনীতির মোড়কে ঢাকা। ফলে হল শুধুই আমরা-ওরা!
এ বার ভোট-পরবর্তী হিংসার বিষয়। এ ক্ষেত্রেও একটু ফিরে দেখতেই হবে। ভোটের ফল বেরোলো ২ মে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৃতীয় বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নিলেন ৫ মে। মাঝখানে মাত্র তিন দিনের ব্যবধান। নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণ তখনও বহাল। যদিও ভোট পরবর্তী হিংসার যুক্তিতে আইনশৃঙ্খলার প্রশ্ন তুলে মুখ্যমন্ত্রীর শপথের আগেই নির্বাচিত সরকারকে আটকানোর জন্য রাষ্ট্রপতির শাসন জারির চেষ্টা হয়েছিল নানা ভাবে।
অন্য দিকে, ভোটের পরে রাজ্যে ‘চরম তাণ্ডব’ চলছে বলে শপথ-অনুষ্ঠানে প্রকাশ্য অভিযোগ করেন রাজ্যপাল। টুইট করে বলেছিলেন, “আইনশৃঙ্খলার এই ভেঙে পড়া এড়িয়ে যাওয়া চলবে না।” কিছু ঘটনা যে ঘটেছিল, সন্দেহ নেই। রাজ্যপালের জবাবে রাজভবনে দাঁড়িয়ে মমতার বক্তব্য ছিল, “গত তিন মাস আমার এক্তিয়ারে ব্যবস্থা ছিল না। ফলে কিছু দুর্বলতা, অক্ষমতা থাকতে পারে। তবে আজ থেকে ব্যবস্থা করব।”
কী ব্যবস্থা হয়েছিল, তাতে হাল কতটা বদলেছিল, সেই সব অবশ্যই তর্ক ও প্রমাণসাপেক্ষ। তবে বিজেপির অভিযোগের দিস্তা বেড়েছে। আর রাজ্যপাল ক্রমাগত বলেছেন, স্বাধীনতার পর থেকে এমন ‘ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি’ কখনও হয়নি!
এ বার কিন্তু মানবাধিকারের প্রশ্নে মামলা হল। হাই কোর্ট জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে অভিযোগগুলি সরেজমিন অনুসন্ধান করে রিপোর্ট দিতে বলায় কমিশন সাত সদস্যের দল পাঠাল। জুলাইয়ের মাঝামাঝি সেই রিপোর্ট জমা পড়ল হাই কোর্টে।
রিপোর্টের যে বয়ান সামনে এসেছে, তা তীক্ষ্ণ মন্তব্য ও মতামতে ঠাসা। তার বিশদে যেতে চাই না। তবে রিপোর্টে কিছু সুপারিশ ছিল। যার কয়েকটি আবার বলা দরকার। কমিশনের প্রতিনিধিরা রিপোর্টে বলেছিলেন, খুন ও ধর্ষণের মতো গুরুতর অভিযোগগুলির তদন্তভার সিবিআই-কে দেওয়া হোক। বাকিগুলির তদন্ত হোক ‘সিট’ গঠন করে। তদন্ত প্রক্রিয়ায় নজরদারির জন্য কোনও অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে দায়িত্ব দেওয়ার সুপারিশও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্টে ছিল।
মূল মামলাটি রয়েছে হাই কোর্টের মাননীয় ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি-সহ পাঁচ জন মাননীয় বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চে। সেই বেঞ্চ এক সপ্তাহ আগে যে সর্বসম্মত নির্দেশ দিয়েছে, তাতে ভোট-পরবর্তী হিংসার সঙ্গে সম্পর্কিত খুন ও ধর্ষণের অভিযোগগুলি তদন্ত করবে সিবিআই। বাকিগুলির তদন্তে তৈরি হয়েছে বিশেষ তদন্তকারী দল বা ‘সিট’। তার কাজ পর্যবেক্ষণ করবেন সুপ্রিম কোর্টের এক জন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি।
আইনের কাজ আইন করছে। মন্তব্যের ধৃষ্টতা নেই। রাজনীতির জটও পাকিয়ে উঠছে তার নিজস্ব ধর্মে। তৃণমূল তো বটেই, সিপিএম পর্যন্ত অভিযোগ করেছে, মানবাধিকার কমিশনের দলটি নাকি শুধু একটি নির্দিষ্ট দলেরই কথা শুনেছে এবং সেইমতো অভিযোগ নিয়েছে। আবার বিজেপির প্রতিক্রিয়ায় এটা পরিষ্কার যে, তারা আদালতের নির্দেশে খুব খুশি। যা হোক, ও সব আমাদের মাথা ঘামানোর বিষয় নয়।
কিন্তু এ ক্ষেত্রে মানবাধিকার কমিশনের কার্যধারা সম্পর্কে মাননীয় বিচারপতি ইন্দ্রপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়ের কিছু পর্যবেক্ষণ উল্লেখ করতেই হবে। তিনি বেঞ্চের পাঁচ বিচারপতির এক জন।
বিচারপতি মুখোপাধ্যায়ের পর্যবেক্ষণ কমিশনের দলটির দায়িত্ব ছিল তথ্যানুসন্ধান। মতপ্রকাশ বা সুপারিশ করা নয়। এটা জানা উচিত ছিল।
বিচারপতি মুখোপাধ্যায় দেখেছেন, ১৯৭৯টি অভিযোগের মধ্যে ৮৬৪টিতে ঘটনার তারিখ নেই। তা ছাড়া, ২ মে থেকে ৫ মে-র মধ্যে, অর্থাৎ মুখ্যমন্ত্রীর শপথের দিন পর্যন্ত, অভিযোগের সংখ্যা ৮৯২। তার পরে ১৮৮। তাঁর মতে, এই পরিসংখ্যান থেকে প্রমাণিত হয় না যে, শাসক দল হিংসায় মদত দিয়েছে। ‘ভয় দেখিয়ে’ অভিযোগ প্রত্যাহারের বিবরণ আদালতে জমা পড়েনি বলেও উল্লেখ করেছেন এই বিচারপতি। তাঁর অভিমত, নির্বাচন কমিশনের এক্তিয়ার থাকাকালীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় তাদের ‘সদর্থক’ ভূমিকা থাকা উচিত।
শেষ কথায় আবারও বলি, আদালত শিরোধার্য। কিছু আভাস, কিছু অনুমান হয়তো থেকে যাবে।