ভারতের বাজেটে আমার আগ্রহ দীর্ঘ দিনের— গোড়ায় অর্থনীতিবিদ এবং অর্থশাস্ত্রের অধ্যাপক হিসাবে, তার পর বেশ কয়েক বছর ভারতের অর্থনৈতিক নীতিপ্রণেতা হিসাবে। ফলে, বেশ কয়েক দশক ধরে আমি আমার অফিসে বসে ভারতের বাজেট দেখছি— কখনও দিল্লিতে, কখনও ওয়াশিংটন ডিসি-তে, কখনও নিউ ইয়র্কে। ২০১০ থেকে ২০১২, এই তিন বছরের বাজেট দেখেছিলাম সংসদে বসে— তখন আমি ভারতের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করছিলাম।
ঠিক এই কারণেই এ বছরের বাজেট দেখা আমার কাছে একটা বিশেষ ঘটনা। এ বছর আমি বাজেট দেখলাম পুরুলিয়ার পারা ব্লকে বরণডাঙা নামে এক গ্রামে বসে। ঝাড়খণ্ড লাগোয়া এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাওয়ার কারণ নানৃতম নামক এক অসরকারি সংস্থা পরিচালিত ফেলিক্স স্কুল। স্কুলটা এক কথায় অসাধারণ। গ্রামের দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েদের জন্য স্কুলটা সেরা শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করেছে— অঙ্ক, কম্পিউটার সায়েন্স, ভাষা শিক্ষা তো বটেই, সঙ্গে আরও অনেক কিছু। গত কয়েক বছর ধরে নানৃতম চেষ্টা করছে তাদের এই শিক্ষাব্যবস্থাকে এই স্কুলটির গণ্ডি ছাড়িয়ে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে নিয়ে যেতে। ‘এডুকেশন ফর অল’ নামক প্রকল্পের মাধ্যমে তারা পৌঁছে যাচ্ছে প্রত্যন্ত সাঁওতাল গ্রামে, অথবা ছোট শহরাঞ্চলে। তাদের এই প্রকল্প দেখতে এসে আমারও ঘোরা হয়ে গেল আশ্চর্য সব জায়গায়।
এই অঞ্চলের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে, গ্রামের সমাজকর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমি এমন কিছু কথা শুনলাম, এমন কিছু চিন্তার খোরাক পেলাম, বড় শহরের কনফারেন্স রুমে বসে যা সচরাচর পাওয়া যায় না। ফেলিক্স স্কুলের উঁচু ক্লাসের এক ছাত্রীর সঙ্গে কী কথা হল, বলি। মেয়েটি তার ক্লাসের সেরা ছাত্রী। আমার সঙ্গে নির্ভুল ইংরেজিতে কথা চালিয়ে গেল দিব্য। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ভবিষ্যতে কী করবে, তা নিয়ে কিছু ভেবেছ এখনও? মেয়েটির প্রথম কথাই আমায় চমকে দিল। কোনও পরিকল্পনা নয়, সে প্রথমেই বলল একটি উদ্বেগের কথা— ভারতে চাকরির বাজারের অবস্থা নিয়ে সে উদ্বিগ্ন। সে বলল, বন্ধুদের সঙ্গে, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কথা বলে সে যা বুঝেছে, তাতে ভারতে চাকরির অভাব এবং পরিস্থিতি ক্রমে আরও খারাপ হয়ে যাওয়া নিয়ে সে দুশ্চিন্তায় রয়েছে।
অর্থনীতিবিদ হিসাবে কর্মসংস্থানের পরিস্থিতির হিসাব আমায় রাখতেই হয়। কিন্তু, কর্মসংস্থানের পরিস্থিতি নিয়ে আমি খবর পাই মূলত বিভিন্ন রিপোর্ট পড়ে, পরিসংখ্যান দেখে। এই মেয়েটি আমায় মনে করিয়ে দিল, কর্মসংস্থানের সমস্যা আসলে সেই সব তথ্য-পরিসংখ্যানের বাইরেও আরও অনেক কিছু— অর্থনৈতিক সমস্যার চেয়েও এটা অনেক বেশি করে মানবিক সমস্যা; ভারতের তরুণ প্রজন্ম এবং তাদের পরিবারের কাছে এই সমস্যার তাৎপর্য বিপুল।
সিএমআইই-র সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে যে, এই মুহূর্তে ভারতে সার্বিক বেকারত্বের হার ৯.১%; কিন্তু ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সিদের মধ্যে এই হার ৪৬%। অর্থাৎ, এই বয়ঃসীমার মধ্যে যাঁরা চাকরি খুঁজছেন, তাঁদের প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৪৬ জন বেকার থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। বেকারত্বের হার এমন চড়া হলে ভারতে আর্থিক বৈষম্য যে ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কোনও কারণ নেই। রাঘব গাইহা, নিধি কাইচার ও বীণা কুলকর্নির গবেষণা জানাচ্ছে যে, এই বেকারত্বের ফলে দেশে দুর্নীতির হারও বাড়ছে। কিছু মাপকাঠিতে দেখা যাচ্ছে, ভারতে গত চার বছরে দুর্নীতির পরিমাণ বেড়েছে।
এত রকম সমস্যার কেন্দ্রে থাকা কর্মসংস্থানের প্রশ্নটিকে যে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সামাল দিতে হবে, তা নিয়ে সংশয়ের কোনও অবকাশ নেই।
বাজেটের কথায় আসি। সাধারণত বাজেট যা করে থাকে, এই বাজেটটিও তা-ই করল— বিভিন্ন সংখ্যা জানাল, সরকারের আয় কত, ব্যয়ই বা কত হতে পারে, রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ কোথায় দাঁড়াবে, এই সব। বাজেট হিসাবে খারাপ নয়। কিন্তু, বরণডাঙায় বসে, স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলতে বলতে, আমি আরও একটু বেশি প্রত্যাশা করছিলাম— ভাবছিলাম, অর্থমন্ত্রী আরও একটু কল্পনাশক্তির পরিচয় দিতে পারতেন, এমন একটা বাজেট তৈরি করতে পারতেন যাতে এমন কিছু বড় চিন্তাভাবনা থাকবে যা ভারতকে বেকারত্বের অন্ধকার পরিস্থিতি থেকে বার করে আনতে পারবে।
বেকারত্ব যে এখন একটি বৈশ্বিক সমস্যা, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। ডিজিটাল প্রযুক্তির যত উন্নতি ঘটছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার যত বাড়ছে, পরিচিত কাজগুলো ততই কমছে। তবে, ভারতের মতো দেশে, যেখানে শ্রম সস্তা, সেখানে আগামী ১০-১২ বছর আরও কাজ তৈরি হতে পারে— বিশেষত, উন্নত দেশগুলি থেকে যে কাজগুলি দ্রুত বিলুপ্ত হচ্ছে, সেগুলি। ভিয়েতনামের মতো দেশ এই কর্মসংস্থানের কাজটি অত্যন্ত সফল ভাবে করছে, চিন গত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে করেছে।
এই বাজেটের কিছু কিছু জায়গায় কর্মসংস্থানের প্রশ্নটিকে সরাসরি দেখা হয়েছে। কিন্তু আশঙ্কা হয়, তেমন নীতির মধ্যে কয়েকটা বিপরীত ফলদায়ী হতে পারে। অর্থমন্ত্রী যে এমপ্লয়মেন্ট লিঙ্কড ইনসেনটিভ স্কিম বা কর্মসংস্থানের সঙ্গে যুক্ত প্রণোদনা প্রকল্প ঘোষণা করলেন, তার কথাই ধরা যাক। এই প্রকল্প বলছে, যাঁরা সংগঠিত ক্ষেত্রে প্রথম বার চাকরি পাবেন, তাঁদের বেতনের সঙ্গে ১৫,০০০ টাকা সরকার বাড়তি দেবে। বাজেটে দাবি করা হয়েছে, এই নীতির সুফল পাবেন ২.১ কোটি তরুণ-তরুণী।
কিন্তু, যে কোনও অর্থনীতিবিদকে জিজ্ঞাসা করলেই তিনি বলবেন, এই প্রকল্পে কর্মীদের যতখানি উপকার হবে, সম্ভবত তার চেয়ে অনেক বেশি লাভ হবে সংস্থাগুলির। কোনও সংস্থা যখন কর্মী নিয়োগ করে, তারা চেষ্টা করে তাঁকে যতটা কম সম্ভব বেতন দিতে— অর্থাৎ, যত কম বেতনে বাজার থেকে কর্মী পাওয়া সম্ভব, ততটাই কম। কর্মীদের মাইনের মধ্যে ১৫,০০০ টাকা যদি সরকার দিয়ে দেয়, তবে সংস্থাগুলি চেষ্টা করবে তাদের পকেট থেকে প্রায় ১৫,০০০ টাকাই কম দেওয়ার— তারা বলবে, কর্মীরা যে বেতন প্রত্যাশা করেন, সেটা তো তাঁরা পাচ্ছেনই, তার কতখানি সংস্থার পকেট থেকে আসছে আর কতটা রাজকোষ থেকে, সেই হিসাবের প্রয়োজন কী? অনুমান করা চলে, এই ১৫,০০০ টাকা শেষ অবধি সংস্থাগুলির জন্য পরোক্ষ ভর্তুকি হয়ে দাঁড়াবে, তাদের লাভের পরিমাণ বাড়বে।
কর্মসংস্থানের হাল ফেরাতে হলে প্রয়োজন ছোট ব্যবসা ও উৎপাদন ক্ষেত্রকে উৎসাহ দেওয়া। এ ক্ষেত্রে ভারতের সম্ভাবনা বিপুল। প্রতি বছরই বাজেটের আগের দিন প্রকাশিত হয় আর্থিক সমীক্ষা। এ বছরের সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, ভারতে ক্ষুদ্র উৎপাদন সংস্থাগুলি টাকার সংস্থান করতে বিপুুল বাধার সম্মুখীন হয়, বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক জটিলতা সামাল দেওয়া তাদের পক্ষে অতি দুষ্কর।
এই ক্ষেত্রটিকে গতিশীল করার জন্য একটি নীতি-দিকনির্দেশিকা প্রয়োজন। ১৯৯১ সালের বাজেট যেমন এমন সব চিন্তাকে ভারতীয় অর্থনীতির আলোচনায় নিয়ে আসে যা দেশটাকে পাল্টে দিতে সক্ষম হয়েছিল, এই বাজেটেও তেমনই কিছু যুগান্তকারী চিন্তার প্রয়োজন ছিল। সেই পরিবর্তনের জন্য যে টাকা প্রয়োজন, তা জোগাড় করা যেত— অতি-ধনীদের থেকে একটি নির্দিষ্ট মাত্রার উপার্জনের চেয়ে বেশি আয়ের উপরে চড়া হারে কর আদায় করলেই হত। ভারতের অতি-ধনীরা দুনিয়ার সবচেয়ে ধনী দেশগুলির অতি-ধনীদের মতোই বিত্তবান, কেউ কেউ তার চেয়েও বেশি। কিন্তু, তাঁদের সর্বোচ্চ আয়ের উপরে ভারতে যে হারে কর আদায় করা হয়, তা বেশির ভাগ উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশের তুলনায় কম। কাজেই, এখানে অনেক কিছু করার সুযোগ ছিল।
তবে, এগুলি করার জন্য বাজেটের অপেক্ষা করতে হবে না। আশা করব, অদূর ভবিষ্যতে সরকার এই নীতিগুলির পথে হাঁটার বিচক্ষণতা দেখাবে।