ভেবে দেখতে হবে মহিলাদের কথাও। স্তন ক্যানসার বা জরায়ু ক্যানসারে আক্রান্ত হলে তাঁদের নিয়মিত চিকিৎসা করাতে হয়। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ
ক্যানসার সচেতনতা বলতে আমরা কী বুঝি? শুধুমাত্র সাধারণ মানুষের সচেতনতা? নাকি সাধারণ চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ও চিকিৎসা পরিকাঠামোর সঙ্গে যুক্ত প্রশাসনিক ও বিভিন্ন বিভাগের কর্মীদের সচেতনতাও? দ্বিতীয় অর্থটিই অভিপ্রেত। অর্থাৎ, ক্যানসার সচেতনতা বললে এক দিকে সাধারণ মানুষের ক্যানসার রোগ সম্পর্কে সচেতন থাকার বিষয়টি যেমন বোঝায়, পাশাপাশি বোঝায় প্রশাসনিক ও স্বাস্থ্য পরিকাঠামো পরিচালকদের সচেতনতাও। কারণ, যাঁরা ক্যানসার চিকিৎসার নীতি প্রণয়ন করছেন, তাঁদেরও রোগ ও তাঁর প্রভাব সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। বুঝতে হবে, ভারতের মতো এই বিপুল জনসংখ্যার দেশে ক্যানসার মোকাবিলা করতে গেলে পৌঁছতে হবে প্রান্তবাসী মানুষের কাছে। কী ভাবে সমাজের পরিধির দিকে থাকা, অন্তে থাকা মানুষদের ক্যানসার সম্পর্কে সচেতন করা যাবে ও তাঁদের কাছে চিকিৎসা পৌঁছে দেওয়া যাবে, সেটাও ক্যানসার সচেতনতা দিবসের গোড়ার কথা হতে পারে।
আমাদের দেশে শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামাঞ্চলেই বেশি মানুষ বসবাস করেন। শতাংশের বিচারে ক্যানসার রোগীর সংখ্যাও গ্রামঞ্চলেই বেশি। কিন্তু দেশের ক্যানসার চিকিৎসার মানচিত্র শহর দিয়ে গ্রামকে ঘিরে রেখেছে। উচিত ছিল গ্রামে ছোট ছোট ক্যানসার চিকিৎসা ও রোগ নির্ণয় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা, নিদেনপক্ষে প্রাথমিক স্তরে ক্যানসার নির্ণয়ের ব্যবস্থা থাকলেও চলত। কিন্তু তাও করতে উঠতে পারেনি রাষ্ট্র। তাই শুধু ‘লক্ষণ দেখে ক্যানসার চিনুন’-এর পাঁচালি সচেতনতা দিবসের এক মাত্র সুখপাঠ্য দাবিপত্র হতে পারে না। বরং পরিকাঠামো ও ব্যবস্থার উন্নতি করে কী ভাবে দেশের অন্তজ মানুষদের কাছে ক্যানসার চিকিৎসা আরও সহজে পৌঁছে দেওয়া যায়, তাঁর একটা গতিপথ নির্মাণ করা আলোর ঠিকানা দিতে পারে আমাদের।
এই তো আমাদের দেশ! এখনও দেশের কোনও কোনও গ্রামে আঁধার কাটে মোমবাতির আলোয়, বিদ্যুতে নয়। এখনও কোনও গ্রাম থেকে কয়েক ঘণ্টা পায়ে হেঁটে স্কুলে ছোটে কৈশোর। সন্তানসম্ভবা মেয়েটিকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যেতে যেতে প্রশস্ত গমক্ষেতের পাশে জন্ম নেয় ভারতের ভবিষ্যৎ। এ দেশে, শহুরে আতিথেয়তায় নিরাপদ নাগরিক ক্যানসার সচেতনতার দিন ‘কী থেকে কী হয়’-এর চর্বিতচর্বন পড়ে হয়ত টনসিলে চাপ দিয়ে ঠান্ডা লেগে হওয়া ব্যথাকে ক্যানসার ভেবে দুশ্চিন্তা করতে পারেন, কিন্তু সিংহ ভাগ ভারতীয়ের সেই সুযোগ নেই। আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, গ্রামাঞ্চলের অনেক মানুষ চিকিৎসকের কাছে পৌঁছতে অনেকটা দেরি করে ফেলেন। যদি তাঁদের গ্রামে ক্যানসার রোগ নির্ণয়ের উপযুক্ত পরিকাঠামো থাকত, তা হলে তাঁরা অনেকটা আগে এসে পৌঁছতে পারতেন। তাতে সেরে ওঠার সম্ভাবনা অনেকটা বেশি থাকত।
ক্যানসার চিকিৎসার খরচ নিয়েও নানা রকম ভাবনা সাধারণ মানুষের মনে কাজ করে। এ কথা সত্য যে সরকারি হাসপাতালের পরিকাঠামোর উন্নতি, বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে স্বাস্থ্যবিমার সুবিধা, বিনামূল্যে ওষুধ পাওয়া, এ সবই ক্যানসার চিকিৎসার খরচ এখন অনেকটাই কমিয়েছে। কিন্তু ক্যানসার চিকিৎসা কেন্দ্রগুলি শহরকেন্দ্রিক হওয়ায় হতদরিদ্র ভারতবাসীর কাছে গ্রাম থেকে শহরে এসে চিকিৎসা করানোর আনুষঙ্গিক খরচ হয়ে দাঁড়াচ্ছে পাহাড় প্রমাণ। সেই সঙ্গে আছে পারিবারিক কাঠামোর নানা বাধা। সব মিলিয়ে গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিকাঠামোয় ক্যানসার রোগ নির্ণয় বা চিকিৎসার তেমন সুবিধা না থাকায়, সবটাই হয়ে দাঁড়াচ্ছে সমস্যার। গ্রাম থেকে ট্রেনে বাসে করে শহরে আসতে কিছুটা যাতায়াত ভাড়া লাগে। চিকিৎসার সময়টা বাড়ি ছেড়ে শহরে থাকতে হয়, তার কিছু খরচ আছে। সব মিলিয়ে স্বল্প আয়ের মানুষের কাছে এই আনুষঙ্গিক খরচই হয়ে দাঁড়ায় অনেকটা। এ ছাড়া, সরকারি হাসপাতালে সব পরীক্ষা করার পরিকাঠামো নেই। সে ক্ষেত্রে অল্প হলেও বাইরে থেকে পরীক্ষা করাতে হয়। কিছু ওষুধও কিনতে হয় বাইরে থেকে। ক্যানসার চিকিৎসার দীর্ঘ সময় ধরে এ সবের খরচ বহন করা কি এক জন ভূমিহীন ক্ষেতমজুরের পক্ষে সম্ভব? তিনি তো শহরে থেকে উপার্জনও করতে পারছেন না। তা হলে এই অফুরন্ত অর্থের জোগান কে দেবে? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার সময় এসেছে।
ক্যানসার সচেতনতার মধ্যে এ সবই পড়ে। এক জন সাধারণ মানুষের যেমন করে ক্যানসার সম্পর্কে সচেতন হওয়া কর্তব্য, তেমনই রাষ্ট্রেরও সচেতন হওয়া দরকার। কী ভাবে মানুষের কাছে ক্যানসার চিকিৎসা ও রোগ নির্ণয় পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া যায়, তা ভেবে দেখতে হবে প্রশাসনকে।
ভেবে দেখতে হবে মহিলাদের কথাও। স্তন ক্যানসার বা জরায়ু ক্যানসারে আক্রান্ত হলে তাঁদের নিয়মিত চিকিৎসা করাতে হয়। সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় করাতে হবে। তার জন্য হেঁশেল ঠেলা মহিলাটিকে এক দিনের জন্য ‘সংসার-ধর্ম’ শিকেয় তুলে আসতে হবে চিকিৎসা কেন্দ্রে। আমি কর্মজীবনে দেখেছি, চিকিৎসা কেন্দ্রে আলাদা প্রাধান্য দেওয়া ও সুযোগ-সুবিধা কথা বলার পরেও মহিলারা আসেননি। কারণ, তাঁরা সংসার ছেড়ে বেরতে পারেননি। এ পুরুষতান্ত্রিক মায়াজাল ছেঁড়ার সাধ্য ঘোমটা টানা বৌটির নেই, শহুরে সমাজ সেটা বোঝে? প্রশাসনকে তো বুঝতে হবে, বাড়ির কাছে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পরিষেবা পেলে হয়ত সেই মহিলা সামান্য সময় বার করে রোগ নির্ণয়ের জন্য আসবেন। কিন্তু তা সময় ও দূরত্বের বেড়ায় আটকে থাকলে প্রাথমিক স্তরে লক্ষণহীন বা অস্পষ্ট ক্যানসারের লক্ষণকে সাধারণ ব্যথা বলে বিবেচনা করে খানিক ভুলে থাকবেন, কারণ, তাঁর সংসার-ধর্ম আগে। এ সব নিয়ে নীতি প্রণয়নকারীদের সচেতন হতে হবে। মানচিত্র তৈরি করতে হবে, কোথায় কোন ক্যানসারের প্রকোপ বেশি। সেই অনুসারে তৈরি করতে হবে চিকিৎসা ও রোগ নির্ণয়ের কেন্দ্র। যদি গ্রামীণ স্তরে প্রাথমিক রোগ নির্ণয় কেন্দ্রটি তৈরি করে কোনও বড় সরকারি বা বেসরকারি ক্যানসার চিকিৎসা কেন্দ্রের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে চিকিৎসা করা যায়, তা হলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলেই মনে করি।
শতাংশের বিচারে ক্যানসার রোগীর সংখ্যাও গ্রামঞ্চলেই বেশি। প্রতীকী ছবি
এমনই অনেক কথা বলা উচিত। স্বল্প পরিসরে হয়তো সবটা বলা সম্ভব নয়, তবু আরও একটি কথা না উল্লেখ করলেই নয়, তা হল রাজ্যের বাইরে ক্যানসার চিকিৎসার প্রতি অকারণ ভরসা। রাজ্যের বাইরে গিয়ে চিকিৎসা করাতে হলে, কয়েকটি সাধারণ বাধার কথা মাথায় রাখতেই হয়। প্রথমটি হল ভাষা। যাঁরা বাইরে চিকিৎসা করাতে যাচ্ছেন, তাঁদের সকলেই ইংরেজি বা হিন্দি ভাষায় সড়গড় হবেন, এমনটা নয়। স্বাভাবিক ভাবে অন্য রাজ্যে গিয়ে চিকিৎসা করাতে সমস্যার মুখে পড়তে হয় তাঁদের। তার উপর খরচ। রাজ্যের বাইরে যাওয়া মানে চিকিৎসার খরচ বাদেও বিপুল একটা খরচ ঘাড়ে নিতে হয় রোগীর পরিবারকে। থাকা, খাওয়া ও যাতায়াত, এই বাজারে যে ভার অনেকটাই। যে কোনও রোগীর পরিবারকে চিন্তা করতে হবে, কেন বাইরে যাচ্ছেন তাঁরা? চিকিৎসা পরিকাঠামোর দিক থেকে আমাদের রাজ্য দক্ষিণ ভারত বা মুম্বইয়ের থেকে পিছিয়ে নেই। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। আমি এক চিকিৎসককে চিনি, যাঁর মুম্বইয়ে বিখ্যাত ক্যানসার চিকিৎসা কেন্দ্রে দীর্ঘ দিন কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তিনি এক সময়ে সেখান থেকে রাজ্যে ফিরে চিকিৎসা করতে শুরু করেছেন। তাঁকে না দেখিয়ে আক্রান্তকে নিয়ে মুম্বইয়ে যাচ্ছেন রোগী আত্মীয়রা, যেখানে রাজ্যে ফেরা চিকিৎসকের থেকে কম অভিজ্ঞতা সম্পন্নরা এখন রোগী দেখছেন। কেবল মাত্র ‘মুম্বই’ বা ‘অন্য রাজ্যে চিকিৎসা’- এই শব্দগুলির প্রতি আসক্তি অকারণে টেনে নিয়ে যাচ্ছে রোগীর পরিবারকে। এ ছাড়া অনেক আক্রান্তের পরিবারই দীর্ঘ দিন ধরে রাজ্যের বাইরে চিকিৎসা চালিয়ে নিতে যেতে পারেন না। খরচের কারণে রাজ্যে ফিরে আসতে হয়। তার পর আমাদের মতো চিকিৎসকের কাছে যখন রোগীকে নিয়ে তাঁর পরিবারের লোকেরা আসেন, দেখতে পাই, তাঁরা অনেকে আসল সমস্যাটাই বুঝতে পারেননি, মূলত ভাষার ভিন্নতার কারণে। এ ছাড়া অনেক সময়েই বিভিন্ন পরীক্ষার আসল প্লেট, সিডি ফেরত দেয় না অন্য রাজ্যের হাসপাতাল। তখন পরবর্তী কালে চিকিৎসকদের শুধু নির্ভর করতে হয় সেই সব হাসপাতালের দেওয়া রিপোর্টে। মনে রাখতে হবে, প্লেট যতটা সরাসরি অবস্থা বুঝতে সাহায্য করে, রিপোর্ট ততটা করে না। কারণ, অন্যের দৃষ্টি ও জ্ঞানের উপর নির্ভর করে তৈরি হয় একটি রিপোর্ট, খামতি থাকলে তা ভুল হতেও পারে। আসল প্লেট না পেলে আমাদের পক্ষে তা বোঝাও সম্ভব হবে না। এমনই নানা রকম সমস্যা হয় রাজ্যের বাইরে চিকিৎসা করাতে গেলে। তাই প্রথমেই বাইরে না গিয়ে রাজ্যে চিকিৎসার চেষ্টা করলে উপকৃত হতে পারেন সাধারণ মানুষ। এই বিষয়েও সচেতন হতে হবে মানুষকে।
একটি কথা না উল্লেখ করলেই নয়, তা হল রাজ্যের বাইরে ক্যানসার চিকিৎসার প্রতি অকারণ ভরসা। প্রতীকী ছবি
পরিকাঠামোর বিষয়ে সাধারণ মানুষ থেকে একেবারে তৃণমূল স্তরের কোয়াক ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মীরা অনেক কিছুই জানেন না। সেই কারণে ক্যানসার সচেতনতা দিবস শুধু রোগের সাবধানবাণীতে আটকে থাকলে হবে না। চিকিৎসা পরিচালনায় যাঁরা আছেন, উন্নত পরিষেবা সাধারণ মানুষের কাছে কী ভাবে পৌঁছে দেওয়া যায়, তা নিয়েও সচেতন হতে হবে তাঁদের। এই লেখায় সেই বার্তাই দিতে চাওয়া।
(লেখক চিকিৎসক। মতামত ব্যক্তিগত)