বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস চলে গেল ১০ সেপ্টেম্বর। সেমিনারে নানা গালভরা কথা, হেল্পলাইনের উদ্বোধন, নানা কর্মসূচি দিয়ে তার উদ্যাপন হল। এমন আলোচনায় আত্মহত্যার কারণ হিসাবে প্রাধান্য পায় মনোরোগের প্রসঙ্গ। যেন অবসাদ আর মানসিক অসুস্থতাই আত্মহত্যার জন্য দায়ী। আত্মহত্যার পিছনে জটিল সামাজিক-সাংস্কৃতিক কারণগুলো আলোচনায় উঠে আসে না। অথচ পরিসংখ্যান বলছে, ভারতে যত মানুষ প্রতি বছর আত্মহত্যা করেন, তার অর্ধেকের কোনও রকম মানসিক অসুস্থতা নেই, রয়েছে বঞ্চনা, বৈষম্য, একাকিত্ব, হারিয়ে ফেলার বেদনা, সম্পর্কের জটিলতা, আর্থিক সঙ্কট, শারীরিক অসুস্থতা, গৃহহিংসা ইত্যাদি সমস্যা।
অসাম্যের বীজটা প্রোথিত রয়েছে আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যেই। যে তীব্র আর্থিক অসাম্য বিশ্ব আজ দেখছে, তা অভূতপূর্ব। ধর্ম, জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ, যৌনতা, সবেতে মিশে-থাকা বৈষম্যের ভাবনা যেন আরও প্রকট হচ্ছে। ঘা দিচ্ছে মানুষের আত্মমর্যাদায়। দিনের পর দিন নিপীড়ন, অপমানের শিকার হতে হতে হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা আর ন্যায়ের বোধ। তা সত্ত্বেও আত্মহত্যার ঘটনা আলোচিত হচ্ছে মানসিক দুর্বলতা, চারিত্রিক দুর্বলতার নিদর্শন হিসাবে। কী ধরনের সামাজিক-ব্যক্তিগত চাপের মুখে পড়ে, উপায়ান্তর না দেখে কোনও ব্যক্তি এমন একটি চরম পথ বেছে নেন? ক’দিন আগে দাবিদাওয়া আদায়ের জন্য শিক্ষিকাদের বিষ খাওয়াই হোক, বা বদলির সুপারিশ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যাওয়া চিকিৎসকের আত্মহত্যায় মৃত্যুই হোক, প্রতিটি ক্ষেত্রেই কাজ করছে এক বিপুল ব্যর্থতা। মানসিক অসুস্থতা দিয়ে সবটুকু ব্যাখ্যা করা চলে না। আত্মহত্যা কেবল মনোরোগ বিশেষজ্ঞের আলোচনার বিষয় নয়।
তথ্য বলছে, প্রতি বছর সারা বিশ্বে প্রায় আট লক্ষ মানুষ আত্মহত্যা করেন। ভারতে ২০১৯ সালে সেই সংখ্যাটা এক লক্ষ ৩৯ হাজারের একটু বেশি। রাজ্যওয়ারি পরিসংখ্যানে ২০১৯ সালে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে মহারাষ্ট্রে, দ্বিতীয় স্থানে তামিলনাড়ু, পশ্চিমবঙ্গের স্থান তৃতীয়। মধ্যপ্রদেশ আর কর্নাটক যথাক্রমে চতুর্থ আর পঞ্চম। পেশার বিচারে ২০১৯ সালে যত মানুষ আত্মহত্যা করেছেন, তার ২৩.৪ শতাংশই দিন-আনা দিন-খাওয়া মজুর। দ্বিতীয় স্থানেই রয়েছেন গৃহবধূরা।
দেশজোড়া লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকে এই সংখ্যা কেবলই বেড়েছে। মনোরোগ সম্পর্কিত একটি আন্তর্জাতিক জার্নালের সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০১৯ সালে যেখানে শুধুমাত্র অনলাইন মিডিয়ায় ২২০টি আত্মহত্যার খবর মিলেছিল, লকডাউন কালে সেই সংখ্যাটা বেড়ে হয়েছে ৩৬৯। লকডাউনের সময় বেশির ভাগ আত্মহত্যায় মৃত্যুর বয়স ৩০ থেকে ৫০-এর মধ্যে, যাঁদের ৭১ শতাংশ পুরুষ, ৭৮ শতাংশ বিবাহিত, প্রায় ৮৩ শতাংশ শ্রমজীবী। এ কি শুধুই মানসিক অসুস্থতা? সংবাদমাধ্যমের বিভিন্ন রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২০ সালে লকডাউন শুরু হওয়ার পর বিভিন্ন সময়ে অন্তত ১৮ জন নবীন শিক্ষার্থী বেছে নিয়েছেন আত্মহননের পথ। এঁরা সকলেই আর্থিক ভাবে দুঃস্থ শ্রেণিভুক্ত, এবং অনলাইন লেখাপড়ার সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পারা, আর্থিক সংস্থান না থাকায় কম্পিউটার বা স্মার্ট ফোন কেনার অক্ষমতা, চাকরি না-পাওয়ার হতাশা— এ সবই এঁদের আক্রান্ত করেছিল।
কৃষক আত্মহত্যার হারে বরাবরই সামনের সারিতে উঠে এসেছে মহারাষ্ট্রের নাম। প্রতি বারের মতো অনাবৃষ্টি, ফসলের যথাযথ দাম না-পাওয়া, অনাদায়ি ঋণের বোঝার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কোভিড। প্রতি বছর ভারতে প্রায় সাড়ে ষোলো হাজার কৃষক আত্মহত্যা করেন। লকডাউনের সঙ্গে জড়িত প্রবল অনিশ্চয়তা তাঁদের সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক অবস্থানকে দুর্বল করে দিয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে উদ্যোগ না করলে এই পরিস্থিতির উন্নতি অসম্ভব!
আর পশ্চিমবঙ্গ? ২০১৯ সালের জাতীয় ক্রাইম রেকর্ডস বুরোর রিপোর্ট অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে নথিভুক্ত আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ১২,৬৬৫টি। রাজ্য সরকারের দাবি অনুযায়ী ২০১৯ সালে একটিও কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা এ রাজ্যে ঘটেনি, যা আপাতদৃষ্টিতে খানিকটা অসম্ভব বলেই মনে হয়। সর্বভারতীয় কৃষকসভার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ২০১১ সালে তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে অন্তত ২১৭ জন কৃষক আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন। মনোরোগ, না রাজনীতি?
আত্মহত্যা প্রতিরোধের আলোচনায় তাই আনতে হবে সামাজিক ন্যায়ের পরিকাঠামোকে আরও শক্তিশালী করার আলোচনাকে। এত দিন এ বিষয়ে সুরক্ষার কথা যেটুকু ভাবা হয়েছে, তা স্বাস্থ্যের দৃষ্টিতে— আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন, এমন ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায় না, বলছে ২০১৭ সালের মানসিক স্বাস্থ্য আইনে। ভারতীয় দণ্ডবিধি থেকেও ৩০৯ ধারাকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্র সরকার, যা বাস্তবিকই সদর্থক। কিন্তু আসল প্রয়োজন, অর্থনৈতিক, সামাজিক চাপ দূর করার জন্য উপযুক্ত নীতি নির্ধারণ ও তার প্রয়োগ। না হলে ‘বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস’ কেবল একটি উপলক্ষ হয়ে রয়ে যাবে।